শনিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

গণতন্ত্রের সার্চ কমিটি কোথায়?

অ্যাডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী

গণতন্ত্রের সার্চ কমিটি কোথায়?

বাংলাদেশে একটি নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও আগামী সংসদ নির্বাচনের এখনো দুই বছরের বেশি সময় হাতে রয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ফলে এক ধরনের সাংবিধানিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণেই বর্তমান সরকারকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গেই ভাবতে হচ্ছে। দেশে নির্বাচনব্যবস্থা যখন এক ধরনের তামাশায় পরিণত হয়েছে, যখন ভোটাররা আর কেন্দ্রে যেতে চান না এবং বিশ্বাস করেন যে ভোটার কেন্দ্রে উপস্থিত না থাকলেও গায়েবি শক্তি সেই ভোটখানা বাক্সে ঢুকিয়ে গোটা দেশের গণতন্ত্রকেই গায়েব করে দেবে; এমনই এক পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পক্ষ থেকে এ নিয়ে নানা বিবৃতি দিতে হচ্ছে। সরকারি দল বলছে, ইসি গঠনে আইন পরে হবে। এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমেই হবে নির্বাচন। বিরোধী দলগুলো বলছে, এখনই সংসদে আইন পাস করে ইসি গঠনের আইন প্রণয়ন করা হোক এবং সে অনুযায়ী ইসি গঠন করা হোক। এ নিয়ে দুই পক্ষের তর্কের সুরাহা এবারের নির্বাচনের আগে সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদন খারিজ করে দিয়েছে হাই কোর্ট। ৩১ অক্টোবর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। সুতরাং ইসি গঠনের আইন যে এবার প্রণীত হচ্ছে না এ বিষয়টি বেশ স্পষ্ট। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪ অক্টোবর গণভবনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সার্চ কমিটি করেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। মানুষের আস্থা-বিশ্বাস নিয়েই আওয়ামী লীগ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে চায়। নির্বাচনকে নির্বাচনের মতো করেই দেখে দলটি। এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচনে কোন দল প্রতিযোগিতা করবে সে বিষয়ে ভাবে না আওয়ামী লীগ। আদর্শগতভাবে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই আশা করে যে কোনো রাজনৈতিক দল। এর আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রাষ্ট্রপতি সবার সঙ্গে আলোচনা করে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকলে নির্বাচনও নিরপেক্ষ থাকবে।

শাসক দলের এসব মন ভোলানো বিবৃতি যে এক ধরনের নেতিবাচক রাজনৈতিক কৌশল তা বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেহারা থেকেই ভোটারদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি অতিসম্প্রতি দেশের ইউপি নির্বাচনসমূহে ব্যাপক অনিয়ম, প্রশাসনিক কারসাজি, নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব, অন্যায় হস্তক্ষেপ এবং সর্বোপরি এ নির্বাচন ঘিরে দেশজুড়ে মারাত্মক সহিংসতা সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের মনকে ভোটব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন জনগণের জন্য উৎসাহের বদলে এক ভয়ানক প্রাণঘাতী ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে ঠাণ্ডা মাথায় ধ্বংস করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে জনগণের আস্থাহীন এবং কার্যত একটি ক্ষমতাহীন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে লুটপাটতন্ত্রের রাজনীতিকে এক ধরনের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ দেওয়ার জন্য। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে আসছে ফেব্রুয়ারি। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় দরকার হবে নতুন কমিশন গঠনের। নতুন কমিশনের অধীনেই হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের এখনো তিন মাসের বেশি সময় অবশিষ্ট থাকলেও রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। নতুন কমিশন গঠনের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে কিছু প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সেসব প্রক্রিয়া শুধু বাগাড়ম্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সবাই জানেন, সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের নিয়োগকর্তা রাষ্ট্রপতি।

যে সার্চ কমিটির কথা এখন বলা হচ্ছে সে ধরনের সার্চ কমিটির সুপারিশের মাধ্যমেই বিগত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। ওই দুটি কমিশন নিয়োগের আগে রাষ্ট্রপতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে দুটি সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। ওই দুটি সার্চ কমিটির সুপারিশে গঠিত হয়েছিল রকিবউদ্দিন কমিশন ও নূরুল হুদা কমিশন। সেসব কমিশনের সক্ষমতা ও ব্যর্থতা আজ দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট। তা ছাড়া সার্চ কমিটি নিয়েও মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে। সে কারণে আজ দাবি উঠেছে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি স্থায়ী আইন প্রণয়নের। বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ করা হলেও সে আইনটি এখনো হয়নি। ইতিপূর্বের ক্ষমতাসীন দলগুলো মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও এ রকম একটি আইন প্রণয়নে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। যদিও বর্তমান আইনমন্ত্রী এখন বলছেন, ‘হয়তো বা সার্চ কমিটি গেজেটেড, এটা আইন নয়, যেহেতু সবার কনসেনসাসের ভিত্তিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এটা করেছেন, এটা আইনের কাছাকাছি। কারণ, এটা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে।’ আইনমন্ত্রীর এসব কথায় সংকটের সমাধান হবে না। সংকট সমাধানে অপেক্ষাকৃত পরিপক্ব সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ ভারতের নির্বাচন কমিশনের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালে কেয়ারটেকার সরকারের রাষ্ট্র চালানোর সুযোগ নেই। তবে চলমান সরকারের নির্বাচনকালে কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব সীমিত করে বিরোধীদের সরকারে শরিক করার সুযোগ আছে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে কী উপায়ে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন এ দেশে হবে এবং একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে জনগণের সংগ্রাম বা গণঅভ্যুত্থানের পথই তার জবাব দেবে।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ।   

সর্বশেষ খবর