বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মালালার বিয়ে

তসলিমা নাসরিন

মালালার বিয়ে

মালালার বিয়ে নিয়ে নানা মুনির নানা মত

১ . পাকিস্তানের আর সব সাধারণ মেয়ের মতোই মালালা ২৪ বছর বয়সে বিয়ে করেছে। এরপর আর সব মেয়ের মতোই হয়তো স্বামী সন্তান সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে সে। তার বর এক পাকিস্তানি লোক। পাকিস্তানের পুরুষেরা পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশে বড় হয়ে নারীর স্বাধীনতায় কতটা আর বিশ্বাস করবে যে মালালাকে তার মতো থাকতে দেবে, মেয়েদের শিক্ষার পক্ষে আন্দোলন করতে দেবে? মালালা তো সোয়াত ভ্যালির বালিকা মালালাই ছিল না, সে ছিল বিশ্বের কোটি বালিকার আইকন। বিশ্বের ১৩ কোটি মেয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা কী যেন তেন কোনও কাজ? সারাজীবন শান্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করার পর নোবেল শান্তি পুরস্কার জোটে, বা জোটা উচিত। কিন্তু মালালার মাথায় তালিবানের গুলি লেগেছিল বলে তাকে কাজের আগেই শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে জীবনের শুরুতে। গুলি খাওয়া কোনও অ্যাচিভমেন্ট নয়। তার তো শান্তি পুরস্কার যে কাজের জন্য দেওয়া হয়েছে, সেই কাজটি জীবনভর করা উচিত। বাসে তো সেদিন আরও মেয়ের গায়ে গুলি লেগেছিল, তারাও তো তালিবানদের আদেশ অমান্য করে ইস্কুলে যাচ্ছিল। সবাই তো মালালা হয়নি। যে যতই বলুক, মালালা স্বামী সন্তান সংসার করেও ১৩ কোটি মেয়ের শিক্ষার পক্ষে আন্দোলন করার গুরুদায়িত্বটি সম্পন্ন করবে, সম্ভব নয়। মহৎ কাজে নানা প্রলোভন, তুচ্ছ করে এগোতে হয়। মালালা সেটা পারেনি।

যে ছিল মেয়েদের শিক্ষার পক্ষে একটি আন্দোলন, তার তো অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি, ডক্টরেট ইত্যাদি অর্জন করা উচিত ছিল। মালালা তো মেয়েদের শিক্ষার কথাই বিশ্ব জুড়ে বলেছে। কট্টর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের বেশিদূর পড়তে দেওয়া হয় না, সেখানে সর্বোচ্চ শিক্ষা নিয়ে সে মেয়েদের প্রেরণা হতে পারতো। নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, স্বনির্ভর হয়ে মেয়েদের উৎসাহিত করতে পারতো। মালালা যে সুযোগ পেয়েছিল সে সুযোগ তো পৃথিবীর অধিকাংশ মেয়ে পায় না। সুযোগের সদব্যবহার সে করতে পারতো। কী শিখবে মেয়েরা এখন মালালার কাছ থেকে! মেয়েরা যে সমাজে বাল্য বিবাহের শিকার হয়, অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়, পরনির্ভর জীবন মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না- সেই সমাজকে বদলে দিতে পারতো মালালা, কিন্তু সে চেষ্টা কি সে করলো!

মালালা বলেছিল সে বিয়েতে বিশ্বাসী নয়, সে বুঝতেই পারে না মানুষ কেন বিয়ে করে। এ বিবৃতি দেওয়ার তিন মাস পরই সে বিয়ে করে বসলো। তাহলে তার কথার, চিন্তাভাবনার, বক্তব্যের কোনও ঠিক নেই। এমন আনপ্রেডিক্টেবল মানুষ পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় পুরস্কার জিতে বসে আছে। বিশ্বের সমস্ত বড় বড় মঞ্চে বক্তৃতা করেছে। এত সব পুরস্কারের জন্য, এত সব সম্মানের জন্য নিজেকে যোগ্য করা উচিত ছিল তার। গুলি খাওয়া কোনও যোগ্যতা নয়। শৈশব-কৈশোরে তাকে গাইড করেছে তার বাবা, বলে দিয়েছে কোথায় কী বলতে হবে। এরপর তাকে গাইড করছে আন্তর্জাতিক মালালা টিম। তার বই লেখা, ফান্ড তৈরী সবই তারাই করেছে। তার নিজের অর্জন কী? নিজের ইচ্ছেয়, নিজের চিন্তাভাবনায় কী করেছে? একটা লোককে বিয়ে করেছে!

আজকাল সচেতন মেয়েরা হয় বিয়ে করে না, নয় বিয়ে করলেও লেখাপড়া শেষ করে স্বনির্ভর হয়ে পাত্রর সঙ্গে দীর্ঘদিন মেলামেশার পর, পাত্রর স্বভাব চরিত্র আচার ব্যবহার ভালো করে জানার পর, পাত্র নারীর সমানাধিকারে শতভাগ বিশ্বাস করে বোঝার পর তিরিশের কোঠায় বয়স পৌঁছুলে তবেই বিয়ে করে।

মালালা কোনও সাধারণ সচেতন মেয়ের মতো কাজ করেনি। অনেকে বলে মালালা তার যা ইচ্ছে হয় সেটা করেছে, তা নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার কারওর নেই। মালালা যেহেতু পাবলিক ফিগার, তাই মালালার কাজ নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের কথা বলার অধিকার আছে।

২. মালালা বিয়ে করেছে, নিজের সিদ্ধান্তে। এতে কারও আপত্তি করার কিছু নেই। এমন নয় যে সে অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিয়ে করেছে, এমনও নয় যে তাকে জোর জবরদস্তি কেউ বিয়ে দিয়েছে। আসার মালিককে মালালা যোগ্য সঙ্গী বলেই মনে করছে। মালালা নিজেই বলেছে আসার তার সঠিক মূল্যায়ন করে, আসার তার রসিকতাগুলো বোঝে। মালালা যদি সুখী হয়, তাতে কেন আপত্তি করে মানুষ? মালালা বিয়ে করেই বুঝিয়ে দেবে মেয়েরা বিয়ে করলেই স্বামীর দাসীতে পরিণত হয় না। বিয়ে করেও যে সমানাধিকার নিয়ে, সম্মান নিয়ে বাঁচা যায়, তা বুঝিয়ে দেবে মালালা। সে বরং বিয়ে যে পজিটিভও হতে পারে তা প্রমাণ করবে। বিয়ে মানেই পণের দাবি, প্রভু-দাসীর সম্পর্ক, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স নয়- তা প্রমাণ করবে।

মালালা মেয়েদের শিক্ষার পক্ষে আন্দোলন করছে, তার মানে এই নয় যে জীবনের স্বাদ আহলাদ প্রেম ভালোবাসা সব ত্যাগ করে তাকে সন্ন্যাসী হতে হবে। সিম্বল হতে হলে জীবনের সব চাহিদা বিসর্জন দিতে হবে কেন? সঙ্গী যদি সাপোর্টিভ হয়, তাহলে কাজে উৎসাহ বাড়ে। মালালা বরং আরও চমৎকার কাজ করতে পারবে।

সে শান্তি পুরস্কার পেয়েছে বলে তাকে ব্যক্তিগত শান্তি বিসর্জন দিতে হবে কেন? যারা তা মনে করে, তাদের মস্তিষ্কে এখনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিবাহিত মহিলাদের ট্রাডিশানটি গাঁথা। মালালা পাকিস্তানের কোনও অজপাড়াগাঁয়ে বাস করছে না। সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, তা না হলে সে জীবনে এত অল্প বয়সে এত বিখ্যাত হতে পারতো না, এত দূর আসতে পারতো না। বুদ্ধিমতি মেয়েরা অযোগ্য কোনও লোককে বিয়ের জন্য বেছে নেয় না।

৩. মালালা বলেছিল, সে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চায়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে হলে যা যা করা দরকার মালালা তাই করছে। জনগণের সামনে মাথার কাপড় সরাচ্ছে না। বিয়ে করেছে পাকিস্তানের এক মুসলিমকে। যে কোনও স্থানে যে কোনও বক্তৃতাই মহান আল্লাহর নামে শুরু করছে। এতে পাকিস্তানের রক্ষণশীল ধর্মপ্রাণ লোকেরা তাকে পছন্দ করছে। হয়তো সে একদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবে। মালালার বাবারও এমনই স্বপ্ন।

ক্রিকেট পাকিস্তানের জনজীবনে খুব বড় আবেগের জায়গা। বুঝে শুনেই ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন লোককেই বিয়ে করেছে মালালা। ভারতের বিরুদ্ধে ক্রিকেটে জেতা পাকিস্তানিদের জন্য বিরাট ব্যাপার। সে কারণেই আসার এবং মালালা পাকিস্তানের বিজয়ের কেক কেটেছে। এও পাকিস্তানিদের মনে জায়গা করে নেওয়ার জন্য ভালো একটি বিষয়।

মালালা আর যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললেও কাশ্মীর থেকে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের বিতাড়নের বিরুদ্ধে কিছু বলে না। কারণ এতে পাকিস্তানিদের অখুশি হওয়ার আশংকা আছে।

মালালা যত না অ্যাকটিভিস্ট, তার চেয়ে বেশি রাজনীতিক।

৪. মালালা যদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়, সে পাকিস্তানের লাভ। পাকিস্তানকে একটি সভ্য দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সে সবরকম চেষ্টা করবে। নিজের আর লাভ কী ঝুঁকি ছাড়া? বেনজির ভুট্টো মাথার কাপড় না সরিয়েও প্রাণ হারিয়েছেন মৌলবাদিদের গুলিতে। মালালাকে তালিবানরা মেরে ফেলতে পারে। তারপরও মালালা পাকিস্তানের ভালোর জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছে। এ তার মহত্ত্ব।

৫. মালালা কোনও প্রগতিশীল মেয়ে নয়। সে ট্রাডিশান মেনে চলে। নারীবাদীদের মতো ট্রাডিশান ভাঙ্গে না। মাথায় কাপড় দেওয়া একটি নারীবিরোধী ট্রাডিশান। সভ্য দেশে বাস করেও মালালা এই ট্রাডিশান ভাঙেনি। মালালা যদি একাধিক সন্তান জন্ম দিয়ে আর সব ট্রাডিশানাল মেয়ের মতো সংসার ধর্মে ডুবে যায়, অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাকে বিখ্যাত বানিয়েছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো। মৌলবাদিদের দ্বারা প্রতিদিন মেয়েরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মেয়েদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হচ্ছে, আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, ফতোয়া দিয়ে জীবন নাশ করা হচ্ছে, একঘরে করা হচ্ছে, গ্রাম ছাড়া করা হচ্ছে, দেশ ছাড়া করা হচ্ছে, -কেউ সেকারণে বিখ্যাত হচ্ছে না। যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবাদ করছে মৌলবাদীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে, তাদের নামও কেউ জানে না। পুরুষতান্ত্রিক ট্রাডিশান আঁকড়ে রাখা ধর্ম আঁকড়ে রাখা একটি মেয়ের কাছে প্রত্যাশার কিছু নেই।

৬. আমার কথা : মালালা ২৪ বছর বয়সে বিয়ে করেছে। আমি কি অবাক হয়েছি ওর বিয়ে করাতে? হয়েছি। আমি আশা করিনি ও এত অল্প বয়সে বিয়ে করবে। অনেকে বলছে মালালা স্বনির্ভর হয়নি। কিন্তু এক শান্তি পুরস্কারই তো তাকে এক মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। মালালা ধনী মেয়ে। অর্থনৈতিক ভাবে খুবই স্বনির্ভর। অক্সফোর্ড থেকে গ্রাজুয়েশানও করেছে। অনেকে বলছে মালালা আরও পড়াশোনা করবে, মালালা যদি পড়াশোনা আর চালিয়ে না যায়, আমি অবাক হবো না। যদি কিছুদিন পর বোরখা পরে, অবাক হবো না। যদি স্বামীকে তালাকও দেয় কোনওদিন, তাতেও অবাক হবো না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর