শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বেকারের বিলাসী জীবন

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

বেকারের বিলাসী জীবন

এপার বাংলার অনেকেই ‘গরিবের ঘোড়ারোগ’ কথাটির সঙ্গে পরিচিত। সোজা কথায়- দরিদ্র ব্যক্তি যার সাধ্য নেই তবু ঘোড়ায় চড়ার ইচ্ছা প্রতিহত করতে না পেরে বিপদের সম্মুখীন হয়। প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষ তাঁর ‘মনের মানুষ’ ছবিতে দেখিয়েছেন বাউল সাধকে পরিণত হওয়ার আগে তরুণ এবং হতদরিদ্র লালনেরও ঘোড়ারোগ ছিল যার প্রভাবে সে একদিন তার জমিদার প্রভুর ঘোড়া নিয়ে পালিয়েছিল, যার জন্য তাকে সাজা পেতে হয়েছিল। কিন্তু ‘বেকারের ঘোড়ারোগ’ বলে কোনো কথা অন্তত বাংলা অভিধানে নেই; যদিও পৃথিবীতে বহু বেকার আছে যাদের ঘোড়ারোগ আরও বেশি জটিল। তবে পার্থক্য হলো বেকাররা কর্মহীন হলেও মোটেও গরিব নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রাচুর্য বহু ধনকুবের চেয়েও বেশি। এমনই এক ধনকুবের বেকারের নাম তারেক জিয়া, যিনি জেনারেল জিয়া এবং তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে।

জিয়াভক্তরা প্রায়ই বলে থাকেন জিয়া একটি ভাঙা স্যুটকেস এবং ছেঁড়া গেঞ্জি রেখে গিয়েছিলেন। অবিশ্বাস্য হলেও সেই ভাঙা স্যুটকেস থেকে তার ছেলেরা বের করছে  লাখ লাখ ডলার, যা সবার কাছেই দৃশ্যমান।

সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থ পাচার রোধের দায়িত্বে থাকা চারটি সংস্থা এই বেকার যুবকের জন্য ঢাকা এবং সিলেট থেকে প্রচুর টাকা পাচারের তথ্য পেয়ে তদন্তে নেমেছে। তারা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু প্রশ্ন হলো এত দিন তারা কী করল? বেকার তারেক জিয়া যে বিলেতের ধনাঢ্য পুঁজিপতির চেয়েও অধিকতর বিলাসী জীবন কাটাচ্ছে গত এক যুগের বেশি সময় ধরে তা তো তাদের না জানার কথা নয়। যেখানে বিলেতে তার কোনো চাকরি বা আয়ের ব্যবস্থা নেই সেখানে সে যে অসাধারণ বিলাসী জীবন কাটাচ্ছে তা থেকে তো এটা ধরে নেওয়াই স্বাভাবিক যে সে দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিলেতে নিচ্ছে। দেশের লোক মোটামুটি জানেন যে বিলেতে বেকার হলেও তারেক জিয়া বিলাসী জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু সে কত বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছে তা খুব বেশি মানুষের জানা নেই আর তা জানানোই এ লেখার উদ্দেশ্য।

বিলেতে বেশ কয়েক ধরনের বাড়ি আছে যেগুলোর মূল্য এবং ভাড়ার অঙ্ক নির্ভর করে বাড়ির ধরনের ওপর। সবচেয়ে কম খরচের বাড়ি হলো কাউন্সিল ফ্ল্যাট। তার ওপর রয়েছে টেরেসড বাড়ি, যাতে বাস করে নিম্নমধ্যবিত্তরা। তার ওপরে রয়েছে সেমি ডিটাচড যার একদিক উন্মুক্ত। যাতে বাস করে মধ্যবিত্তরা। বিত্তশালী লোকেরা বাস করে ডিটাচড বাড়িতে যার উভয় দিকে থাকে খোলা বাগান। ডিটাচড বাড়িতে তারাই বাস করতে পারে যারা সত্যিকার অর্থে বিলিয়নিয়ার। বিলেতে বসবাসরত খুব কম বাঙালিই ডিটাচড বাড়িতে বাস করেন। যারা এ ধরনের ব্যয়বহুল বাড়িতে বাস করে তারা হলো খুব সফল পেশাজীবী যেমন উঁচু অবস্থানের ডাক্তার, উঁচু আয়ের ব্যারিস্টার, সলিসিটার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট অথবা খুব ধনী ব্যবসায়ী কেননা এসব বাড়িতে যে অঙ্কের ভাড়া দিতে হয় তার ন্যূনতম হয়ে থাকে মাসে আমাদের দেশের হিসাবে লাখ লাখ টাকা। ডিটাচড বাড়ির মূল্য বা ভাড়াও সব এলাকায় এক নয়। বেশি অভিজাত এলাকায় যথা কিংস্টন, যেখানে তারেক জিয়া থাকে, সেখানের ভাড়া আরও বেশি। বিলেতে বিনা পয়সার স্কুল রয়েছে সরকার পরিচালিত। এমনকি বহু ধনী লোকের সন্তানরাও সে স্কুলে পড়ে। আরও রয়েছে গ্রামার স্কুল ও পাবলিক স্কুল। শেষের দুটিতে পড়তে ফি দিতে হয়। গ্রামার স্কুলের ফি কিছুটা কম আর প্রাইভেটের ফি প্রচুর। বছরে আমাদের টাকার হিসাবে ন্যূনপক্ষে ৩০ লাখ।

তারেক জিয়া তার মেয়ে জাইমাকে আগাগোড়াই পাবলিক স্কুলে পড়িয়েছে এবং পরে ব্যারিস্টারি পড়তে তার প্রতি বছর শুধু ফি দিতে হয়েছে ১২ লাখ টাকা। তারেক জিয়ার বিশাল বাগানসহ ডিটাচড বাড়িতে মালী, বাবুর্চি, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, দারোয়ান, নিরাপত্তাকর্মীসহ কমবেশি ১০ জন কর্মী রয়েছে যাদের বিলেতি হিসেবেই বেতন দিতে হয়। এর ওপর রয়েছে তার গাড়ির খরচ, তেল খরচ ইত্যাদি। তারেক জিয়া স্ত্রী-সন্তানসহ থাকে কিংস্টন আপন থেইমস নামক এক অভিজাত উচ্চবিত্তদের এলাকার গলফ ড্রাইভ নামক সড়কে, হোয়াইট চেজ নামক দেখার মতো এক রাজকীয় ডিটাচড ব্যয়বহুল বাড়িতে। বাড়িতে রয়েছে বেশ কজন গৃহকর্মী। তার মেয়ে সম্প্রতি ব্যারিস্টার হয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে প্রতি বছর টিউশন ফি বাবদই দিতে হয়েছে কয়েক হাজার পাউন্ড। বিলেতে রয়েছে সরকারি স্কুল যেখানে বেতন দিতে হয় না। আর রয়েছে প্রাইভেট স্কুল যেখানে প্রচুর টাকা বেতন দিতে হয়। সে দেশের বিরাটসংখ্যক লোক সরকারি স্কুলেই পড়ে, এমনকি বহু এমপি-মন্ত্রীর সন্তানরাও। তবে অতি উচ্চবিত্তরা সন্তানদের পাঠান প্রাইভেট স্কুলে মোটা বেতন দিয়ে। আর একটু কম বেতনের স্কুলের নাম গ্রামার স্কুল। তারেক রহমান তার মেয়েকে মেরি মাউন্ট নামক প্রাইভেট স্কুলে মোটা বেতন দিয়ে পড়িয়েছিল। কোকোর বিধবা স্ত্রীও থাকে একই এলাকায় আরও একটি ডিটাচড বাড়িতে Wontford Close নামের সড়কে। তার দুই মেয়েও পড়ে কম্বি গার্লস নামক উঁচু বেতনের প্রাইভেট স্কুলে। তারেক জিয়া বিলেতে সম্পূর্ণ বেকার এক ব্যক্তি যার কোনো দৃশ্যমান উপার্জন নেই। বিলেতে অবশ্য বেকাররা রাষ্ট্রের ভাতা পায়; কিন্তু সে ভাতার অঙ্ক ততটুকু যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কোনোক্রমে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট, বিলাসী জীবনের জন্য ভাতা দেওয়া হয় না, প্রাইভেট স্কুলের খরচও দেওয়া হয় না। সোজা কথায় তারেক জিয়া লন্ডনে একজন ব্রিটিশ লর্ডের মতোই বিলাসবহুল জীবনযাপন করে। আমি যখন প্রবাসী ছিলাম তখন উঁচুপদে উচ্চ বেতনে কর্মরত ছিলাম। আমার স্ত্রীও শিক্ষিকা হিসেবে ভালোই বেতন পেতেন। আমি বেশ কিছু সময় লন্ডনের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক ‘জনমত’ পত্রিকার একক মালিক ছিলাম। তা ছাড়া একাধিক বাড়ির মালিক হিসেবে আমি বাড়ি ভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয় সত্ত্বেও আমার দুই মেয়েকে প্রাইভেট স্কুলে পড়ানোর কথা না ভেবে পড়িয়েছিলাম আরও কম খরচের গ্রামার স্কুলে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বেকার তারেক জিয়া কীভাবে এত বিলাসী জীবন যাপন করছে। এটি তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিলেতে তাকে পাচার করে অর্থ পাঠানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে যারা বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করেছে তাদের তালিকা বেশ দীর্ঘ, পাচার করা অর্থের পরিমাণও আকাশচুম্বী। জাতি একসময় তা জানবে আশা করি। এর একটি অংশ ফেরত পাওয়া যেতে পারে আন্তর্জাতিক সহায়তার ভিত্তিতে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কখন? আর এক প্রশ্ন এ চলমান পাচার প্রক্রিয়া বন্ধ হবে কি না। ১৯৪৭ বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া একটি পয়সাও বিদেশে পাঠানো যায় না। শুধু বিদেশ ভ্রমণকালে বছরে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ডলার সঙ্গে করে নেওয়া যায়। আর একই কারণে বাংলাদেশ থেকে এর বেশি টাকা নিলে সংশ্লিষ্ট দেশে পাচারকারীকে অর্থ পাচার আইনে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। অর্থাৎ উভয় দেশেই এটা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই টাকা সাধারণত এমন দেশ যথা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় পাঠানো হয় যেখানে বিদেশি মুদ্রার ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। পাচার রোধে সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ববান না হলে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। সম্প্রতি মহামান্য হাই কোর্ট বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তারাই অনেককে বেআইনি কাজে সহায়তা করছেন। শর্ষেই যদি ভূত থাকে তাহলে ভূত কীভাবে তাড়ানো হবে?

বিলেতে আরও দুটি কঠোর আইন রয়েছে যার একটি হলো ‘প্রফিট অব ক্রাইম অ্যাক্ট’ যে আইনে কোনো ব্যক্তি অপরাধে জড়িত হয়ে কোনো অর্থ উপার্জন করলে তার সমুদয় অর্থ বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। আরেকটি আইন হলো ‘আনডিসক্লজড ওয়েলথ অ্যাক্ট’। সে আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি দৃশ্যমান উপার্জন ছাড়া কোনো সম্পত্তির মালিক হয় তাহলে তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। তারেক জিয়া নিশ্চয় এ দুটি আইনেই অপরাধী। কিন্তু এগুলো তো ব্রিটিশ সরকারকে জানাতে হবে, আর এটি জানাবে কে? তা ছাড়া বাংলাদেশের মানুষেরও জানা উচিত এই বেকার যুবক কীভাবে এত বিলাসী জীবন কাটাচ্ছে?

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর