শনিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

গৃহঋণ ‘একটুকু বাসা, করেছিনু আশা’

তপন কুমার ঘোষ

গৃহঋণ ‘একটুকু বাসা, করেছিনু আশা’

‘ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা, করেছিনু আশা। ‘সাধারণ মানুষের গৃহবাসনার কথা কবিগুরু অনেক আগেই ব্যক্ত করে গেছেন তাঁর ‘আশা’ কবিতায়। মানুষের মৌলিক পাঁচটি চাহিদার মধ্যে একটি হলো বাসস্থান। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান। বাকি দুটি মৌলিক চাহিদা হচ্ছে শিক্ষা ও চিকিৎসা। মানব সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু গোটা পৃথিবীতে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা অগুনতি। একটি বাড়ির স্বপ্ন কে না দেখে! পাখিরও একটা বাসা আছে। সাঝবেলায় ক্লান্ত পাখিরা ফিরে আসে কুলায়। শিয়ালেরও একটা গর্ত আছে। দিনের আলোয় লুকিয়ে থাকে অন্ধকার গর্তে। কিন্তু বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মাথার ওপর কোনো আচ্ছাদন নেই। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক মানব জনমের জন্য আর কী হতে পারে!  ‘সবার জন্য আবাসন’ বর্তমান সরকারের ভিশন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, ‘দেশের একটি মানুষও গৃহহীন, ভূমিহীন বা ঠিকানাবিহীন থাকবে না। ‘ সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় কয়েক লক্ষ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ইতিমধ্যে পুনর্বাসন করা হয়েছে। অন্যের ঘরের বারান্দায়, ফুটপাথে, গাছের নিচে বা ঝুপড়িতে যাদের রাত কাটত তাদের প্রত্যেকটি পরিবার এখন দুই ঘরের আধাপাকা একটি বাড়ির মালিক। লাগোয়া রান্নাঘর, শৌচাগার ও বারান্দা। সরকারের কাছ থেকে উপহার হিসেবে জমি ও ঘর পেয়ে এরা বেজায় খুশি। এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গৃহঋণ প্রদান করে থাকে। বাড়ি নির্মাণ বা ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের শতভাগ ঋণ হিসেবে কোনো প্রতিষ্ঠান দেয় না। ব্যয়ের সর্বোচ্চ ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ঋণ দিয়ে থাকে। বাকি অংশ ঋণগ্রহীতাকে বহন করতে হয়। এটাকে ‘ইকুইটি’ বলে। গৃহঋণের সুদের হার এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছে। চার শতাংশ সরল সুদে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য সরকারি কর্মকর্তারা গৃহঋণ পাচ্ছেন।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি)। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবাসন চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ১৯৫২ সালে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশবলে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন পুনর্গঠন করা হয়। সরকার প্রতিষ্ঠানটির সম্প্রসারণ চাচ্ছে। বর্তমানে সারা দেশে ৬১টি শাখার মাধ্যমে এর কার্যক্রম চলছে। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের অনুমোদিত মূলধন এক হাজার কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীতকরণ সংক্রান্ত একটি বিল সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। বর্তমানে সংস্থাটির অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন উভয়ই ১১০ কোটি টাকা। মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, গৃহঋণের চাহিদা বাড়ছে। চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়ে যাতে অসুবিধা না হয়, সেজন্যই মূলধন বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত।

বিএইচবিএফসি মূলত বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট কেনার জন্য ঋণ দিয়ে থাকে। ঋণ আবেদনকারীকে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। বয়স হতে হবে ১৮ বছরের বেশি। ঋণের মূল জামানত নির্মিতব্য বাড়ি বা ফ্ল্যাট বন্ধক। তবে বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলে অতিরিক্ত জামানত হিসেবে একজন উপযুক্ত জামিনদার নিয়োগ দিতে হবে। বিএইচবিএফসি সরল সুদে ঋণ দেয়। সুদের ওপর সুদ দিতে হয় না। কোনো লুক্কায়িত চার্জ নেই। সারা দেশেই গৃহঋণ সুবিধা সম্প্রসারিত করেছে সংস্থাটি। সময়ের প্রয়োজনে নতুন নতুন ঋণপণ্য উদ্ভাবন করেছে। বর্তমানে মোট ১১টি ঋণপণ্য চালু আছে। এগুলো হচ্ছে, ফ্ল্যাট ঋণ, নগরবন্ধু, প্রবাসবন্ধু, ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ঋণ, আবাসন উন্নয়ন ঋণ, আবাসন মেরামত ঋণ, কৃষক আবাসন ঋণ, পল্লীমা, জিরো ইক্যুইটি আবাসন ঋণ, সরকারি কর্মচারী ঋণ ও হাউসিং ইকুইপমেন্ট ঋণ। এর মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ফ্ল্যাট ঋণ, নগরবন্ধু ও পল্লীমা। এ ছাড়া অতি সম্প্রতি চালু করা হয়েছে ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিক গৃহনির্মাণ বিনিয়োগ প্রজেক্ট ‘মনজিল’। বিএইচবিএফসি’র মোট ঋণ পোর্টফলিও ইতিমধ্যে তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ঋণের সিলিং বাড়িয়েছে বিএইচবিএফসি। বাড়ি নির্মাণের জন্য একজন গ্রাহক এলাকাভেদে সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা ঋণ নিতে পারেন। তবে গ্রুপভুক্ত প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ এক কোটি ২০ লাখ টাকা। ফ্ল্যাট কেনার জন্য ঋণমাত্রা এলাকাভেদে সর্বোচ্চ এক কোটি ২০ লাখ টাকা। ইকুইটি ক্ষেত্রমতে ২০, ২৫ ও ৩০ শতাংশ। ঋণের সর্বোচ্চ মেয়াদ প্রকল্পভেদে ১০ থেকে ২৫ বছর। সুদের হার ঋণ পণ্যভেদে সাত থেকে নয় শতাংশ। কৃষক আবাসন ঋণের সুদের হার সর্বনিম্ন, সাত শতাংশ। অন্যান্য ক্ষেত্রে এই হার আট থেকে নয় শতাংশ। করপোরেশনের ওয়েবসাইটে ঋণ পণ্যভিত্তিক বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এখন থেকে বিএইচবিএফসির যে কোনো ঋণের কিস্তি সোনালী ব্যাংকের ‘সোনালী ই-সেবা’ পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে অনলাইনে পরিশোধ করতে পারবেন গ্রাহকরা। কিস্তির অর্থ গ্রাহকের গৃহঋণ হিসাবে তাৎক্ষণিক জমা হবে এবং গ্রাহক তার মোবাইলে জমাকৃত অর্থ ও গৃহঋণ হিসাবের সর্বশেষ ব্যালেন্স সম্বলিত তাৎক্ষণিক বার্তা পাবেন। মাসিক কিস্তির অতিরিক্ত অর্থ জমা দিলে তা আসলের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। মেয়াদ পূর্তির আগেই ঋণ পরিশোধ করলে কোনো অতিরিক্ত চার্জ দিতে হবে না। পূরণ হোক সাধারণ মানুষের সুপ্ত গৃহবাসনা!

লেখক : পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশন।

সর্বশেষ খবর