রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
পাঠক কলাম

সরকারি দফতরের নিরাপত্তা

মাজহারুল ইসলাম

সরকারি দফতরের নিরাপত্তা

দেশের সচিবালয় হলো  প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু সেই প্রাণকেন্দ্রের নিরাপত্তার বিষয়টি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। লাখ লাখ টাকা খরচ করে সচিবালয়ে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। কিন্তু দেখে-শুনে মনে হচ্ছে সচিবালয়ের নিরাপত্তা কিংবা চুরি বন্ধ নয়, সিসি ক্যামেরা কেনা হয়েছিল অন্য কোনো উদ্দেশ্যে। সবারই জানা ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’- এ প্রবাদটির ওপর আমাদের ব্যবসায়ীদের চেয়েও আমলাদের আস্থা বেশি। হয়তো সচিবালয়ের ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নয়, বাণিজ্য ছিল সিসি ক্যামেরা বসানোর উদ্দেশ্য। যে কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ১৭টি ফাইল গায়ের হওয়ার পাঁচ সপ্তাহ পরও তা উদ্ধার হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হালহকিকত কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য স্বাস্থ্যকর হলেও দেশবাসীর জন্য যে অস্বাস্থ্যকর সে বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগই নেই। এলোমেলো করে দে মা লুটেপুটে খাই তত্ত্বের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত এ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি নথি খোয়া যায় ২৮ অক্টোবর। এ ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। এ নিয়ে যথারীতি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের কৃতিত্বও দেখায় বহুল আলোচিত ওই মন্ত্রণালয়। জিডিতে ১৭টি নথির নম্বর ও বিষয় উল্লেখ করা হয়। নথিগুলোর মধ্যে রয়েছে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য মেডিকেল কলেজের কেনাকাটা-সংক্রান্ত একাধিক নথি, ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি, নিপোর্ট অধিদফতরের কেনাকাটা, ট্রেনিং স্কুলের যানবাহন বরাদ্দ ও ক্রয়সংক্রান্ত নথি। ফাইল খোয়া যাওয়ার ঘটনায় ৪ নভেম্বর ছায়াতদন্ত শুরু করে সিআইডি। ফাইল চুরির ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমাও দিয়েছেন। প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে চার কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন ক্রয় ও সংগ্রহ-২ শাখার সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর আয়েশা সিদ্দিকা ও জোসেফ সরদার, প্রশাসন-২ শাখার (গ্রহণ ও বিতরণ ইউনিট) অফিস সহায়ক বাদল চন্দ্র গোস্বামী এবং প্রশাসন-৩ শাখার অফিস সহায়ক মিন্টু মিয়া। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘নথি গায়েবের ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এখন অ্যাকশন চলমান আছে। ডিপার্টমেন্টাল প্রসেডিং হয়েছে, এ অনুযায়ী কাজ চলমান থাকবে। চারজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের কর্মচারী। তাদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। এখন প্রসেডিং চলছে, এরপর যখন জাজমেন্ট হবে তখন তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চারজনই নিচের পর্যায়ের কর্মচারী।’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের ১৭টি নথি গায়েবের ঘটনায় ২৮ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগ থানায় যে জিডি হয় সেখানে বলা হয়- স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের ক্রয়সংক্রান্ত শাখা-২-এর কম্পিউটার অপারেটর জোসেফ সরদার ও আয়েশা ২৭ অক্টোবর বুধবার কাজ শেষ করে ফাইলটি একটি কেবিনেটে রেখে গিয়েছিলেন। ওই ফাইলের ভিতরে ১৭টি নথি ছিল। পরদিন অফিসে গিয়ে কেবিনেটে ওই ফাইলটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর নথি গায়েবের ঘটনায় মন্ত্রণালয়টির অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. শাহ আলমকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (চিকিৎসা শিক্ষা) মো. আহসান কবীর, উপসচিব (চিকিৎসা শিক্ষা-১) মোহাম্মদ আবদুল কাদের ও উপসচিব মল্লিকা খাতুন। জিডির পর ঘটনার ছায়াতদন্ত শুরু করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্তের অংশ হিসেবে ৩১ অক্টোবর সকালে সচিবালয়ে যায় সিআইডি ক্রাইম সিন। তারা সচিবালয় ৩ নম্বর ভবনের নিচতলার ২৯ নম্বর কক্ষে (যে কক্ষ থেকে ফাইল চুরি হয়েছিল) গিয়ে আলামত সংগ্রহ করে। এ কক্ষে কর্মরতদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন সিআইডি কর্মকর্তারা। ফাইল চুরির তদন্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয় কর্মচারী ও এক ঠিকাদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয় সিআইডি। পরে ওই নয় কর্মচারী ও ঠিকাদার নাসিমুল গনি টোটনকে ৫ নভেম্বর ছেড়ে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্তাব্যক্তির ভাষ্য, ফাইলগুলো ছিল বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের ক্রয়সংক্রান্ত প্রশাসনিক আদেশের। সে ফাইলগুলো নিয়ে চোরেরা কী করবে সে প্রশ্ন তোলার চেষ্টাও তিনি করেছেন। এমন সরল মন্তব্যকারীদের কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যা ইচ্ছা তাই ঘটছে বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না। বরং প্রশ্ন ওঠা উচিত, সুরক্ষিত সচিবালয় থেকে ফাইল চুরি হয় কীভাবে? সেখানে ফাইল রাখার জায়গাগুলোয় তো সিসি ক্যামেরা থাকার কথা। আমরা আশা করব শুধু চুনোপুঁটি নয়, সত্যিকারের চোরদের পাকড়াওয়ের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি এ মন্ত্রণালয়কে সব ধরনের দুর্নীতিবাজের কবল থেকে মুক্ত করা হবে। কিছু লোকের জন্য স্বাস্থ্য খাতের যে ভাবমূর্তির সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনে সরকার শক্ত হবে এমনটিই প্রত্যাশিত।

লেখক : কলাম  লেখক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর