সোমবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার ব্যর্থ চেষ্টা

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার ব্যর্থ চেষ্টা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একমাত্র বয়লিং পয়েন্ট বা উত্তপ্ত ইস্যু হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। বাকি পাঁচ বছর পক্ষগুলোর মধ্যে কদর্য বাক্য বিনিময়ের মধ্যেই রাজনীতি সীমাবদ্ধ থাকে। উত্তেজিত অশালীন ভাষায় যে রাজনৈতিক নেতা যত বেশি বক্তৃতা দিতে পারেন, তিনি ততটাই আমজনতার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন এবং সমর্থক গোষ্ঠীর বড় বড় হাততালি পান, মিডিয়ায় ভালো কভারেজ হয়। জনকল্যাণ সম্পর্কিত বিষয়, অর্থনীতি, বাজেট, পররাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা নীতি, ইত্যাদির ওপর যিনি যথার্থ রেফারেন্সসহ যুক্তির দ্বারা ভালো-খারাপ দিক তুলে ধরেন, তার কথা আমরা আমজনতা শুনতে চাই না, পানসে লাগে। রেফারেন্স ও যুক্তি ছাড়া একতরফা বক্তব্য দিতে ও শুনতে আমরা অভ্যস্ত, এতে চিত্ত উদ্বেলিত হয়। সহআলোচকের কথার সময় তার কথার মধ্যে কথা বলা, তাকে কথা বলার সুযোগ না দেওয়া, ইত্যাদি অশোভন কাজ যিনি পারেন তিনি টেলিভিশন টকশোতে বেশি আকর্ষিত, এটাতে অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা বাড়ে। তাৎপর্যময় জ্ঞানগর্ভ কথা কেউ শুনতে চায় না, বরং উল্টো মন্তব্য করা হয়, বেটা জ্ঞান দেওয়া শুরু করছে। অনেক পুরনো একটা কথা আছে, যে দেশের বৃহত্তর মানুষ যেমন, সে দেশে সেরকমই রাজা বা শাসক থাকে। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, দাঙ্গাবাজ, সন্ত্রাসী, লাঠিয়াল, ধর্ষক যখন ভোটে জিতে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী হন, তখন রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির অবস্থা তেমনই হবে, ভালো কিছু আশা করা বৃথা। পাকিস্তানি এজেন্ট, গণহত্যাকারী, ধর্ষক, চিহ্নিত ও স্বঘোষিত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী যখন ভোটে জিতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হন, তখন সেই নির্বাচন যত সুষ্ঠুই হোক না কেন, তার মাধ্যমে দেশের কোনো কল্যাণ হবে না, সুস্থ রাজনীতি ফিরবে না। নিজামীকে এদেশের মানুষই ভোটে জিতিয়েছে, এ কলঙ্কের দায় সমগ্র জাতির। কিন্তু এককভাবে এ দায় যদি কারও স্কন্ধে পড়ে তাহলে তিনি হবেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি যদি সামরিক আদেশ দ্বারা বাহাত্তরের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অনুচ্ছেদ ১২ ও ৩৮ বাতিল না করতেন, তাহলে মতিউর রহমান নিজামী ও গং কখনো বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারতেন না। সামরিক শাসকদের প্রবর্তিত রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল পৃথিবীর কোনো দেশেই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের পর পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসা দুজন সামরিক শাসক ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতির সবকিছু নষ্টদের হাতে তুলে দেন। নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়। কিন্তু গত ৩০ বছরে সেই প্রত্যাশা শুধু প্রত্যাশার মধ্যেই রয়ে গেছে। দুই সামরিক শাসক কর্তৃক প্রবর্তিত নষ্ট রাজনীতি শুদ্ধিকরণের পথে কিছুই হয়নি। কেন হয়নি, তার কারণ কম-বেশি সবারই জানা। কিছু ঘটনার সূত্রে একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ তুলে ধরি। বাংলাদেশে কার্যকরী রাজনৈতিক দল এখন দুটি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বাকি শতেরও অধিক সংখ্যক দলে যারা আছেন, তাদের ঠায়-ঠিকানা কিছু নেই। এসব দলের কথিত নেতাদের একমাত্র কাজ হলো আওয়ামী লীগ, আর নয়তো বিএনপির লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে ব্যক্তিগত ভাগ্য উন্নয়ন করা। দুই বড় দলের লেজুড়বৃত্তির বাইরেও কিছু দল আছে, যার নেতারা টেলিভিশনের টকশো ও পত্রিকার কলামে কিছু নীতি বাক্য বর্ষণ ছাড়া বাস্তবে কিছু করতে পারেনি। ২০০৭-২০০৮ মেয়াদে কিছু কিংস পার্টির আবির্ভাব ঘটে। তাদের চোটপাটে তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপির জন্যও মাঠে দাঁড়ানো দায় হয়ে যায়। তারা প্রায় সবাই বিলীন হয়ে গেছেন। দুয়েকজন লাজ-লজ্জাহীনভাবে বিএনপির লেজুড়বৃত্তি বেছে নিয়ে এখনো বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। সুতরাং বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটা সুস্থ রাজনীতি প্রতিষ্ঠার সমঝোতা হলে ওপরে উল্লিখিত দলগুলোকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না। এদের রাজনীতির পরগাছা বলা যায়। ফল কিছু দেয় না, কিন্তু রস শোষণ করে। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এলো। একটু আগে উল্লেখ করেছি, তখন একটা প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সংবলিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পরিবর্তে বিএনপি সরকার হঠকারী শুধু নয়, বিপরীত দিকে যাত্রা শুরু করে। প্রথমত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য দেশব্যাপী গড়ে ওঠা আন্দোলনকে শুধু নির্দয়ভাবে দমন নয়, আন্দোলনকারী নেতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিল বিএনপি সরকার। কৌশলে গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হলো। মানুষ বুঝে গেল বিএনপি সরকার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হতে দিবে না, বরং উল্টোটি করবে। পাকিস্তানের সঙ্গে অত্যন্ত দহরম-মহরম সম্পর্ক শুরু হয়ে গেল। সব রাষ্ট্রাচারের প্রথা ভঙ্গ করে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া একজন পাকিস্তানি জেনারেলের মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিক শোকবার্তা পাঠালেন, যে জেনারেল একাত্তরে বাংলাদেশের গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। দহরম-মহরম সম্পর্ক হলো ঠিকই, কিন্তু একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতিপূরণ ও সম্পদের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ব্যাপারে বিএনপি সরকার একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। এর মাধ্যমে সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথে তৈরি হওয়া সবচেয়ে বড় প্রত্যাশার অপমৃত্যু ঘটে। দ্বিতীয়ত, মাগুরা ও মিরপুরের উপনির্বাচনে বিএনপি সরকারের সীমাহীন কারচুপির মাধ্যমে দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় গণতন্ত্রের অন্যতম সৌন্দর্য নির্বাচনে হেরে যাওয়াকে বিএনপি কোনোভাবেই গ্রহণ করবে না। ফলে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটা যে সমঝোতামূলক রাজনীতির প্ল্যাটফরম তৈরি হয়েছিল তা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তারপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আর কোনো সমঝোতা হয়নি। গত ৩০ বছর এভাবেই চলছে। নব্বই দশকের মধ্যভাগে দুই দলের মধ্যে সমঝোতার অনেক চেষ্টা হয়েছে। তখন কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল স্যার নিনিয়ান মধ্যস্থতার জন্য ঢাকায় আসেন। অনেক দৌড়ঝাঁপ করেন তিনি। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান, সমঝোতা হয়নি। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। ২০০১ সালের জুলাই মাসে মেয়াদ পূর্ণ করে যথারীতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এটাই একমাত্র উদাহরণ যে, একটি সরকার মেয়াদ পূর্ণ করে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় সংবিধান অনুসারে অন্য একটি সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেই আবার ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য অপকর্মে লিপ্ত হয়। আওয়ামী লীগকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশের ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। তারপর পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান যাতে নিজেদের সাবেক দলীয় নেতাকে করা যায় তার জন্য অন্যান্য সব ক্যাডার বাদ দিয়ে শুধু বিচারকদের চাকরির বয়সসীমা দুই বছর বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়ে ক্ষমতাকে ধরে রাখার নগ্ন প্রচেষ্টায় দেশ গভীর সংকটে পড়ে যায়। এর আগে আবদুল জলিল ও মান্নান ভূঁইয়ার আলোচনার চিত্রটি এখনো সবার সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু সমঝোতা হয় না। সে পথ ধরে আসে কথিত ১/১১-এর সরকার। দুই বছর তারা ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালে আবার দুই পক্ষের সমঝোতার কথা সামনে আসে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক দৌড়াদৌড়ি হয়। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে সরাসরি টেলিফোন করেন। এর আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয় নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপি থেকে অর্ধেক মন্ত্রী নেওয়া হবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ যে মন্ত্রণালয় তারা চায় সেটাই তাদের দেওয়া হবে। কিন্তু বিএনপি এক দফা অর্থাৎ শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে অনড় থাকার কারণে সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। টেলিফোন আলাপের সময় বেগম খালেদা জিয়া যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন তাতে গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার ও মূল্যবোধের সবকিছু নস্যাৎ হয়ে যায়। এখন বিএনপি নেতারা বুঝতে পারছেন ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করা ছিল চরম ভুল সিদ্ধান্ত, বলছেন ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত নির্বাচনকালীন সরকার হলে তারা এখন রাজি আছে। কথায় আছে, পাঞ্জাব মেইল কারও জন্য অপেক্ষা করে না। বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা যাওয়ার পর শেখ হাসিনা সমবেদনা জানাতে গেলে বাড়ির গেট খোলা হলো না। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে গেট থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। সুতরাং এসব ঘটনাবলি প্রমাণ করে রাজনীতিতে বিএনপি সবসময় জিরো সাম গেম খেলতে চেয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত একনাগাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা হবে। সরকারের বিরুদ্ধে হামলা, মামলা, হয়রানি, নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছে বিএনপি। এর মধ্যে মিথ্যা-সত্য, দুটোই থাকতে পারে। কিন্তু ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটেনি। ২০২৩ সালের শেষার্ধে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন নিয়ে এখন থেকে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসার সব পথ সাংবিধানিকভাবে রুদ্ধ। সব জেনেও বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলছে। হতে পারে কামান চাইলে অন্তত বন্দুক পাওয়ার আশায় বিএনপি এটা করছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন সবারই প্রত্যাশা। কিন্তু কী প্রক্রিয়ায় সেটা হবে এবং কারা সেই অসামান্য ব্যক্তিবর্গ, যারা সবার কাছে নিরপেক্ষ বলে বিবেচিত হবেন। কঠিন এই প্রশ্নে বড় দুই রাজনৈতিক পক্ষ আগের মতোই বিপরীত মেরুতে থাকবেন তা নিশ্চিত করে বলা যায়। সুশীল সমাজও এটা নিয়ে চরম বিভাজিত অবস্থানে। সংবিধান অনুসারে আইন হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিএনপি-আওয়ামী লীগ, কোনো সরকারই সেটা করেনি। বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি গঠন করেছিলেন সেটা সংবিধানবহির্ভূত এমন কথা কেউ বলেননি বা বলতে পারেননি। সুতরাং আগামী নির্বাচন কমিশনও রাষ্ট্রপতি একইভাবে গঠন করলে সেটিকে আইনত প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ নেই। কেউ হয়তো বলবেন সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে সব পক্ষ একমত হবে এমন নজির কোথাও নেই। সব পক্ষই নিজ নিজ রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জায়গায় অনড় থকবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় কেউ হয়তো বলতে পারেন দুই বড় পক্ষ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কি সমঝোতা হতে পারে না। শেষ কথা বলে কিছু নেই, সমঝোতা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সমঝোতার পথ কীভাবে বিগত সময়ে বিনষ্ট হয়েছে তার যথার্থ নির্মোহ মূল্যায়ন প্রয়োজন। মূল্যায়নপত্রে বেরিয়ে আসা শিক্ষণীয় বিষয়কে অবলম্বন করে সবাই সামনে এগোতে চাইলে আবার সমঝোতার পথ বের হবে। তার জন্য প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষের রাজনীতির চির অবসান ঘটানো আবশ্যক। তা শুধু কথা নয়, কাজে ও সাংবিধানিকভাবে হতে হবে। এর জন্য প্রথমত, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস রাষ্ট্রের জন্য অফুরন্ত সম্পদ, বিএনপিসহ সবাইকে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জাতির পিতা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। তৃতীয়ত, উপরোক্ত দুটি বিষয় এবং বাহাত্তরের সংবিধান কোনো দলের নয়, এটা স্বাধীন বাংলাদেশের মৌলিক ভিত্তি ও দর্শন। এগুলোর প্রতি সবার অকুণ্ঠ সমর্থনসহ হুবহু বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে আসতে হবে। তাহলে একটা সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির পথ সুগম হবে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটবে। উগ্রবাদ, জঙ্গি সন্ত্রাসের আশঙ্কা থেকে মুক্ত হবে বাংলাদেশ। স্বঘোষিত খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ কেউ অবলম্বন করবে না। এরকম একটা সুষ্ঠু সহঅবস্থানের পরিবেশ তৈরি হলে সমঝোতার পথ খুলে যাবে। রাজনীতিতে জিরো সাম গেমের অবসান ঘটবে। রাজনীতি সুষ্ঠু অবস্থায় ফিরে না এলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন যে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয় তা ইতিমধ্যেই বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং রাজনীতি ঠিক না করে শুধু নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে কথা বললে কোনো কাজ হবে না। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা চিরদিনই লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে। আগামীতেও তাই হবে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর