সোমবার, ২২ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীকে উপেক্ষা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীকে উপেক্ষা

ক্যালেন্ডারের পাতার একটি স্মরণীয় মাস নভেম্বর। এ মাসের দুটি দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ দেশ এবং গোটা বিশ্বের কাছে। ১৪ নভেম্বর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর জন্মদিন। আর ১৯ নভেম্বর তারই সুযোগ্য কন্যা, দেশের আরেক উল্লেখযোগ্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন। এ দুটি দিন এতটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ স্বাধীন ভারতের অগ্রগতিতে এই দুজনের ভূমিকা অবিস্মরণীয় তো বটেই, পাশাপাশি সারা বিশ্বেই রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাদের প্রভাব অত্যন্ত গভীর।

দেশনেতা হিসেবে পণ্ডিত নেহরু যে উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, স্বাধীনতা-উত্তর পূর্বেও সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে তিনি সরে আসেননি। স্বাধীনতার আগে থেকেই তিনি দেশের মূল সদস্যাগুলোর দিকে নজর দিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন এদেশের প্রধান সমস্যা হলো ক্ষুধা ও দারিদ্র্য, অপরিচ্ছন্নতা ও নিরক্ষরতা, কুসংস্কার ও বিভিন্ন কুপ্রথা, বিপুল সম্পদের অপচয় ও অসম বণ্টন ইত্যাদি। এসব সমস্যা দূর করতে তিনি হাতিয়ার করতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানকে। তিনি জানতেন, বিজ্ঞান দুভাবে মানবজীবনকে উন্নত করতে পারে। প্রথমত, বিজ্ঞানের অগ্রগতি, অর্থাৎ নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তার ব্যবহারিক প্রয়োগ মানুষের জীবনকে প্রত্যক্ষভাবে উন্নত ও সহজ করে। আর দ্বিতীয়ত, (যেটিকে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন পণ্ডিত নেহরু), বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি, বিজ্ঞানের মানসিকতার। তার ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে তিনি এ বিষয়ে বিশদ লিখেছেন। তার আক্ষেপ ছিল, ‘শুনতে পাই, আমরা বিজ্ঞানের যুগে বাস করি, কিন্তু দেশের জনসাধারণ বা তাদের নেতাদের মধ্যেও বিজ্ঞানসম্মত মানসিকতার কোনো লক্ষণ দেখতে পাই না।’

বিজ্ঞানের প্রতি তার এতটাই ভরসা ও অনুরাগ ছিল যে, ড. মেঘনাদ সাহা একবার তাকে সংসদে প্রচুর বিরোধিতামূলক কথা বলার পরেও তিনি ড. সাহাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। সেই সাক্ষাতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অধিকাংশ সময়ই তিনি ড. সাহার সঙ্গে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেন, পদার্থবিদ্যার নানা বিষয়ে জানতে চান। এমনই ছিল পণ্ডিত নেহরুর বিজ্ঞানপ্রীতি ও বিজ্ঞানমনস্কতা, একজন পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও। দেশের নানা সমস্যা দূরীকরণে তিনি যেমন সচেষ্ট ছিলেন, একই সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলেন, জাতি-ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদ ও বিভাজন দেশের সর্বনাশ করছে এবং ভবিষ্যতে আরও করবে। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। একবার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ সোমনাথ মন্দির দর্শনের জন্য তার কর্মসূচি পাঠান প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। নেহরু তা দেখেই স্পষ্ট ভাষায় ড. রাজেন্দ্র প্রসাদকে লেখেন- ‘আপনি হলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের রক্ষক। আপনি বিশেষ কোনো ধর্মের উপাসনাস্থলে যেতে পারেন না। আপনি যদি মন্দির দর্শন করতেই চান, ভারতবর্ষের আধুনিক মন্দির দর্শন করুন, যেসব মন্দির ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে- যেমন ভাকরানাঙ্গাল বাঁধ, দামোদর ভ্যালি করপোরেশনসহ বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্প, লৌহ-ইস্পাত প্রকল্প ইত্যাদি। এই চিঠি পাওয়ার পর ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ তার সোমনাথ মন্দির দর্শনের কর্মসূচি বাতিল করেন। এমনই ছিল পণ্ডিত নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতা।

জওহরলাল নেহরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীও (যাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘প্রিয়দর্শিনী’ নাম দিয়েছিলেন) রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। পিতার মতোই তিনিও দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে বিজ্ঞানের ওপর জোর দিয়েছিলেন। এ ছাড়া দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষতা যে অত্যন্ত জরুরি, বুঝেছিলেন তাও। সে জন্যই তিনিও জাত-পাতের বিরোধিতায়, ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করেছেন। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অবিচল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী তথা ভারত সরকারের অবদান ও ভূমিকার কথা এখনো বহু আলোচিত। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্দিরা গান্ধীকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সমর্থন দেওয়ায় ইন্দিরা পাকিস্তান, আমেরিকা, চীনের মতো দেশগুলোর বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তবুও তিনি নিজের মত ও পথ থেকে সরেননি।

দেশের অভ্যন্তরে তিনি প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। বহু শিল্প স্থাপন, বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্প, ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, সবুজ বিপ্লব, শ্বেতবিপ্লবসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছেন। বিশ্বের দরবারে ভারতের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছিলেন। বিশ্বকে ভাবতে শিখিয়েছিলেন, ভারতকে তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলে অবহেলা করা চলবে না। ভারত নিজের বলেই বলীয়ান। পরমাণু শক্তি এবং মহাকাশ বিজ্ঞানেও তাঁর আমলে ভারত প্রভূত উন্নতি করেছিল। বস্তুত, তিনি এদেশকে বিশ্বের মহাশক্তিধর দেশগুলোর পাশে একটি বিশিষ্ট আসনে বসাতে সমর্থ হয়েছিলেন। এবার দেখা যাক, আধুনিক ভারতের রূপকার এই দুই রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি কেমন শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে, বর্তমান রাজনৈতিক প্রজন্ম। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর প্রয়াণের পরের বছর। ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে তার জন্মদিনটি প্রথম পালিত হয় ‘শিশু দিবস’ হিসেবে। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রি। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নেহরুর জন্মদিনটি ঘোষিত হবে ‘শিশু দিবস’ হিসেবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওইদিন জওহরলাল নেহরু সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের বলা হবে। জানানো হবে নেহরুর জীবন ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে। সেই থেকে সারা দেশে ১৪ নভেম্বর একটি বিশেষ দিন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে দেশের সরকারও যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়ে এসেছে বরাবর। কিন্তু ২০১৪ সালে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এ দিনটি তার প্রাপ্য গুরুত্ব হারিয়েছে। পণ্ডিত নেহরুও ব্রাত্য হয়েছেন সরকারিভাবে। এমনকি টিভি চ্যানেলগুলোও এ দিনটি নিয়ে আর তেমন কিছু করছে না। ব্যতিক্রম শুধু দুটি ইংরেজি চ্যানেল- এনডিটিভি এবং ইন্ডিয়া টুডে। তারা কিন্তু যথাযোগ্য মর্যাদায় নেহরুর জন্মদিনটিকে নিয়ে কভার করেছে। শুধু কেন্দ্রীয় সরকারই নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারও দিনটির ব্যাপারে উদাসীন, হয়তোবা ইচ্ছাকৃতভাবেই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ১৪ নভেম্বর নিজের ছবিসহ শিশু দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন শিশুদের। কিন্তু কোথাও নেহরুর নামগন্ধ নেই। অর্থাৎ আজকের শিশুরা জানতেই পারবে না শিশু দিবসের তাৎপর্য, চিনতেই পারবে না পণ্ডিত নেহরুকে।

জওহরলাল কন্যা ইন্দিরার জন্মদিন ও প্রয়াণ দিন সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন। সারা বিশ্বে তোলপাড় পড়ে যায় এই ঘটনায়। ভারতীয় রাজনীতি উথাল-পাথাল হয়ে যায়। ইন্দিরা হত্যার রেশ এদেশের রাজনীতি থেকে আজও পুরোপুরি যায়নি। অথচ এমন একটি দিনকেই ভুলিয়ে দিতে চাইছে ভারতের বর্তমান সরকার। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার ‘কংগ্রেসমুক্ত দেশ’ গড়তে চেয়ে ১৪ নভেম্বরের পাশাপাশি এ দিনটিকে এবং একই সঙ্গে ১৯ নভেম্বরকেও (ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন) মানুষের মন থেকে মুছে দিতে চাইছে। বঙ্গেশ্বরীও একই কাজ করছেন, নিজে একজন সাবেক কংগ্রেসী হয়েও। কারণ তিনি নিজেই এখন দেশের ক্ষমতার শীর্ষে বসার জন্য মরিয়া। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছেন নিজেকে, তাই প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের আর গুরুত্ব দিতে চাইছেন না। বর্তমান ভারতের মূল্যবোধহীন রাজনীতির আর একটি উদাহরণ সম্প্রতি পাওয়া গেল। বিজেপি-আরএসএস ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় বলতে শুরু করেছেন, দেশ ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়নি, হয়েছে ২০১৪-এর মে মাসে, অর্থাৎ বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর। এদের কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য আর দেশের ইতিহাসকে অস্বীকার করার এই প্রবণতা দেশকে কোন অতল গহ্বরে নিয়ে যাবে, তা সময়ই বলবে।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর