রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ঘৃণাভরে ঘুষ প্রত্যাখ্যান করলেন আলেকজান্ডার

সাইফুর রহমান

ঘৃণাভরে ঘুষ প্রত্যাখ্যান করলেন আলেকজান্ডার

কোনো গ্রিক বীরই এর আগে পারস্য অর্থাৎ ইরান অভিযানের দুঃসাহস দেখাননি। অথচ আলেকজান্ডারের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন একসময় পারস্য জয় করে সেখানে তিনি ওড়াবেন তাঁর বিজয়কেতন। এখন থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে আলেকজান্ডারের পিতা রাজা ফিলিপ গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হলে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন আলেকজান্ডার। দিগি¦জয়ী আলেকজান্ডার জন্মগ্রহণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ অব্দে ৬ জুলাই। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বেরিয়ে পড়েন বিশ্বজয়ে। ৪০ হাজার পদাতিক ও ৮ হাজার অশ্বারোহী সেনা নিয়ে আলেকজান্ডার আফ্রিকা, সিরিয়া, আরব জয় করে প্রবেশ করেন পারস্যে। ইউফ্রেতিস নদী পার হলেই পারস্য সম্রাট দারিয়ুসের রাজধানী। ইউফ্রেতিস নদীর এপারের সমস্ত ভূ-ভাগ করায়ত্ত করে দারিয়ুসের শক্তি চূড়ান্তভাবে ধ্বংস সাধনে নদী অতিক্রমের লক্ষ্যে অগ্রসর হলেন আলেকজান্ডার। পারস্য সাম্রাজ্য রক্ষায় প্রায় আড়াই লাখ সেনা যুদ্ধর জন্য প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও আলেকজান্ডার সম্রাট দারিয়ুসের কাছ থেকে একটি চিঠি পেলেন। দারিয়ুস চিঠিতে ভবিষ্যতের শান্তি ও বন্ধুত্বের জন্য এবং যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ হিসেবে ১০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিতে, সেই সঙ্গে ইউফ্রেতিস নদীর অন্য পারের সব ভূ-ভাগ ছেড়ে দিতে ও নিজ কন্যাকে আলেকজান্ডারের সঙ্গে বিয়ে দিতে প্রস্তাব করলেন। লোভনীয় এ প্রস্তাবটি শোনার পর সেনাপতি পারমেনিও বললেন, আমি যদি আলেকজান্ডার হতাম তবে এ প্রস্তাব অবশ্যই গ্রহণ করতাম। আলেকজান্ডার বললেন, ‘আমিও তাই করতাম যদি আমি পারমেনিও হতাম।’ প্রশ্ন ওঠে, আলেকজান্ডার যদি টাকা-পয়সার কাঙাল হতেন দারিয়ুসের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও জমি নিয়ে তিনি যদি সেখানেই থেমে যেতেন তাহলে কি আদৌ আজ ইতিহাসে নিজের নাম এমন স্বর্ণাক্ষরে লেখাতে পারতেন? অর্থ কিংবা ধনসম্পদের প্রতি আলেকজান্ডারের খুব একটা মোহ ছিল না। তিনি সর্বাত্মকভাবে চেয়েছিলেন ইতিহাসে অমর হয়ে থাকতে।

আরেকটি ঘটনার কথা বলি। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন আলেকজান্ডার মাত্র ১৬ বছরের তরুণ। এ তরুণ পুত্রকে রাজা ফিলিপ মেসিডোনিয়া রাজ্য দেখভাল করার জন্য রেখে যান। আলেকজান্ডার তো আর অলস বসে থাকার পাত্র নন। এ সময়ের মধ্যেই তিনি বিদ্রোহী সিভি জাতির পতন ঘটান, ঝটিকা আক্রমণ করে তাদের প্রধান নগরী অধিকার করে নেন। এ ছাড়া সেখানে তিনি কয়েকটি জাতির বসতি স্থাপন করে স্থানটির নাম তার নামানুসারে রাখেন আলেকজেন্দ্রোপেসলিস।

আপনি যদি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে দেখবেন আপনার চারপাশে এমন অনেক বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-পরিজন আছেন তাদের কাছে আসলে অর্থই সব। আপনি আপনার হৃদয় ছিঁড়ে যদি এক হাতে রাখেন আর অন্য হাতে থাকে এই ধরুন ৫ লাখ টাকা। আপনার সেই বন্ধু কিংবা আত্মীয়স্বজনকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন সে কোনটা চায়। আপনি দেখবেন অম্লান বদনে তাদের অনেকে চাইবে ৫ লাখ টাকা। আপনি যদি আপনার এ মহামূল্যবান জীবনটিও উৎসর্গ করেন তার পরও দেখবেন আপনার সেই বন্ধু কিংবা স্বজনের কাছে আপনার জীবনের তেমন কোনো মূল্য নেই বরং ওই মানুষটি আপনার জীবনের পরিবর্তে কিছু টাকা পেলেই যেন খুশি। সমাজে মূল্যবোধ ও সামাজিক অবক্ষয় এমনভাবে পতিত হয়েছে, এসব দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। বর্তমান সময়ে অর্থলাভের জন্য হেন কর্ম নেই যা মানুষ করতে কুণ্ঠাবোধ করে। এটা সভ্যসমাজে একটা ভয়াবহ ব্যাধি। আমরা ছোটবেলায় ভাবসম্প্রসারণ শিখেছিলাম ‘অর্থই অনর্থের মূল’। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয় এ কথাগুলো আসলে কতটা সত্যি। উপরোক্ত বাক্যটি নেওয়া হয়েছে বিখ্যাত লেখক মীর মশাররফ হোসেন লিখিত ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থ থেকে। লেখক লিখেছেন- অর্থের লোভেই সীমার ইমাম হোসেনকে হত্যা করেছিল। অর্থের লোভেই মানুষ নৈতিকতা বিসর্জন দেয়। অর্থই মানুষকে ভুল পথে চালিত করে। তাই মীর মশাররফ হোসেন ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘হায়রে পাতকী অর্থ। তুই জগতে সকল অনর্থের মূল।’ অর্থই মানুষের জীবন নাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিজ্ঞ লোকেরা বলেন, ‘অর্থই অনর্থের মূল’। এই যে মানুষের অর্থের প্রতি সীমাহীন লোভ, সত্যি সত্যি কি টাকা দিয়ে সবকিছু অর্জন করা যায়? সম্ভবত টাকার বিনিময়ে সবকিছু অর্জন শুধু আমাদের মতো কিছু দেশেই সম্ভব। উন্নত বিশে^ অর্থের চেয়েও মানবতা, মূল্যবোধ, শিষ্টাচার প্রভৃতি গুণকেই অনেক বড় করে দেখা হয়। তা না হলে বেশ কয়েক বছর আগে ‘মানুষ কী পেলে সবচেয়ে আত্মতুষ্ট হয়’ এ বিষয়ে আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা হয়েছিল। সেই গবেষণা থেকে উঠে এসেছে যে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ একটি খাঁটি পারস্পরিক সম্পর্কে যুক্ত থাকলেই নিজেকে সবচেয়ে বেশি সুখী মনে করে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় এখানে তো ‘একটি খাঁটি সম্পর্কের’ পরিবর্তে স্থান করে নেওয়ার কথা ছিল অর্থ। কিন্তু মানুষ ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছে বর্তমান সময়ের ফেক ওয়ার্ল্ডে একটি খাঁটি সম্পর্ক কতটা জরুরি। কারণ অর্থ দিয়ে আসলে একটি খাঁটি সম্পর্ক কোনো দিন তৈরি হয় না। টাকা-পয়সা কিংবা ধনদৌলত এ বিষয়গুলোই আমার কাছে মনে হয় যেন অভিশপ্ত। কারণ মানুষের টাকাপয়সা, অর্থ, বৈভব হলেই মানুষ সে অর্থ কুপথে খরচ করে। বিশেষ করে এ কারণেই দেখা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিত্তশালী মানুষ জীবনে অনেক দুর্নাম অর্জন করে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত জার্মান লেখক গ্যেটে রচিত ট্র্যাজেডিধর্মী নাটক ফাউস্টের কথা মনে পড়ে গেল। গ্যেটের রচিত ফাউস্ট নাটকটির চমৎকার একটি অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা। ফাউস্ট নামের এ নাটকটিতে দেখা যায় অসীম জ্ঞানের অধিকারী ড. ফাউস্টাস বিত্ত, বৈভব, সফলতা ও ক্ষমতার জন্য তার আত্মাটি শয়তানের কাছে বিক্রি করেছিলেন। পার্থিব স্বল্পকালীন সফলতা আর ক্ষমতার বিনিময়ে নৈতিক শুদ্ধতাকে বিক্রি করে দেওয়াকে বলা হয় ফাউস্টিয়ান চুক্তি। ঈশ্বরের পক্ষ ত্যাগ করে নেহায়েত লৌকিক স্বার্থে শয়তানের পক্ষে যোগ দেওয়াই হচ্ছে ফাউস্টিয়ান কর্ম। প্রচলিত এ ধারণার সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী সাহিত্যিক চরিত্র ফাউস্ট। পাশ্চাত্য রেনেসাঁ চিন্তা এবং আধুনিকতার উন্মেষের পথে অন্য কোনো চরিত্রই বোধহয় ফাউস্টের মতো এতটা সর্বজনীনতা অর্জন করেনি। ফাউস্ট সম্পর্কে সর্বপ্রথম লেখা হয়েছিল ১৫৮৭ সালের দিকে প্রাপ্ত পুঁথিতে। ১৫৯২ সালের আগেই পুঁথিটি জনৈক পি এফ জেন্টের মাধ্যমে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। নাম ‘হিস্টোরিয়ে অব দ্য ডেমনেবল লাইফ অ্যান্ড ডিজার্ভ ডেথ অব ডক্টর জন ফাউস্টাস’। খুব সম্ভবত শেক্সপিয়ারের বন্ধু বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার ক্রিস্টোফার মারলোও উপরোক্ত রচনাটি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই প্লট অনুসরণ করে মারলো রচনা করেন ‘দ্য ট্রাজিক্যাল হিস্ট্রি অব ডক্টর ফাউস্টাস’। অন্যদিকে ইউহান উলফগ্যাং ভন গ্যেটে জার্মান হয়েও পড়েছিলেন মারলোর লেখা। দেখেছিলেন ফাউস্টকে কেন্দ্র করে নির্মিত নাটক। সবকিছুর নির্যাস নিয়েই পরবর্তী জীবনে তিনি রচনা করেন জার্মান সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘ফাউস্ট’।

গ্যেটের আখ্যানের শুরুটা স্বর্গে। ফেরেশতারা ঈশ্বরের উপাসনা করছে। শয়তান মেফিস্টোফেলিস ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করল- দুনিয়ার মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত। চাইলে সে ডক্টর ফাউস্টের মতো জ্ঞানীকেও পথভ্রষ্ট করে প্রমাণ দেখাতে পারবে। ঈশ্বরও মেফিস্টোফেলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন- নাঃ ফাউস্ট সৎ বান্দা হয়েই থাকবে। পণ্ডিত মানুষ ফাউস্ট। তারপরও ভিতরে সীমাহীন শূন্যতা। নিজেকে হত্যা করতে গিয়েও ফিরে আসে। আলকেমি, চিকিৎসাশাস্ত্র কিংবা ধর্মতত্ত্ব কোনো কিছুই যেন তাঁর পিপাসা পূরণ করতে পারে না। সবকিছু ফাঁপা আর অর্থহীন মনে হয়। ঠিক সেই সুযোগই কাজে লাগায় শয়তান মেফিস্টোফেলিস। ফাউস্টের সঙ্গে কথা হয়। ফাউস্টের বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে ভর্ৎসনা করে শয়তান মেফিস্টোফেলিস। দেখায় নিজের অলৌকিক ক্ষমতা। চাইলে ফাউস্টও পেতে পারে এমন শক্তি, তার চেয়েও বেশি শক্তি। বিদ্যুৎ খেলে যায় ফাউস্টের শিরায়। বিগত জীবনের দর্শন, চিকিৎসা ও ধর্মতত্ত্ব তাকে হতাশ করেছে। অথচ এ তো সুবর্ণ সুযোগ। ফাউস্ট চায় সেই ক্ষমতা। যে ক্ষমতা তাকে বিত্ত বৈভব ও শক্তিতে ভরিয়ে তুলবে। মেফিস্টোফেলিসের আপত্তি নেই। সে তার সব শক্তি নিয়ে ফাউস্টের অধীন হয়ে ইচ্ছাপূরণ করে যাবে। কেবল একটা শর্ত। পরবর্তী অনন্ত জীবন ফাউস্টকে মেফিস্টোফেলিসের দাস হয়ে থাকতে হবে। এ চুক্তি ফাউস্টের ভাগ্য বদলে দেয়। পরিণত হয় ইহজীবনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পুরুষে। বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে শয়তান মেফিস্টোফেলিস প্রমাণ করে ফাউস্টের আনুগত্য। গ্রেচেন নামক তরুণীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ফাউস্ট। নিহত হয় গ্রেচেনের ভাই। অভিযুক্ত ফাউস্ট গা ঢাকা দেয়। অনুতপ্ত গ্রেচেন নিজের সন্তানকে হত্যা করে বসে। হত্যাকারী মাকে ধরে নিয়ে কারাগারে প্রেরণ করে মানুষ। প্রতিনিয়ত শয়তান মেফিস্টোফেলিস ফাউস্টকে নির্দেশনাদানে লিপ্ত। বারবার ফাউস্ট মন্দ ফেরেশতার কথাই অনুসরণ করে। শয়তানও ফাউস্টকে সহযোগিতা করে সব ক্ষেত্রে। ফাউস্টের মেয়াদ পূর্ণ হলে মেফিস্টোফেলিস তাকে নিয়ে অনন্ত জাহান্নামে গমন করে। এবার বেচারা ফাউস্ট সত্যি সত্যি অনুতপ্ত হয় নিজের সিদ্ধান্তের জন্য।

ফাউস্ট আখ্যানের শুরু নৈতিক শিক্ষার অন্যতম চরিত্র হিসেবে। ফাউস্ট যেন পথভ্রষ্টতার একটা স্পষ্ট নজির, যে ইহজাগতিকতায় ডুবে গেছে। মানুষের অর্থের প্রতি এই যে সীমাহীন লোভ এটাই বোধকরি বর্তমান সময়ে শয়তান মেফিস্টোফেলিসের জ্বাজল্যমান রূপ। আর ফাউস্ট হচ্ছি আমরা অর্থাৎ সমাজে অর্থলোলুপ মানুষ। মানুষের সীমাবদ্ধতা ফাউস্টকে প্রতিনিয়ত খুবলে খেয়েছে। সে এ বাধা অতিক্রম করতে চায়। শাসন করতে চায় দুনিয়া। মানুষ সত্তাগতভাবেই ভুল করে। তাকে প্রতিনিয়ত ভালো আর মন্দের মধ্যকার দ্বন্দ্ব উপলব্ধি করতে হয়। বেছে নিতে হয় দুয়ের মধ্যকার যে কোনো একটি পথ। অজস্র লোভ আর আকর্ষণের পরও দিন শেষে নিজের নৈতিক অবস্থান উচ্চে তুলে রাখতে হয়। মানুষ নিখুঁত নয়। সৎ হওয়ার জন্য নিখুঁত হওয়াটাও জরুরি নয়।

এই যে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা একটি খাঁটি সম্পর্কের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে সেটারই কিন্তু আমরা প্রতিফলন দেখতে পাই বিশে^র শীর্ষস্থানীয় ধনকুবের বিল গেটসের মেয়ে জেনিফার গেটসের বিয়ের বিষয়টাতে। আমরা দেখি গেটসতনয়া পাত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন একজন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেকে। জেনিফারের বর ৩০ বছর বয়সী মিসরীয় যুবক নায়েল নাসের একজন পেশাদার ঘোড়দৌড়বিদ। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জেনিফার গেটসের সঙ্গে পরিচয় হয় নায়েল নাসেরের। দুজনেরই ছিল ঘোড়দৌড়ের প্রতি ভীষণ আগ্রহ। আর এ আগ্রহের কারণেই দুজনে আরও কাছাকাছি আসেন। একসঙ্গে বিভিন্ন ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশও নেন। এভাবেই ধীরে ধীরে জেনিফারের মনে জায়গা করে নেন নাসের।

শুধু বিল গেটস-কন্যাই নন, এ বছরই আমরা আরও দেখলাম জাপানের রাজকন্যা মাকো রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন একজন সাধারণ ঘরের ছেলের সঙ্গে। রাজ পরিবারের রীতি মেনে বিয়ে করেননি মাকো। অর্থ নেননি রাজ পরিবারের। জাপানের রাজ পরিবারের নিয়ম হলো, বাড়ির কোনো মেয়ে সাধারণ মানুষকে বিয়ে করলে তাকে রাজ পরিবার ছেড়ে যেতে হয়। রাজ পরিবারে ফেরার রাস্তা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু তা নিয়ে এতটুকু বিচলিত নন মাকো। রাজপুত্রের ক্ষেত্রে অবশ্য সে নিয়ম খাটে না। রাজকন্যা চলে গেলে তাকে অর্থসাহায্য করা হয়। যা দিয়ে তার পরবর্তী জীবন কাটবে। মাকো সেই অর্থ নিতে অস্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন তাঁর বর আমেরিকায় আইনজীবী। বিয়ের পর তিনি বরের সঙ্গে আমেরিকায় বসবাস করবেন আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো।

অথচ আমাদের এ অঞ্চলে একজন উচ্চবিত্ত মানুষ বিয়ে কিংবা যে কোনো সম্পর্কই হোক না কেন দেখা যায় যে সে বেছে নেয় আরেকজন উচ্চবিত্তকেই। উচ্চবিত্ত সেই মানুষটির সঙ্গে তার হৃদয়, রুচি কিংবা আচার-ব্যবহারের আদৌ কোনো মিল আছে কি না তা বিবেচ্য নয়। বিত্তশালী সেই ছেলেটির সঙ্গে সে আদৌ সুখী হবে কি না তা-ও মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে সেই পাত্র বা পাত্রীর অর্থ আছে কি না। সুখ গোল্লায় যাক। একজন ধনকুবেরের এত বিত্ত-বৈভব থাকা সত্ত্বেও যে কেন অন্য আরেক ধনী ব্যক্তির অর্থের প্রতি তার লোভ জন্মায় এটাই আমার মাথায় আসে না। আমাদের এ অঞ্চলে বিত্তশালীর মধ্যে কেমন যেন একটা ‘হাভাতে’ স্বভাব দেখা যায়। এর আরেকটা কারণ সম্ভবত এ ভূ-ভাগের বেশির ভাগ ধনী অনেক নিম্ন শ্রেণি থেকে বিত্তশালী হয়ে ওঠে। এজন্য তারা নিজেদের আনসিকিউরড অনুভব করে। তারা মনে করে আমার ধনসম্পত্তি ফুরিয়ে গেলে স্বামী কিংবা স্ত্রীর সম্পত্তিতে পোদ্দারি করব। আর এজন্যই আমরা মুকেশ আম্বানির মেয়ে ঈশা আম্বানিকে দেখি ভারতের আরেক ধনকুবের অজেয় পিরামলের পুত্র আনন্দ পিরামলকে বিয়ে করতে। এ রকম আরও বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে আমি সেদিকে যাচ্ছি না। অথচ আমাদের বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর মেয়ে হজরত ফাতিমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন হতদরিদ্র হজরত আলীর সঙ্গে। যদিও সে সময় ফাতিমার পাণিপ্রার্থী ছিলেন আরবের বহু বড় বড় ধনী ব্যক্তি।

আলী (রা)-এর ঘর ছিল চরম দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত যা সব ইতিহাসবিদই উল্লেখ করেছেন। সে ঘরে ছিল খেজুর গাছের ছালভর্তি চামড়ার বালিশ, বিছানা, এক জোড়া জাঁতা, দুটি মশক। চরম দারিদ্র্যের কারণে গৃহস্থালির কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য ফাতিমা (রা)-কে কোনো চাকরের ব্যবস্থা করতে পারেননি আলী (রা)। ফাতিমা (রা) একাই সব কাজ সম্পাদনের চেষ্টা করতেন। জাঁতা ঘোরাতে ঘোরাতে তাঁর হাতে কড়া পড়ে গিয়েছিল, মশকভর্তি পানি টানতে টানতে বুকে দাগ পড়ে গিয়েছিল, ঘর ঝাড় দিতে দিতে কাপড়-চোপড় ময়লা হয়ে যেত। আলী (রা) তাঁর কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। তাঁদের বিছানা ছিল শক্ত। তাঁদের ব্যবহারের কম্বল ছিল এত ছোট যে মাথার দিকে টানলে পায়ের দিক বেরিয়ে যেত আবার পায়ের দিকে টানলে মাথা ঢাকত না। এই ছিল আলী (রা)-এর সংসার। অথচ নবীজি ফাতিমাকে আলীর সঙ্গেই বিয়ে দিয়েছিলেন কারণ নবীজি নিজেই বলেছেন, ‘আমি যদি জ্ঞানের শহর হই আলী তার দরজা’। নবীজি বিত্তশালী নয় বরং তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যাকে একজন জ্ঞানী মানুষের হাতে অর্পণ করেছেন।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর