শিরোনাম
শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

নারীস্বাস্থ্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম

নারীস্বাস্থ্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

‘তোমার ঠিকানা কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে ৩২ নম্বর ধানমন্ডি, পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ৩ লক্ষাধিক নারী যাঁরা তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়ে আমাদের হাতে লাল-সবুজের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন তাঁদের অসহায় আর্তনাদে জাতির পিতা তাঁদের নিজের বুকের মধ্যে তুলে নিয়েছিলেন এবং তাঁদের উদ্দেশেই বলেছিলেন এ কথাগুলো। তাঁদের বেশির ভাগেরই কোথাও যাওয়ার অবস্থা ছিল না। অনেকেই অদক্ষ দাই দ্বারা গর্ভপাত ঘটিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন, দ্রুত তাঁদের থাকার জন্য বঙ্গবন্ধু ‘সেবা সদন’ তৈরির নির্দেশ এবং উন্নত চিকিৎসা প্রদানের আদেশ দেন। তাঁদের পুনর্বাসনের কথা চিন্তা করে ‘কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন’ সংস্থা তৈরি করা হয়। সামাজিক সংগঠনের অনেকের সঙ্গেই প্রসূতি চিকিৎসাবিদরাও সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন, অনেকেই সরাসরি তাঁদের চিকিৎসার ভার নিয়েছেন। ১৯৭২ সালে সেই সময়ে International Planned Parenthood, The International Abortion Research of Training Centers, Catholic Center তাঁদের সঙ্গে সহায়তা করেছিল। কাজ করেছিলেন আমাদের পূর্বসূরি প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, প্রফেসর ডা. কাজী জোহরা, ডা. মেহেরুন নেসা, অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম, অধ্যাপক লতিফা শামসুদ্দিন এবং আরও অনেকে। তখনই তাঁরা অনুভব করেন নারীস্বাস্থ্যের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রসূতিবিদদের একটা সংগঠন করা দরকার এবং নিজেরা মিলে অবসট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের দৃষ্টিকোণ প্রসারিত করতে উদ্বুদ্ধ করেন। কীভাবে একজন অসহায় মাকে তাঁর জীবনীশক্তি ফিরিয়ে দেওয়ার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে সেই মন্ত্র শেখান। তখন তৃণমূল থেকে শহর পর্যন্ত কীভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নিয়ে আসতে হবে সেই দিকনির্দেশনা দিয়ে তৈরি করেন স্বাস্থ্য অবকাঠামো। তারই আলোকে আজ তৃণমূলে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব সেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল এবং শহরেরও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অঙ্গনে বিশাল একটা লিঙ্ক তৈরি করেন। নারীস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় আরেকটি বিষয় পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা গ্রহণ। তিনি সে সময় তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমাদের জায়গা সীমিত। এ সীমিত জায়গায় যদি বছরে এই পরিমাণ সন্তান জন্ম নেয় তাহলে আগামী অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা আর আমাদের জন্য ফসল ফলাবার জমিই পাব না।’ তাঁর লক্ষ্যেই  তৈরি হয় পরিবার পরিকল্পনার অবকাঠামো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীস্বাস্থ্যের খোঁজ নিয়ে কীভাবে মা-শিশুর খোঁজ করতে হবে সে নির্দেশনাও তিনি দেন এবং তৈরি হয় পরিবার পরিকল্পনা স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়। গ্রাম পর্যায়ে ক্যাম্প করে Vasectomy, Tubectomy পদ্ধতি দেওয়া হয়েছে এবং সে সময় বাংলাদেশে একটা উৎসবের মতো করে সে কাজগুলো করা হয়েছে। নারীস্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি মাতৃস্বাস্থ্য-সেবা সেটি খুবই অবহেলিত ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি বলতে কেউ অভ্যস্ত ছিল না। সবাই মনে করত সন্তান জন্ম আদিকাল থেকেই চলে আসছে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ কোনো আওতায় পড়ে না বা কেউ এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও মনে করেননি। কিন্তু তিনিই প্রথম কমিউনিটি ক্লিনিকের কথা চিন্তা করেছিলেন যেখানে তৃণমূলের সবাই সাধারণ যে কোনো চিকিৎসাসেবা পাবেন এবং এরই সঙ্গে লিঙ্ক করে বিশেষায়িত ব্যবস্থা যেন গ্রহণ করতে পারেন সেজন্য ধাপে ধাপে স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরির জন্য অনুমোদন দিয়েছিলেন। আজকে তাঁরই চিন্তার সঙ্গে মিল রেখে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূল পর্যন্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা জোরদারের লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকেও স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্মদানের ব্যবস্থা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। আজকে সারা দেশে প্রসবঘরকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করার জন্য আমরাও সরকারের হাত ধরে প্রসবঘরটি কেমন হবে সেই লক্ষ্যে লেবার রুম প্রটোকল ২০১৭ সালে অনুমোদন লাভ করেছে এবং বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উচ্চ লেভেলেও যেটিকে বিশেষায়িত করার জন্য সরকারের সঙ্গে কাজ হচ্ছে। ইতিমধ্যে লেবার রুমটিকে বিশেষভাবে তৈরি করা, তার মধ্যে জীবন রক্ষাকারী সব ধরনের ওষুধ নিশ্চিত করা, লেবার রুমের ইনচার্জ হিসেবে মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিতেই ২০১২ সালে শুরু মিডওয়াইফারি প্রোগ্রাম। কারণ তিনি চিন্তা করেছিলেন তৃণমূল পর্যন্ত নারীস্বাস্থ্য-সেবা প্রসার করতে হলে মিডওয়াইফারির বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সব উপজেলা, জেলা পর্যায়ে লেবার রুমে ফ্রিজের ব্যবস্থা করা হয়েছে, কারণ ডেলিভারির সময় মায়ের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে ‘রক্তক্ষরণ’। প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ রোধের জন্য যে ওষুধটি খুবই প্রয়োজন তার তাপমাত্রা ঠিক না থাকায় এটি কার্যকর হচ্ছিল না। সে কারণেই এটি যাতে ফ্রিজের মধ্যে রেখে তাপমাত্রা ঠিক করা যায় তার জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরই সঙ্গে কীভাবে মাতৃমৃত্যু রোধ, রক্তক্ষরণ বন্ধ এবং খিঁচুনি প্রতিরোধসহ সব বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়, প্রশিক্ষণের কাজও চলছে। নারীস্বাস্থ্যের প্রথম আরেকটি জরুরি বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। তা হলো বাল্যবিয়ে বন্ধ করা। আইন অনুযায়ী ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে করা নিষিদ্ধ; কিন্তু এখনো বেশির ভাগ বিয়েই সম্পন্ন হচ্ছে ১৮ বছরের আগে এবং ১৫ বছরের আগেও প্রায় ১৮% বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু আইন দিয়ে সম্ভব হয় না, সেজন্য মানসিক পরিবর্তনের প্রয়োজন। তৃণমূল থেকেই সচেতনতা বাড়ানোর কাজটি শক্তভাবে না করলে কোনোভাবেই এটি বন্ধ করা যাবে না। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধকারীও গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থ্যার অবকাঠামো একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবস্থা, যা বঙ্গবন্ধু করেছিলেন এবং একে আরও শক্তিশালী করছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সবচেয়ে দুর্বল দিকটি হচ্ছে মানবসম্পদ। কোনো ক্ষেত্রেই লোকবল যেটুকু থাকার দরকার তা নেই। ২৪/৭ (সাত দিনে ২৪ ঘণ্টা) সেবা দিতে হলে যে পরিমাণ মানবসম্পদ থাকা দরকার তার ঘাটতি দ্রুত পূরণ না করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যাবে না। এ লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন কী পরিমাণ মানবসম্পদ কোথায় দরকার সে ব্যাপারে একটি তালিকা তৈরির। ইতিমধ্যে তা তৈরি হয়ে কাজ চলছে। মাতৃস্বাস্থ্য-সেবা সঠিকভাবে করতে হলে যে কটি দিকে খেয়াল রাখতে হবে তার মধ্যে হলো মানসম্মত সেবা প্রদান, ২৪/৭ সেবা নিশ্চিত করা এবং সঠিক প্রণিধানযোগ্য চিকিৎসা প্রদান (Evidence base care)।

লেখক : প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান (প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিভাগ), হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, প্রাক্তন সভাপতি, ওজিএসবি।

সর্বশেষ খবর