মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

কেন তেলের দাম একবারে লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হলো?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

কেন তেলের দাম একবারে লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হলো?

জীবের হায়াত-মউতের কোনো ভরসা নেই। কয়েকদিন হলো কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার রবিউল গেরিলা হঠাৎই চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি রবিউল গেরিলাকে কদ্দুস নগরে পেয়েছিলাম। ওরা তিনজন একটি এলএমজি ও দুটি চাইনিজ কার্বাইন নিয়ে এসেছিল। তিনজনের দুজন যুদ্ধে অংশ নেয়নি, চলে গিয়েছিল। রবিউল গেরিলা থেকে যায়। যুদ্ধ তেমন দুর্দান্ত কিছু করতে না পারলেও রবিউল গেরিলার জন্য হানাদার বাহিনীও কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল। গেরিলা শুনতে শুনতে হানাদারদের মধ্যেও একটা গেরিলা ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল। সেটা খুবই কাজের কাজ হয়েছিল। স্বাধীন বাংলায় সে খুব একটা স্বস্তি পায়নি। একেবারে নিম্নবিত্তের মানুষ হিসেবে টানাপোড়নের মধ্যেই তাকে কাটাতে হয়েছে। আর্থিক সামর্থ্য কোনো দিনই হয়নি। অভাবের তাড়না নিয়েই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। অন্যদিকে আকুরটাকুর পাড়ার কহিনুর ফরায়জী হঠাৎই সেদিন চলে গেছে। মারা যাওয়ার আগের রাতেও সে সবার সঙ্গে স্বাভাবিক চলাফেরা করেছে। আমি অসুস্থ হওয়ার পর ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। তাই আগের দিন বিকালবেলায় ফোন করেছিল, দেখতে আসবে। বলেছিলাম, আরও এক সপ্তাহ যাক। সে এক সপ্তাহ আর হলো না। না-ফেরার দেশে চলে গেল। কহিনুরের জানাজায় অনেক লোক হয়েছিল। কুলি-মজুর, এমপি, মেয়র, নেতা সবাই শরিক হয়েছিলেন। এমপি ছোট মণি, বড় মণি, মেয়র সিরাজুল ইসলাম, আজাদ, মুরাদ, মিরন কেউ বাদ ছিল না। সেজন্য বলছি, হায়াত-মউতের কথা কিছুই বলা যায় না, এক নিঃশ্বাসেরও ভরসা নেই। আল্লাহ ওদের বেহেশতবাসী করুন।

বড় চিন্তা হয় দেশে কখন কী হয়। বঙ্গবন্ধু যে সময় নিহত হলেন সে সময়টাও ছিল এমন থমথমে। নানা দিকে নানান কথা শোনা যাচ্ছিল। কোনো বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে মারতে পারে এটা আমাদের ধারণার মধ্যেই ছিল না। তখন নিরাপত্তার তেমন বেড়াজাল ছিল না। দেশের মানুষও এখনকার মতো অত বেশি অমানবিক ছিল না। তার পরও হঠাৎই সেই অবিশ্বাস্য কারবালার পুনরাবৃত্তি ঘটে ধানমন্ডির ৩২-এ। দেশে এমনিতেই মারাত্মক অস্বস্তি। করোনা সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। করোনা নিয়ে কখনো সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যখন সারা দেশে লকডাউন, কঠিন লকডাউন এসব করা হচ্ছিল আর মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছিল। লকডাউনে রাস্তাঘাটে মানুষের সে যে কী কষ্ট হয়েছিল হৃদয়হীন অনেকেই তা উপলব্ধি করেননি। শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে হাজার হাজার মানুষ পারাপারে কী যে কষ্ট করেছে তা বলার মতো নয়। সেই লকডাউনে সরকার অনেক জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। যেদিন থেকে লকডাউন শিথিল করা হয়, এমনকি একপর্যায়ে তুলে নেওয়া হয় আল্লাহর মহান কুদরতে সেদিন থেকেই মৃত্যু হার কমতে থাকে। কমতে কমতে এক সংখ্যায় এসে গেছে। কবে যেন দেখলাম এক দিনে একজনের মৃত্যু। এখন চার-পাঁচ-ছয়-সাত জন মারা যাচ্ছেন। যেটা বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর চাইতে অনেক কম। আমাদের সাবধান থাকতে হবে, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে। সাধারণ নিরীহ মানুষ তারা যতটা রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-তুফান মোকাবিলা করে তাতে করোনা আমাদের সামনে খুব একটা বড় সমস্যা হওয়ার কথা নয়, ইনশা আল্লাহ হবেও না।

হঠাৎই ডিজেল-কেরোসিনের দাম একেবারে ১৫ টাকা বাড়ানো হলো। ১৫ টাকা বাড়িয়ে এখন হয়েছে ৮০ টাকা। ১৯৬৯-৭০ সালেও ডিজেলের দাম ছিল ১ টাকা গ্যালন, পেট্রোল ৪ টাকা। প্রায় ৫ লিটারে এক গ্যালন। এখন গ্যালন নয়, লিটারের দাম ৮০ টাকা। তার মানে স্বাধীনতার আগের ১ টাকার ডিজেল এখন ৪০০ টাকা। মানুষের উপার্জন কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি। সবকিছুরই একটা আইন-কানুন-নিয়ম থাকে। ডিজেল, পেট্রোলের দাম বাড়ানো-কমানোরও একটা নিয়ন-কানুন আছে। ডিজেল-পেট্রোলের দাম এক পয়সা বাড়াতেও জনমত যাচাইয়ের কথা, মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার কথা। কিন্তু তার কিছুই করা হয়নি। মনে হয় সরকারও এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কথা ভালো করে জানত না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশে তখনই হুট করে ডিজেল-কেরোসিনের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হলো। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে ডিজেল-পেট্রোলের দাম কমানো হলো, আমাদের দেশে বাড়ানো হলো। ভারতে তেলের দাম আমাদের চাইতে বেশি তাই বাংলাদেশ থেকে ভারতে চোরাচালান হয়। ঝিনুক দিয়ে যদি সমুদ্র সেচা যেত তাহলে পৃথিবীতে আর সমুদ্রের অস্তিত্ব থাকত না। বলা হয়, ভারতে আমাদের দেশ থেকে তেল পাচার হয়। ঘটিতে করে ২-৪ লিটার তেল যদি সীমান্তের ওপারে যায়ও তার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। ভাত খেতে দু-চারটা ভাত বাইরে পড়বেই। সেদিন আবার শুনলাম, স্থলবন্দরে যেসব ভারতীয় ট্রাক মালপত্র নিয়ে আসে তারা বিপুল পরিমাণে তেল নিয়ে যায়। একটা রাষ্ট্র আরেকটা রাষ্ট্রের আদান-প্রদান হবেই। ভারতীয় ট্রাক তাদের মালপত্র নামিয়ে খালি ট্যাংকি ভরে নিয়ে যায় এটা কোনো চুরি নয়, পাচারও নয়। এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এতে অর্থনীতির ওপর কখনো তেমন চাপ পড়ে না। ভারতীয় গাড়ি আমাদের পাড়ে এলে আমাদের থেকে যেমনি তেল নেয়, আমাদের গাড়ি ভারতে গেলেও ঠিক তেমনি তেল নেয়। যতকাল আদান-প্রদান থাকবে ততকালই এ ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু একবারে তেলের দাম ১৫ টাকা বৃদ্ধি করায় বাস-ট্রাক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন বাস-ট্রাকের অস্বাভাবিক ভাড়া বেড়েছে। সাধারণ মানুষের কোনো উপার্জন বাড়েনি। যাত্রীদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। সরকার ও সরকারি দল এতে অপ্রিয় হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, সরকারের মধ্যেই তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে অসন্তোষ, দলের মধ্যেই অসন্তোষ। তাহলে কি সরকারের মধ্যে আরও দু-একটা সরকার আছে? সরকারের ভিতরে কোনো গোষ্ঠী কি সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে অপ্রিয় করার ষড়যন্ত্র করছে? বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রতিদিন সরকারের ক্ষতি হচ্ছে। চাটুকারের জ্বালায় প্রধানমন্ত্রী হয়তো তা-ও বুঝতে পারছেন না। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ায় যে পন্ডিতরা একবারে লিটারে ১৫ টাকা বাড়ালেন তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন গত ১০-১২ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম পানির মতো সস্তা ছিল, তখন তো দাম কমায়নি? এমনকি একসময় তেলের দাম ১৯৬৯-৭০ সালের মতো প্রতি ব্যারেলে ৯ ডলারে নেমে এসেছিল, তখন তো দাম কমায়নি? ধীরে ধীরে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বেশিসংখ্যক অযোগ্যরা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত। তারা চলতেও জানে না, চালাতেও জানে না। শুধু পরিচালনার অভাবে দেশ এখন হতাশায় নিমজ্জিত। নৈতিকতা, মানবতা ও দায়িত্ববোধের কোনো বালাই নেই। সামাজিক বাঁধন অনেকটাই আলগা হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো উৎসাহ নেই। দেশের মালিক জনগণ এ বোধটা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে বসেছে। যে কোনো মানুষকে জিজ্ঞাসা করলে তার থেকে জবাব আসে, আমরা কী করব? আমাদের কথা তো কেউ শোনে না। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের কি কোনো দাম আছে? এ রকম হতাশ জনগণ নিয়ে আর যা কিছুই হোক একটা দেশ বা জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতি আশা করা যায় না।

করোনার মধ্যেই ইউপি নির্বাচন হচ্ছে। এখন দেশে নির্বাচন তো নয়, অনেকটাই প্রহসন। এখানে ১৬ আনা নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা। অন্যদিকে সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া কলঙ্কমুক্ত নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত মানুষের মুখে হাসি ফুটবে না। দেশের মানুষ এক বেলা না খেয়ে থাকলে যতটা কষ্ট পায় ভোট দিতে না পেরে তার চেয়ে অনেক বেশি অসহায়বোধ করে। দেশের মানুষের মধ্যে উৎসাহ ফিরিয়ে আনতে হলে সবার আগে দরকার প্রভাবমুক্ত ভোটাধিকার প্রয়োগ। নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিলেই দেশের কাজে মানুষ সক্রিয় হয়ে উঠবে। সত্যিকার অর্থে এখন আর নির্বাচন হয় না, নৌকা পেলেই হলো। নৌকা হাজার ভোট পেলে প্রতিদ্ব›দ্বীরা পায় ৫-১০-৫০ ভোট। এই পাতানো নির্বাচন কারও জন্যই কল্যাণকর নয়। এসব নির্বাচনী প্রহসন করে বাইরের দুনিয়ায় আমাদের যারপরনাই বদনাম তো হচ্ছেই, দেশের মানুষও দেশপ্রেমে উদাসীন হতে চলেছে। দেশপ্রেম হচ্ছে একজন নাগরিকের জন্য সবচাইতে মূল্যবান। অল্প বয়সে যারা প্রেম করে, দেশপ্রেম তার চেয়ে বেশি থাকা দরকার। কিন্তু তা এখন নেই। দেশপ্রেম কাকে বলে এটাই অনেকে জানে না। দেশ সমাজ সম্পর্কে ভাবতে না পারলে, দেশ ও সমাজের ওপর সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য না থাকলে দেশপ্রেমও আসতে চায় না, দেশপ্রেমের ছোঁয়া অনেকেই পায় না। বিশেষ করে আগে রাজনীতির প্রতি, রাজনৈতিক কর্মীর প্রতি সাধারণ মানুষের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল, ভালোবাসা ছিল। এখন রাজনীতিবিমুখ জনসাধারণ দেশের কথা ভেবে উদ্বুদ্ধ হয় না। উদ্বুদ্ধ করার মানুষের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। এ অবস্থা কোনো সমাজের জন্য কোনো দেশের জন্য ভালো নয়। এই যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে সেখানে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অনেক জায়গায় জামানত হারাচ্ছে। অথচ অন্যান্য নির্বাচনে নৌকা পেলেই হলো। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তেমন হচ্ছে না। আমার মনে হয়, দেশকে সচল করতে হলে দেশের মানুষকে উদ্যমী করতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার কোনো মানে হয় না। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার কারণে গ্রাম পর্যন্ত রাজনৈতিক দলাদলি দানা বেঁধেছে। ঘরে ঘরে বিশৃঙ্খলা। শুধু স্থানীয় নির্বাচনকে দলীয় চেহারা দেওয়ার কারণে এতটা মারামারি-কাটাকাটি হচ্ছে। আমার মনে হয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এমনকি উপজেলা পর্যন্ত দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার কোনো মানে হয় না। সিটি করপোরেশন প্রয়োজনে উপজেলা পর্যন্ত দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও ছোট ছোট পৌরসভাগুলো এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অবাধ মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যদি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের মনোনয়ন দিতে হয় তাহলে সেটা তাঁর জন্য খুবই জটিল ব্যাপার। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব না থাকলে সত্যিকারের রাজনৈতিক নেতা ও ভালো সংগঠক হয় না। রাজনীতি যেখানে হওয়া উচিত বাধামুক্ত, সেখানে বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি চলছে। নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি কখনো কল্যাণকর নয়। এখন বেশিসংখ্যক নেতা-কর্মী কোনো আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করে না। দলের সঙ্গে যুক্ত হাইব্রিড নেতা-কর্মীরা সব সময় আখের গোছাতে ব্যস্ত। আখের গোছানো নেতা-কর্মী নিয়ে দুর্যোগের সময় রুখে দাঁড়ানো যায় না। এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শত শত মানুষ হতাহত হওয়ায় সরকারের নির্বাচন সম্পর্কে গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা উচিত। এমন ব্যর্থ অনুপযুক্ত নির্বাচন কমিশন পৃথিবী কখনো দেখেনি। লজ্জাশরমের বালাই থাকলে নির্বাচন কমিশনাররা ভোটে দুর্নীতি, অব্যবস্থার কথা নিজেরাই বলে তাদের পদে বহাল থাকতেন না। ইজ্জত থাকলে সম্মানবোধ থাকলে তারা নির্বাচনের সমালোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করতেন। নিজেরাই গণতন্ত্রকে আইসিইউতে পাঠিয়ে নির্বাচন কমিশনের পদ ধরে বসে থাকা বড় দৃষ্টিকটু দেখায়। কবে যে এদের বোধশক্তি জাগ্রত হবে ভেবে পাই না। যত তাড়াতাড়ি বোধশক্তি জাগবে ততই মঙ্গল।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর