শিরোনাম
শনিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বীপে

শাইখ সিরাজ

সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বীপে

নতুন দ্বীপ জেগে ওঠা মানেই নতুন সম্ভাবনার জাগরণ। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে যখন ভূমিধস কিংবা নিমজ্জিত ভূমির পরিমাণ বাড়ছে তখন আশার আলো নিয়ে বঙ্গোপসাগর ও উপকূলবর্তী বিভিন্ন নদ-নদীতে বছরে গড়ে প্রায় ১৬ বর্গকিলোমিটারের বেশি নতুন ভূমি জেগে উঠছে। গবেষকদের দেওয়া তথ্যমতে প্রতি বছর নদী ভাঙন ও ভূমিধসের কারণে যে পরিমাণ ভূমি বিলীন হয় তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ভূমি জেগে ওঠে। নতুন যুক্ত হওয়া ভূমির পরিমাণ নিছক কম নয়। নতুন ভূমি আমাদের দেশের মূল ভূখণ্ডের ১০ ভাগের ১ ভাগেরও বেশি। পরিসংখ্যান বলছে উপকূলজুড়ে আনুমানিক ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের নতুন ভূমি জেগে উঠেছে। ধারণা করা হচ্ছে নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার একর নতুন ভূমি জাগছে। জাগছে নতুন দ্বীপ। এসব জেগে ওঠা ভূমি নিয়েই জনবহুল বাংলাদেশের মানুষের মনে জাগে নতুন স্বপ্ন। অনেকেই বলে জেগে উঠছে আরেক নতুন বাংলাদেশ।

গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিকে এমন এক দ্বীপ জেগে ওঠে মেঘনার মোহনায়, বঙ্গোপসাগরে। জানা যায়, ১৯৯২-৯৬ সালের দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী জাহাজ নোয়াখালীর সুবর্ণচর হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলাচল করত। সে সময় ওই চরে আটকে পড়ে একটি বিশাল জাহাজ। পরে সে চর মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে ‘জাহাইজ্যার চর’ নামে। দুর্গম জাহাইজ্যার চর একসময় হয়ে ওঠে জলদস্যু ও চরমপন্থিদের অভয়ারণ্য। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ চরকে ডাকাতমুক্ত করে। পরে এর নতুন নামকরণ হয় ‘স্বর্ণদ্বীপ’। দ্বীপটিকে বসবাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে।

১০ নভেম্বর সকালে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে স্বর্ণদ্বীপ ভ্রমণের সুযোগ হয় আমার। ২০১৩ থেকে ২০২১- মাত্র আট বছর। এ সময়ের মধ্যে বিশাল লবণাক্ত চরভূমিতে একে একে নানামুখী সম্ভাবনার বীজ বপন করা হয়েছে। চলছে কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের সম্ভাবনাগুলো গভীরভাবে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। স্বর্ণদ্বীপের আয়তনকে বলা যায় একটি উপজেলার আকার। কিন্তু সন্দ্বীপ উপজেলার আকার বিবেচনা করলে এ স্বর্ণদ্বীপ কমবেশি তার চার গুণের সমান। অনেকেই বলেন সিঙ্গাপুরের সমান। সিঙ্গাপুরের আয়তন ৭২৮ বর্গকিলোমিটার আর স্বর্ণদ্বীপের বর্তমান আয়তন ৫০০ বর্গকিলোমিটার। সকালের রোদে চকচক করছিল স্বর্ণদ্বীপ। একদিকে ধু-ধু প্রান্তর আর দিকে দীঘল নোনাঝাউয়ের ঝাড়ভ মাঝখানে সেনাবাহিনীর খুব গোছানো এক আয়োজন। নানাভাবেই সমৃদ্ধ করার চেষ্টা চলছে এ দ্বীপকে। গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন নতুন অবকাঠামো। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের এ যাবৎকালের কার্যক্রমের একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা উপস্থাপন করা হলো। সেখানে বহু কাজ ইতিমধ্যে করা হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে- পরিকল্পিত বনায়ন, সাইক্লোন শেল্টার, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, নারকেলবাগান, ঝাউবাগান, গরু, মহিষ, ভেড়া, হাঁস, মুরগি ও কবুতরের খামার। এখানে ফলছে সবজিবাগান, ধানসহ নানা ধরনের শস্য। ২১টি খামার বা বাথানে রয়েছে কয়েক শ মহিষ। রয়েছে ভেড়া ও গরুর খামার। এসব খামার থেকে উৎপাদিত দুধ সংগ্রহ করে দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করতে একটি কারখানাও স্থাপিত হয়েছে। সমতলভূমির এ দ্বীপে অনেক পুকুর কেটে মাছ চাষ করা হচ্ছে। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপে নৌপথে চলাচলের জন্য সেনাবাহিনী নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করেছে তিনটি ট্রলার। এ ছাড়া চলছে নানামুখী অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। সেই সঙ্গে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তীব্র লবণাক্ত ও ভাঙনপ্রবণ এ দ্বীপের বিভিন্ন সম্ভাবনা বারবার করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমাদের দেশি জাতের মহিষ পালনের সম্ভাব্যতা ও সংকটের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে মহিষের অধিক লাভজনক মুররা জাতের বংশবৃদ্ধি ও লালনপালনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি উঠে এসেছে নানা চ্যালেঞ্জের কথাও। বিশেষ করে লবণাক্ততার হার বৃদ্ধি ও ভাঙনে চরের আয়তন দিন দিন কমে আসার বিষয়। কৃষি কার্যক্রমের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে সেনাপ্রধান ও অন্যান্য সেনা কর্মকর্তার সামনে আমার পক্ষ থেকেও চেষ্টা করেছি উপস্থিত কিছু মতামত তুলে ধরতে। যেহেতু বছরের আট মাস লবণাক্ত পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে স্বর্ণদ্বীপের মাটি, সুতরাং মাটির লবণাক্ততা কাটানো খুব কঠিন। এর মধ্যে যে ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে সেটাই বিস্ময়কর। লবণসহিষ্ণু অনেক ফসলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে এই সময়ে। ধানের পাশাপাশি পরীক্ষামূলকভাবে সূর্যমুখী, ভুট্টা ও সয়াবিন চাষ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতিমধ্যে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে এসব ফসলের লবণসহিষ্ণু জাতের চাষ করে সফল হয়েছে। হয়তো মূল ভূখণ্ডের উৎপাদনের হারের তুলনায় এখানে উৎপাদনের হার কম হবে, তবে সেটাও লাভজনক হবে বলে আশা করা যায়। দেশি জাতের মহিষের পাশাপাশি মুররা জাতের মহিষ লালনপালন করা যেতে পারে। এ জাত খুব জনপ্রিয়। ভারতের কোনো কোনো এলাকায় একে ‘কালো সোনা’ও বলা হয়। ভেড়ার পাশাপাশি গাড়ল লালনপালন করা যেতে পারে। কেননা গাড়লের জীবনীশক্তি বেশি এবং খাদ্য খরচ তুলনামূলক কম। শসা বা তরমুজ চাষও করা যেতে পারে। নোয়াখালীর হাতিয়া, সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জের উপকূল এলাকায় লবণাক্ত মাটিতে সর্জন পদ্ধতিতে চাষাবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সর্জন পদ্ধতি মূলত ইন্দোনেশিয়ার একটি চাষাবাদ প্রক্রিয়া। বর্ষার আগে লবণাক্ত জমি থেকে মাটি তুলে উঁচু করে আড়া তৈরি করা হয়। তার ওপর মাচা তৈরি করে তাতে করলা, শসা, বরবটি, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, মিষ্টিকুমড়া ও লাউ চাষ করা হয়।

মাছ চাষের ক্ষেত্রে কীভাবে কম খাদ্য খরচে বেশি উৎপাদন সম্ভব তা ভাবতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে খামারিরা ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই চাষ করে খাদ্য খরচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। সেটিও পরীক্ষামূলকভাবে এখানে প্রয়োগ করা যেতে পারে। উপকূলে কেইস পদ্ধতিতে কোরালসহ নানান সামুদ্রিক মাছের চাষ হতে পারে। চাষ করা যেতে পারে ঝিনুকও। বাইরের দেশে এসবের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। স্পিরুলিনাসহ নানান জাতের সামুদ্রিক শৈবাল চাষের সম্ভাবনাও রয়েছে। এ বিস্তর এলাকাকে গড়ে তোলা যেতে পারে যান্ত্রিক কৃষির অনন্য ক্ষেত্র হিসেবেও। সারা বিশ্বে এখন অর্গানিক কৃষিপণ্যের ব্যাপক চাহিদা। এখানে গ্রিনহাউসে অর্গানিক কৃষিপণ্য উৎপাদন করে ব্র্যান্ডিং করা গেলে যেমন নিরাপদ খাদ্যের সংস্থান হবে, বিশাল একটা তৈরি বাজারও দখল করা সম্ভব হবে।

যা হোক, সেনাপ্রধানের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখা হলো প্রাণবৈচিত্র্যহীন স্বর্ণদ্বীপে একে একে নেওয়া উদ্যোগগুলো। দ্বীপের একাংশে বেশ সৌন্দর্য নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে নারকেলবাগান। খাটো জাতের নারকেলের বাগানটির বয়স চার বছর। বাগান ঘুরে দেখতে দেখতে কথা হচ্ছিল সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। জানালেন, ফসল কৃষি থেকে শুরু করে প্রাণিসম্পদের নানান উপকরণ-উপাদান নিয়ে এখানে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। লবণাক্ততাই এখানকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে যে ফসল চাষ বা প্রাণিসম্পদ লালনপালন লাভজনক হয়ে উঠবে সেটিই বড় আকারে শুরু করা হবে। শুধু স্বর্ণদ্বীপেই নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘এক ইঞ্চি জমিও পতিত না রাখার আহ্বান’ মাথায় রেখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের জমিকে কাজে লাগিয়ে দেশের মোট কৃষি উৎপাদনে সামান্য হলেও অবদান রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বড় আশার কথা।

নারকেলবাগান থেকে গেলাম মাছের খামারে। পুকুরে জাল ফেলে তোলা হলো বিশাল আকারের রুই, কাতলা এমনকি কোরাল মাছও। পুকুরের এক পাশে হাঁসের খামার। শত শত হাঁস পানিতে নেমে সাঁতার কাটছে। এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। রয়েছে কবুতরের খামার। আকাশে শত শত কবুতরের পাখা ঝাপটার শব্দ। সবখানে এ চরকে প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর করে তোলার ক্ষেত্রে সেনা সদস্যদের নিরন্তর প্রয়াসের নজির। এক পাশে মহিষের খামার। চলছে মুররা জাত নিয়ে গবেষণা। ঘুরতে ঘুরতে আমরা পৌঁছে গেলাম স্বর্ণদ্বীপের ধান খেতে। পরীক্ষামূলক আবাদ স্থানীয় জাতের ধান। এরই মধ্যে কয়েকবার ফসল উঠেছে। বোঝা যায়, মাটি দিনে দিনে প্রস্তুত হচ্ছে প্রধান খাদ্যশস্য আবাদের জন্য। ধান কাটছিলেন একদল কৃষিশ্রমিক। যাদের আছে দেশের নানান জায়গায় ধান চাষের অভিজ্ঞতা। তারা জানালেন ধানের ফলন অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কম হয় না। বিশেষ করে ধানে চিটা নেই। দেখলাম স্বর্ণদ্বীপের একটা অংশ সোনালি হয়ে আছে পাকা ধানে।

এভাবেই স্বপ্নের এক নতুন পথরেখা নির্মাণের প্রয়াস চলছে স্বর্ণদ্বীপে। বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ। তার একটি হচ্ছে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ও আধুনিক সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা। এর জন্যও প্রয়োজন হবে প্রাণবৈচিত্র্যের প্রসার ঘটানো। বঙ্গোপসাগরের বিপুল সম্পদ আমাদের সামনে মেলে ধরেছে সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা। আর বঙ্গোপসাগর উপকূলের বিভিন্ন নদ-নদীর অসংখ্য চরও সে সম্ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। প্রতিটি চরেরই রয়েছে আলাদা গল্প। আলাদা ইতিহাস। নদীর এক কূল ভেঙে আরেক কূল জেগে ওঠার সম্ভাবনা জড়িয়ে আছে এগুলোর সঙ্গে। নিয়মিতই জেগে উঠছে চর। সেগুলোর আকারের তুলনায় স্বর্ণদ্বীপের সুবিশাল আকার আমাদের স্বপ্নকে দৃঢ় করে। এ দ্বীপ গড়ে উঠুক সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের নতুন রূপ নিয়ে- এই প্রত্যাশা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর