রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধান অন্তরায়

অধ্যাপক অরূপরতন চৌধুরী

তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধান অন্তরায়

জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় হুমকি ‘তামাক’। সস্তা মূল্য, সহজলভ্যতা, তামাক কোম্পানির প্রলুব্ধকরণ কার্যক্রমসহ নানা কারণে দেশের জনগণের মধ্যে তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের বিদ্যমান হার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে (ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের রোগ ইত্যাদি) আক্রান্ত হয়ে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে যা দেশে মোট মৃত্যুর ১৩.৬%। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তামাকের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা, ওই বছরে যা ছিল জিডিপির ১.৪ শতাংশ!

দেশে অন্যতম বড় সামাজিক সমস্যা মাদকাসক্তির মূল অনুঘটক ‘তামাক’। গবেষণায় দেখা যায়, মাদকাসক্তের ৯৫ ভাগই ধূমপায়ী অর্থাৎ ধূমপান দিয়েই তারা নেশার জগতে পা বাড়ায়। তামাকের ক্ষয়ক্ষতি থেকে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তামাক নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আন্দোলনটি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে। বিগত দিনে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, বিধিমালা প্রণয়ন, জনগণের মধ্যে তামাকবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যা চলমান রয়েছে। এখন দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ‘ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো’য় সরকার ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১০% শেয়ার রয়েছে। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ-বিধ্বংসী পণ্যের ব্যবসায় সরকারের অংশীদারির বিষয়টি অনেকেই সরকারের দ্বৈতনীতি হিসেবে দেখছেন। কারণ তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশ সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এফসিটিসিতে স্বাক্ষরের পর তামাক নিয়ন্ত্রণে আমাদের সাফল্যের ঝুড়িতে বেশ কিছু অর্জন রয়েছে। বর্তমান সরকারপ্রধান তামাক নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত ইতিবাচক। এ অবস্থায় তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার এবং নিরুৎসাহ/ ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবসা থেকে লভ্যাংশ গ্রহণ তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাকে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে একটি ‘রোডম্যাপ’ প্রণয়নের কাজ তিন বছরের অধিক সময় ধরে চলমান রয়েছে। জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনটিসিপি) প্রণয়নের বিষয়টিও আলোচনায় আছে অনেক দিন যাবৎ। এ ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরও কিছু নীতি যেমন তামাক চাষ নীতি, এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়নে ‘গাইডলাইন’ প্রণয়নের কাজ চলমান বলে জানা গেছে। কিন্তু এ নীতিগুলো কবে নাগাদ চূড়ান্ত হবে তা নিয়ে সন্দিহান দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের কর্মীরা। কারণ বিএটিবিতে সামান্য শেয়ার থাকায় সরকারের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তাকে বিএটিবি পরিচালনা পর্ষদে প্রতিনিধিত্ব করতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা জনস্বার্থের পাশাপাশি তামাক কোম্পানির স্বার্থ সিদ্ধির বিষয়টি খুব ভালোভাবে দেখবেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানির লাভের পাল্লাটাই ভারী হয়ে থাকে। সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচির আড়ালে তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে। এর ফলে জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন/তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত বা দুর্বল হয়ে পড়ে।

শিশু-কিশোর-তরুণদের ধূমপানে আসক্ত করতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন (বিশেষ করে তামাক পণ্যের কৌশলী বিজ্ঞাপন, প্রচার ও সামাজিক দায়বদ্ধতামূূলক কাজ) তামাক কোম্পানির ব্যবসা প্রসারের প্রধান হাতিয়ার। আইনের কার্যকর প্রয়োগের অভাব ও তামাক কোম্পানিতে সরকারি শেয়ার বিদ্যমান থাকায় তা অনেকাংশে ঠেকানো যাচ্ছে না। যদিও সরকার-প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও প্রশাসন যথেষ্ট আন্তরিক। এ ক্ষেত্রে জেলা/ উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটিগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।

সরকার একদিকে তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহ করছে, অন্যদিকে এসব পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে উৎসাহিত করছে। এও এক ধরনের দ্বৈতনীতি। সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কার’ প্রদানের ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিকে অযোগ্য ঘোষণা করা হলেও এ বছর আবারও তামাক কোম্পানিকেই পুরস্কৃত করা হয়েছে! এ ক্ষেত্রেও তামাক কোম্পানির প্রভাব সুস্পষ্ট এবং এখানেও ‘গরু মেরে জুতা দান’-এর উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।

‘স্থানীয় সরকার বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকা’ বর্তমানে তামাক নিয়ন্ত্রণ কমিউনিটিতে বেশ আলোচিত। বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্য বিক্রয়, বিপণন নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই বিধায় যেখানে-সেখানে এ পণ্যগুলো পাওয়া যায়। স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে ২০১৮ সালে প্রণীত এ নীতিতে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে ‘লাইসেন্সিং’ ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং স্কুল-কলেজের আশপাশে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধের বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ নীতিটি প্রয়োগেও বাধা সৃষ্টি করছে তামাক কোম্পানিগুলো। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে সংশোধনের কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জের অর্থে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ প্রণয়নের কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। এ কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলে তামাক নিয়ন্ত্রণে ভালো ফল বয়ে আনতে পারে। তবে তামাক কোম্পানি যাতে এখানে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেহেতু এফসিটিসি এ ক্ষেত্রে সহায়ক সেহেতু এফসিটিসির আর্টিক্যাল ৫.৩ অনুসারে একটি ‘গাইডলাইন’ প্রণয়নও জরুরি হয়ে পড়েছে এবং এটি সময়ের দাবি। সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার ও তাদের পরিচালনা পর্ষদে সরকারি প্রতিনিধিত্ব তামাক নিয়ন্ত্রণে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)

সর্বশেষ খবর