বৃহস্পতিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

নানা ভাবনা

তসলিমা নাসরিন

নানা ভাবনা

১. জাতীয় সঙ্গীত অনেক দেশের শুনেছি। সবচেয়ে জঘন্য বোধহয় ফ্রান্সের জাতীয় সঙ্গীত। আমাদের সৈন্যরা আসছে, তোদের গলা কাটবে, তোদের ছেলেদের গলা কাটবে, রক্তে ভাসাবে সব। এই ধরনের লিরিক। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর জাতীয় সঙ্গীত। কোনো ঘৃণা নেই, রক্তপাত নেই, প্রতিহিংসা নেই। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। শুরু থেকে শেষ অবধি ভালোবাসার কথা। দেশটির গা গতরে যাই থাক, এর জাতীয় সঙ্গীতটি কী চমৎকার ভালোবাসা বিলোচ্ছে। দুর্ভাগা বাঙালির আর কিছু না থাক, গৌরব করার মতো একটি জাতীয় সঙ্গীত আছে।

২. করোনা কোথায় বিদেয় নেবে, তা না, ধারালো দাঁত নখ নিয়ে আবার আসছে কামড়ে খামচে সর্বনাশ করতে। নতুন ভ্যারিয়েন্টের ভালো নাম বি ওয়ান ওয়ান পাঁচশ ঊনত্রিশ, ডাক নাম ওমিক্রন। ভ্যাক্সিন নাকি একে দমাতে পারে না, আগেরগুলোর চেয়ে এ বেশি সংক্রামক, বেশি ভয়ঙ্কর।

এসব আর কাহাতক সহ্য হয়।

করোনা বাহান্ন লাখের চেয়ে বেশি মানুষের জীবন নিয়েছে। এ যেন যথেষ্ট নয়। তার আরও চাই।

বেঁচে থাকাগুলো দিন দিন নড়বড়ে হয়ে উঠছে আরও।

৩. এই কভিডের সময় চারদিকে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। কেন? মানুষের ভিড় হবে, করোনা ছড়াবে। এত ঝুঁকি নিতে হচ্ছে! ভ্যাক্সিন আসার পর, ভয়াবহ ভাইরাসের সংক্রমণ কমার পর বিয়েশাদি করলে চলে না?

-না চলে না।

-কেন চলে না?

-বিয়ে তো সব ঋতুতে হয় না, কিছু নির্দিষ্ট ঋতুতেই হয়।

-কেন নির্দিষ্ট ঋতুতেই হতে হবে? যে কোনও সময় বিয়ে করলে অসুবিধেটা কী?

- অসুবিধে আছে। বিয়ে যেন অমঙ্গল বয়ে আনতে না পারে, তা তো দেখতে হবে।

-এ আবার কেমন কুসংস্কার?

-শ্রাবণে বিবাহে মৃতবৎসা, ভাদ্রে বিবাহে বেশ্যাযোগ, আশ্বিনে বিবাহে মৃত্যুযোগ, কার্তিকে বিবাহে রোগাক্রান্ত হওয়ার আশংকা, পৌষে বিবাহে আচার ভ্রষ্টা তথা স্বামী বিয়োগিনী হওয়ার সম্ভাবনা, চৈত্র মাসে বিয়ে হলে কন্যার মদন উন্মত্ত হয় অর্থাৎ কামভাবে জর্জরিত হয়, যেটা কারও শরীরের পক্ষে আদৌ মঙ্গলজনক নয়? তাই এ ঋতুগুলো বিবাহের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন আমাদের সমাজপতি শাস্ত্রজ্ঞ আদিপুরুষেরা। বাকি থাকলো বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, অগ্রহায়ণ, মাঘ ও ফাল্গুন। এর মধ্যে জ্যৈষ্ঠ মাসে আবার জ্যেষ্ঠ সন্তান সে পুত্র বা কন্যা যাই হোক তার বিবাহ শুভ নয়। প্রাচীনকালের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী নিজের জন্মমাসে বিয়ে করাও ঠিক নয়। প্রাচীনকালে বিশ্বাস ছিল জন্মমাসে বিবাহ করলে পাত্র-পাত্রী মহাদুঃখে পতিত হন। আবার বঙ্গদেশে বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত চলে প্রবল ঝড়-বাদল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সুতরাং, বিবাহের জন্য উপযুক্ত ঋতু অবশিষ্ট থাকল অগ্রহায়ণ, মাঘ ও ফাল্গুন। আবার এই তিন ঋতুই যথারীতি শীতকাল।

-শিক্ষিত লোকেরাও মানে এসব?

-আলবৎ মানে।

-যারা প্রগতিশীল, যারা ধর্ম মানে না, তারাও মানে?

-তারাও মানে।

৪. মুনাওয়ার ফারুকি নামে এক ভারতীয় স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানের বারোটা শো ক্যান্সেল হয়েছে গত দুমাসে। টিকিট বিক্রি হয়ে গেলেও থিয়েটারের লোকেরা বলে দিয়েছেন ভাঙচুরের থ্রেট পাচ্ছেন তাঁরা, সুতরাং শো ক্যান্সেল। এত শো ক্যান্সেল হচ্ছে বলে ফারুকি বলে দিয়েছেন গুড বাই, আই অ্যাম ডান, ঘৃণার জয় হলো, শিল্পী হেরে গেলো। তিনি নাকি আর শো করবেন না। তিনি কেমন কমেডি করেন দেখার জন্য ইউটিউব ঘেঁটে পেলাম বেশ ক’টি ভিডিও। একটিই দেখলাম। ইয়ং ছেলে, এখনও আড়ষ্টতা আছে, খুব বড় অডিয়েন্স নেই। সেই ভিডিওতে তিনি মুসলমানদের বহু বিবাহ, বোরখা ইত্যাদি নিয়ে বেশ মক করেছেন। তো থ্রেট কোত্থেকে আসছে? কট্টর মুসলিম মোল্লাদের থেকে? না, কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের থেকে। রিয়্যালি? ওরাও কি মোল্লাদের মতো কথা পছন্দ না হলে হামলা করে? ভালো কোনও উত্তর পেলাম না।

শুনলাম মুনাওয়ার ফারুকি গোধরা কান্ড নিয়ে মক করেছিলেন। কমেডিয়ানের কাজই তো মক করা। মুনাওয়ার বলেছিলেন তিনি যখন ৯/১০ বছর বয়সী বালক, টেলিভিশনে খবরে দেখছিলেন, একটি ট্রেন আগুনে জ্বলছে। আচমকা তাঁর বাবা টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কেন বন্ধ করেছেন জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেছিলেন, হিন্দুদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। মুনাওয়ার জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা শুনে ঘাবড়ে গেলেন, দুঃখ পেলেন, তারপর বাবাকে বললেন, কিন্তু হিন্দুদের তো মৃত্যুর পর পোড়ানো হয়! ব্যস, কট্টর হিন্দুরা ভীষণ ক্ষিপ্ত, বলছে, ৫৯ জন পুণ্যার্থী হিন্দুকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছে মুসলমানেরা, আর তা নিয়ে মশকরা হচ্ছে! মক করার কারণে মুনাওয়ারকে এক মাস জেল খাটতে হয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে কমেডি শো করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। ফারুকি অবশ্য বলছেন ‘এ সবই হচ্ছে যে মকটি আমি আদৌ করিনি সেটির জন্য।’ তাহলে কি গোধরা কান্ড নিয়ে তিনি যা বলেছেন তা মক করার উদ্দেশে বলেননি!

আমার প্রিয় স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান জর্জ কারলিন। তিনি তো ধর্মকে ধুয়ে দিয়েছেন। তাতে তাঁকে টোকাটিও মারেনি কেউ। আমরা কি ভালো করে জানি না ধর্মের ধ-ও ক্রিটিক্যালি উচ্চারণ করলে কী হয় এই উপমহাদেশে? কত প্রাণ চলে গেল। আমারও তো বেঁচে থাকার কথা ছিল না। এখনও যে বেঁচে আছি এ তো একরকম মিরাক্যাল।

৫. আমরা খুব অল্প সময়ের জন্য পৃথিবীতে আসি। গ্রহ নক্ষত্রের মতো আয়ু আমাদের নেই। বোধ বুদ্ধি অভিজ্ঞতা ইত্যাদি একটু একটু করে বাড়তে থাকে, এমন সময়ই আমাদের চলে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। কেউ আগে যায়, কেউ পরে যায়, কিন্তু যায়। আমাদের বেঁচে থাকার সময়ে বেশ কিছু মুহূর্ত পাই আমরা। জীবনের সম্পদ সেই মুহূর্তগুলো। জীবনকে অর্থপূর্ণ করে যেতে পারি অনেকেই। যার যার নিজের মতো করে অর্থপূর্ণ। আমি কিছু বই লিখেছি, যে বইগুলো, কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে আমি গিয়েছি, যে ঘটনাগুলো-আমার জীবনের মুহূর্ত বা সম্পদ। সবই কালের স্রোতে ভেসে যায়, কিন্তু যতদিন মস্তিষ্ক সতেজ, ততদিন সেই মস্তিষ্ক সুখ দিয়ে যায়, জীবনকে অর্থপূর্ণ করার সুখ।

৬. বাংলাদেশের এক মন্ত্রী আমেরিকার এক বাঙালির বাড়িতে ২৩ পদে সাজানো টেবিলে বসে খাচ্ছিলেন। ছবিটি ফেসবুকে দেখে আমি বেশ পুলকিত। ঘটা করে জানিয়েও দিয়েছি সবাইকে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত লোকেরা কাউকে নেমন্তন্ন করলে এরকম কুড়ি পঁচিশ পদ খাবার রান্না করে। রান্নাটা আর্ট, খাওয়ানোটাও আর্ট। নেমন্তন্ন অবশ্য ‘বাড়িতে একটু ডাল ভাত খাবেন’ বলে করা হয়।

আমিও ব্যতিক্রম নই। আমিও মানুষকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে বেশ খাওয়াই। কুড়ি পদ না হলেও উনিশ পদ তো হয়ই। কিছু হাড়কিপ্টে সে খাবার খেতে খেতে বলে, ‘বাংলাদেশের মেয়ে, ও তো খাওয়াবেই, ওরা এমনই, মানুষকে খুব খাওয়ায়।’ খাওয়ানোটাকে আমার কালচার আখ্যা দিয়ে দিব্যি খেয়ে উঠে যায়। যেন খাওয়াচ্ছি, এ আমার কালচার বলে, যেন এই কালচারের চর্চাটা না করলে আমার আর চলছিল না। তাই খেয়ে আমাকে তারা ধন্য করলো। কোনও দিন তারা কিন্তু আমাকে নেমন্তন্ন করে না। আমি তারপর থেকে বলি, ‘বাংলাদেশের সবাই খাওয়ায় না। যাদের হৃদয় বড়, তারাই খাওয়ায়। এ শুধু বাংলাদেশে নয়। দুনিয়ার সবখানেই একই চিত্র, যাদের হৃদয় বড়, তারাই খাওয়ায়, বা অন্যের জন্য কিছু করে। হৃদয় ছোট মানুষ পৃথিবীর সব জায়গায় আছে, বাংলাদেশেও আছে, তারা কাউকে খাওয়ায় না, কারও জন্য কিছু করেও না।’

৭. খালেদা জিয়ার সরকার ১৯৯৪ সালে লোকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি এই অভিযোগ করে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল। আমার লেখা লজ্জা, উতল হাওয়া, ক, সেইসব অন্ধকার একে একে নিষিদ্ধ করেছিল। ছলে বলে কৌশলে আমাকে দেশ থেকে বের করেছিল। দেশে আর প্রবেশ করতে দেয়নি। এই খালেদা জিয়া আমার যত সর্বনাশ করেছেন, তত আর কেউ করেননি। তাঁর মতো নিষ্ঠুর, নির্মম, অবিবেচক, স্বার্থান্ধ, পাষাণ খুব কমই দেখেছি আমি।

তারপরও আমি চাই খালেদা জিয়াকে যদি বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে চান শুভাকাক্সক্ষীরা, নিয়ে যান। তারপরও আমি চাই তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। মানবতাবোধ থাকলে শত্রুর গায়ে টোকা লাগলেও আহা আহা করে মানুষ এগিয়ে আসে। তিনি মানুষ না হতে পারেন, আমি তো মানুষ।

৮. বাংলাদেশের বাঙালিদের পাকিস্তানের জার্সি পরা এমন কী আর দৃষ্টিকটু! তার চেয়ে বেশি দৃষ্টিকটু তো তাদের বাংলার চেয়ে অন্য ভাষাকে বেশি ভালোবাসা, বাংলা সংস্কৃতির চেয়ে অন্য সংস্কৃতিকে বেশি ভালোবাসা, বাংলার পোশাকের চেয়ে একটি বিশেষ দেশের পোশাককে বেশি ভালোবাসা। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের খেলার চেয়ে পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের খেলা পছন্দ করে তারা। পছন্দ করতেই পারে। অনেকে যদিও মনে করে পাকিস্তানের জার্সিতে লেগে আছে তিরিশ লক্ষ বাঙালির রক্ত। কে জানে, হয়তো ওই রক্তকেই ওরা ভালোবাসে।

বাঙালিকে গত চল্লিশ বছর যাবৎ বাঙালি শাসকরাই ধর্মান্ধ, মূর্খ, অশিক্ষিত, অচেতন, অজ্ঞান, অপদার্থ বানিয়েছে, আর এখন যদি তাদের কাছে দাবি করা হয় যে এককালের মুসলমান-শত্রুদের তোমরা শত্রু ভাববে আর অমুসলমান-বন্ধুদের তোমরা বন্ধু ভাববে-তাহলে এ নিশ্চিত যে তারা তা ভাববে না। আমরা বারবার ভুলে যাই যে সময় বদলে গেছে, উম্মাহ এসে গেছে, জিহাদ শুরু হয়ে গেছে। ভুলে যাই জিহাদের সমর্থক নতুন প্রজন্মের একটা বিরাট অংশ।

৯. মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা যারা ষাট-সত্তর দশকে শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছি, তারা সবচেয়ে ভালো সময়টা পেয়েছি বাংলাদেশের। স্বাধীন বাংলার জন্য গণআন্দোলন ছিল, ভাষার জন্য ভালোবাসা ছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ছিল। শিল্প সাহিত্য নাচ গান নাটক সিনেমার স্বর্ণযুগ ছিল সে যুগ। এ যুগে যদি শৈশব-কৈশোর কাটতো, তবে তো পায়ে শেকল পরে, মাথায় হিজাব পরে, চূড়ান্ত পরাধীনতাকে ‘চয়েজ’ নামে ডাকতে হতো।

১০. ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং সাহস তাঁকে হিমালয় বানিয়েছে। সুতরাং তাঁকে দেখে আমার হিমালয় দেখা হয়ে গেছে।’ ফিদেল কাস্ত্রো মারা গেছেন আজ পাঁচ বছর। বাংলাদেশ সরকার কি কাউকে পাঠিয়েছিল কিউবায় কাস্ত্রোকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে? মনে হয় পাঠায়নি। ভারতের ডানপন্থি সরকারও কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠিয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী কাস্ত্রোর প্রশংসা করে প্রচন্ড নিন্দেয় আক্রান্ত হওয়ার পর কিউবায় কাস্ত্রোকে শ্রদ্ধা জানাতে যাননি। ওবামাও একই কাজ করেছেন। পুতিনও তাই। কিন্তু আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার নেতারা কাস্ত্রোবিরোধী কারো নিন্দেয় যাত্রা ভঙ্গ করেননি। তাঁরা হাভানায় গিয়ে বিপ্লবী কাস্ত্রোকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে কাস্ত্রো এক বিশাল প্রতীক। কাস্ত্রোর সবচেয়ে বড় পরিচয় এটিই। যুক্তরাষ্ট্রের ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা সত্ত্বেও বেঁচে ছিলেন। কিউবার মতো একটি ছোট্ট দ্বীপকে যুক্তরাষ্ট্রের সব রকম শত্রুতা আর অসহযোগিতা সত্ত্বেও একটি দেশ হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। কাস্ত্রো ছাড়া আর কেউই তা পারতো না। কাস্ত্রোকে ঘৃণা করার লোকের অভাব নেই। কাস্ত্রোকে ভালোবাসার লোকেরও অভাব নেই।

ষাট দশকে কোনও সৎ, স্বপ্নবান তরুণ-তরুণী ছিল না এই পৃথিবীতে যাকে কাস্ত্রোর বিপ্লব মুগ্ধ করেনি। সেই দীর্ঘদেহী, অসম সাহসী যুবক ছিল সবারই অন্তরে।

কাস্ত্রোর এক পুরনো দেহরক্ষী চারদিকে এখন কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে, কাস্ত্রোর নাকি কুড়িটি বাড়ি ছিল, ইয়াট ছিল, লাক্সারি লাইফ ছিল, কাস্ত্রো যে বলতেন জেলেদের কুঁড়েঘরের মতো এক কুঁড়েঘর আছে শুধু তাঁর, তা মিথ্যে। জানি না কাস্ত্রো সম্পর্কে কজন জানেন যে তিনি প্রচন্ড এক ধনীর ছেলে ছিলেন, তাঁর বাবার ছিল আখ চাষের খেত। কিউবার বিপ্লবের আগে আখের ব্যবসাই ছিল কিউবার সবচেয়ে বড় ব্যবসা। স্বৈরাচারী শোষক বাতিস্তাকে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে গদি থেকে নামিয়ে কাস্ত্রো ভূমি সংস্কার করেছিলেন। প্রথমেই যার জমি কাস্ত্রো নিয়ে নিয়েছিলেন তা কাস্ত্রো পরিবারের জমি। যে ভূমিহীন চাষীরা কাস্ত্রোদের আখের জমিতে চাষের কাজ করতো, তাদেরই কাস্ত্রো দিয়েছিলেন জমির ওপর সর্বোচ্চ অধিকার।

যদি কাস্ত্রোর থেকেই থাকে এখন কুড়িটি বাড়ি, তাঁকে নিন্দে করতে হবে কেন! যুক্তরাষ্ট্রের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁকে তো বিভিন্ন গোপন জায়গায় বিভিন্ন সময় আশ্রয় নিতেই হতো। কাস্ত্রোর কজন প্রেমিকা ছিল, কজন স্ত্রী, কতগুলো ‘জারজ সন্তান’ ছিল তাঁর, এসব আলোচনা দেখলাম কাস্ত্রোর মৃত্যুর পরও হচ্ছে। হয়তো আরো শত বছর হবে। কিন্তু কিছু মানুষ মেনে নেবে যে বিপ্লবীরাও প্রেমিক হতে পারে, বিপ্লবীদেরও সেক্স লাইফ থাকতে পারে, দ্বিচারী, স্বৈরাচারী তারাও হতে পারে, এতে বিপ্লব মিথ্যে হয়ে যায় না, এতে পুঁজিবাদীদের জুজুর ভয় সমাজতন্ত্রকেই নাকের ডগায়, এতটুকু না ভেঙে না পিছলে, প্রতিষ্ঠিত করার অবিশ্বাস্য সাহসও মিথ্যে হয়ে যায় না, এতে সারাজীবন এক ভয়ংকর শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদকে, নাগালের মধ্যে থেকেও, নিজে শক্তিহীন হয়েও, শুধু আদর্শের জোরে পরাহত করে, অস্বীকার করে, টিকে থাকার মূল্যও কিছু কমে যায় না।

 

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর