সোমবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ধর্ম বিশ্বাস ও জাতীয়তাবাদ

এম জে আকবর • অনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

ধর্ম বিশ্বাস ও জাতীয়তাবাদ

গান্ধী তাঁর ঊনআশি বছরের জীবনের প্রথম একত্রিশ বছর কাটিয়েছেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে।  ১৮৫৭ সালের যুদ্ধের বারো বছর পর জন্মগ্রহণ করেন, যে যুদ্ধ দিল্লিতে মুঘল শাসন দীর্ঘস্থায়ী রাখার মুখোশ ফেলে দিয়ে ব্রিটেনকে পশ্চিমে খাইবার পাস থেকে পূর্বদিকে বার্মার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। গান্ধী যতটা ঊনবিংশ শতাব্দীর শিশু ছিলেন, ততটাই ছিলেন বিংশ শতাব্দীর পিতা। ভারতের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত হওয়ার পর থেকে তাঁর ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ব্রিটিশ শাসন মুক্ত অখন্ড ভারতের ভবিষ্যতের সঙ্গে মুসলমান ও তাদের অতীতকে কীভাবে খাপ খাওয়ানো সম্ভব! তিনি সব ধর্ম বিশ্বাসের সমন্বয়ে অংশীদারিত্বমূলক জাতীয়তাবাদের কথা বলতেন। স্কুলে ছাত্রাবস্থায় গান্ধী ১৮৫৭ সাল সম্পর্কে গল্প-কাহিনি শুনেছেন। সুস্পষ্ট কারণেই সেই বিবরণীতে ভারতীয় বীরত্বের রোমাঞ্চকর ঘটনা এবং বিজয় অর্জনের পর ব্রিটিশের প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করার ভয়াবহ ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যে প্রশ্ন তাঁর চিন্তাকে বিঘ্নিত করত এবং বাস্তবিকপক্ষে তাঁর অনেক বয়োজ্যেষ্ঠদের মনেও একই চিন্তা উঠত, সেটি একটি মৌলিক প্রশ্ন ছিল : ভারতীয়রা এত দুর্বল এবং ব্রিটিশরা এত শক্তিশালী কেন? তরুণ গান্ধী এর সহজ উত্তর হিসেবে তাঁর নিজের দৈহিক গড়নের সাদৃশ্য সম্পর্কে ভেবেছিলেন। ইংরেজদের পেশির মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া তো দূরের কথা, গান্ধী ছিলেন আত্মস্বীকৃত ভীরু, ভূত-সাপ ও চোরদের ভয়ে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত থাকতেন এবং এই তিনটিই তাঁর দুঃস্বপ্নে আবির্ভূত হতো। তিনি রাতে আলো জ্বালিয়ে ঘুমাতেন এবং তাঁর কিশোরী স্ত্রী কস্তুরবা অন্ধকারকে ভয় করে না দেখে বিব্রত বোধ করতেন। স্কুলে এক দুষ্ট বন্ধু শেখ মেহতাব তাঁর কানে মন্ত্রণা দেয়, মাংসের মধ্যে রয়েছে দুর্বলতার নিরাময়। মেহতাব বড়াই করত সে জ্যান্ত সাপ ধরে রাখতে পারে, ভূত-প্রেতে ভয় পায় না এবং শুধু মাংস খায় বলে যে কোনো চোরকে মোকাবিলা করতে সক্ষম।

গুজরাটি কবি নারমাদ এক লেখা একটি ব্যঙ্গ কবিতা তখন স্কুলের ছেলেদের মুখে মুখে শোনা যেত : “দেখো ইংরেজ করছে শাসন সারা হিন্দুস্তান/মাংস খেকো পাঁচ হাত উঁচু, কত বড়ো সে পাহলোয়ান।” মেহতাব গান্ধীকে বলেন যে, ওই সময় রাজকোটে চলমান ‘সংস্কার’ আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাদের অনেক শিক্ষক গোপনে মাংস খেয়ে ও মদ পান করে ব্রিটিশের অনুকরণ করছেন। গান্ধী সংস্কারের প্রতি আকৃষ্ট হন, কিন্তু ধর্মীয় রীতি ভঙ্গ করা সহজ ছিল না। তিনি বৈষ্ণব ছিলেন, হিন্দুদের অন্য যে কোনো গোত্রের চেয়ে তাঁর গোত্রে মাংস ভোজনকে বেশি ঘৃণা করা হয়। তাঁর মা-বাবা যদি কখনো জানতে পারেন, তাদের পুত্র মাংস খেয়ে ধর্মচ্যুত হয়েছে, তাহলে তারা দুঃখেই মারা যাবেন। তিনি লিখেছেন : “কিন্তু আমার মধ্যে এ ধারণা জন্মাতে শুরু হলো যে, মাংস খাওয়া ভালো, মাংস খেলে আমি শক্তিশালী ও সাহসী হতে পারব এবং যদি সমগ্র দেশ মাংস খাওয়া শুরু করে, তাহলে ইংরেজদের পরাস্ত করা সম্ভব হতে পারে...।” তিনি এর সঙ্গে যোগ করেন যে তখন পর্যন্ত তিনি ‘স্বরাজ’ শব্দটি শোনেননি, “কিন্তু স্বাধীনতার অর্থ কী আমি তা জানতাম। সংস্কারের উন্মাদনা আমাকে অন্ধ করে ফেলেছিল।” কিশোর গান্ধী শক্তিশালী ও সাহসী হয়ে উঠতে এবং দেশবাসীদেরও সাহসী হওয়া উচিত বলে মনে করতেন, যাতে তারা ইংরেজদের পরাজিত করতে ও হিন্দুস্তানকে স্বাধীন করতে পারে। তিনি গোপনে মাংস খাওয়া শুরু করেন। কিন্তু আর্থিক কারণে অর্ধ-ডজনের বেশি বার তাঁর এ ধরনের গোপন ভোজনকে বিস্তৃত হয়নি এবং তিনি এর স্বাদও পছন্দ করতে পারেননি। মায়ের সঙ্গে প্রতারণা করার কারণে গান্ধী গভীর অপরাধ বোধ করেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে ধর্মদ্রোহমূলক এই অভিজ্ঞতা অর্জন সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি আর কখনো মাংস স্পর্শ করেননি। বর্ণ প্রথার আদর্শগত বিধি তাঁকে কখনো প্রভাবিত করতে পারেনি এবং অস্পৃশ্যতার মতো নিষেধাজ্ঞার গোঁড়ামিমূলক বৈষম্য ও নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত অসুখী ছিলেন। বাংলার দুজন খ্যাতিমান চিন্তাবিদ-নেতা সংস্কার ও জাতীয় পুনর্জাগরণের প্রধান প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০) গান্ধীর চেয়ে বয়সে তিন বছরের ছোট। তাঁর পরিবার মাত্র সাত বছর বয়সে তাঁকে ইংল্যান্ডের স্কুলে পাঠানোর মতো যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। স্কুল শেষ করে তিনি ক্যামব্রিজে যান এবং ১৮৯০ সালে তিনি যখন সাম্রাজ্যের অভিজাত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের জন্য নির্বাচিত হন, তখন একটি লোহার ছাদ ভেঙে ফেলেন। দুই বছর শাস্তিমূলক পরীক্ষাকাল পার হওয়ার পর তাঁর জন্য দ্বিতীয় বারের সুযোগ আসে। তিনি তাঁর অশ্বারোহণ পরীক্ষা বাদ দেন, এবং এভাবে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্রিটিশ শাসনের ফোলানো-ফাঁপানো পদে তাঁর স্থান হারান এবং পরে রাজন্য শাসিত বরোদার প্রশাসনে যোগদান করেন। এর ফলে তিনি তাঁর জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে সুস্পষ্ট করে তোলার স্বাধীনতা পান। বাংলার একটি দুর্ভিক্ষ তাঁর আরাম-আয়েশের জীবনধারা পাল্টে দিয়েছিল। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলা সৃষ্টি করেছিল। সরকারি ব্যাখ্যায় বঙ্গভঙ্গকে প্রশাসনিক আবশ্যকতা হিসেবে বর্ণনা করা হলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সন্দেহের কোনো অবকাশ রাখেনি যে, তারা বাঙালি মুসলমানদের বৃহত্তর ক্ষমতায়নের সুযোগ দিয়ে বাঙালি হিন্দুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। বহু জাতীয়তাবাদীর কাছে এটি ছিল বিভেদ সৃষ্টি করে ব্রিটিশ শাসনকে চিরস্থায়ী করার প্রচলিত কৌশল।

ক্ষুব্ধ অরবিন্দ ঘোষ বাংলায় ফিরে এসে প্রতিরোধের প্রধান শক্তিতে পরিণত হন। তিনি ব্রিটিশ পণ্য ও প্রতিষ্ঠান বর্জন এবং রেলওয়ে ও পাটকলে শ্রমিক ধর্মঘট সমর্থন এবং ‘অহিংস প্রতিরোধ’ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। অন্যদিকে তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকজনসহ অনেকে সহিংসতা প্রয়োগে প্রস্তুত গোপন সংগঠনে যোগ দেয়। অরবিন্দ ইতিমধ্যে ‘সম্পূর্ণ মুক্তি’ ও ‘প্রজাতন্ত্র’সহ স্বাধীন ভারতের পানে তাকিয়ে ছিলেন, এ বিপ্লবী প্রতিশ্রুতি এমন এক সময়ে ছিল, যখন ইউরোপে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ছিল না। গান্ধী তাঁর ১৯২০-২২ সালের সর্বভারতীয় গণআন্দোলনে এসব কৌশলের অনেক বিষয় প্রতিস্থাপন করেছিলেন। অরবিন্দের রাজনৈতিক প্রভাব নস্যাৎ করার উদ্দেশে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে সহিংসতামূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনে। ডগলাস কিংসফোর্ড নামে এক ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের হত্যা প্রচেষ্টায় অংশ্রগ্রহণের অভিযোগ এনে ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, যে ঘটনা আলীপুর বোমা ষড়যন্ত্র নামে বিখ্যাত। অরবিন্দের আইনজীবী চিত্তরঞ্জন দাস আদালতে যুক্তি প্রদর্শন করেন, ‘অরবিন্দ দেশপ্রেমের কবি... জাতীয়তাবাদের বাণী প্রচারক এবং মানবতার প্রেমিক, কোনো ঘাতক নন।’ ঘটনাক্রমে বিচারক সি, পি বিচক্রফট কিং’স কলেজে অরবিন্দের সহপাঠী ছিলেন। ব্রিটিশ বিচারক ব্যক্তিগত রোষ থেকে মুক্ত ছিলেন এবং অরবিন্দ অভিযোগ থেকে খালাস পান। কিন্তু সংক্ষিপ্ত কারা জীবনে অরবিন্দের মাঝে যে কল্পনা জাগ্রত হয় তা তাঁর আধ্যাত্মিক অভিযাত্রার অনুপ্রেরণা ছিল। তিনি বাংলা ত্যাগ করেন এবং ফরাসি শাসনের অধীন দক্ষিণ ভারতের পন্ডিচেরিতে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। অরবিন্দ একটি লক্ষ্য দ্বারা চালিত হয়েছিলেন : ‘পার্থিব সম্পদ পরিত্যাগ করা, কারণ সেগুলো ঈশ্বরের মালিকানাধীন; ঈশ্বরের মুখ দর্শনের আধ্যাত্মিক আকাক্সক্ষা; এবং ‘ব্রহ্মতেজ’ (ঐশ্বরিক শক্তি) এর মাধ্যমে ব্রিটিশ দানবের কবল থেকে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে এটিকে ‘ধর্মরাজ্য’ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা।

এই লক্ষ্যগুলো স্বয়ংসিদ্ধভাবে গান্ধীর লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। গান্ধী তাঁর ধর্মরাজ্যকে বলেছেন ‘রামরাজ্য’, যেখানে ধর্ম শ্রেণিবদ্ধ বা বিভক্ত দর্শনের চেয়ে বরং ঐক্য সাধনের দর্শন, খাঁটি নৈতিক কর্তৃত্ব ভিত্তিক জনগণের সার্বভৌমত্ব। যার পূর্বশর্ত হিসেবে গান্ধীও সব পার্থিব সম্পদ পরিত্যাগ করেছিলেন। একটি প্রশ্নে গান্ধী এবং অরবিন্দের ব্যাখ্যাও ছিল অভিন্ন : ভারতের ভবিষ্যতের সঙ্গে মুসলিম এবং তাদের অতীতকে কোথায় খাপ খাওয়ানো হবে? উত্তর ছিল ব্যাপক, অংশীদারিত্বমূলক জাতীয়তাবাদ। মুসলিম শাসনের আবির্ভাবকে বিদেশি আক্রমণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হিসেবে বাতিল করা উচিত হবে না। মুসলিম শাসকরা এই ফেডারেল সমন্বয়কে শ্রদ্ধা করে স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন, যার ফলে মুসলিম আধিপত্য অতি দ্রুত বিদেশি শাসনের বৈশিষ্ট্য হারিয়েছিল। বিদেশি অভিজাতরা তাদের মনমানসিকতা, জীবন ও স্বার্থের দিক থেকে ভারতীয় হয়ে ওঠেন, যার সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বার্থের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তাঁর ভাষায় মুঘল সাম্রাজ্য ছিল : “এক মহান ও ঐশ্বর্যপূর্ণ সৃষ্টি- এটি ছিল চমৎকারিত্বে পূর্ণ, শক্তিশালী ও কল্যাণকর এবং এর সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে যে, ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ধর্মোন্মাদনা (ইসলামী) সত্ত্বেও যে কোনো মধ্যযুগীয় বা সমসাময়িক ইউরোপীয় রাজ্য বা সাম্রাজ্যের চেয়ে ধর্মীয়ভাব লক্ষ্যণীয়ভাবে অনেক বেশি উদার ও সহনশীল ছিল এবং মুঘল শাসনাধীনে ভারত সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এবং শিল্পকলা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল।” এর বিপরীতে ব্রিটিশ শাসন ভারতকে সব ক্ষেত্রে দারিদ্র্যে পর্যবসিত করেছিল : “ব্রিটিশরা সত্যিকার অর্থে প্রথম অবিচ্ছিন্ন বিদেশি শাসন ছিল।”

ঐক্য ও পুনর্জাগরণের অনুরূপ একটি তত্ত্ব আরও জোরালোভাবে প্রকাশ করেছিলেন আরেকজন বাঙালি, অসাধারণ জ্ঞানী দার্শনিক-সন্ন্যাসী-বাগ্মী নরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৬৩-১৯০২), যিনি হিন্দু ধর্মে ব্যাপক আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। স্বামী বলতেন, হিন্দু ধর্মের দুর্বলতা, অস্পৃশ্যতা, বর্ণবৈষম্যই ব্রিটেনের সাফল্যের প্রমাণ এবং নানা ধরনের হাস্যকর কুসংস্কারের প্রদর্শন বহু হিন্দুকে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মে আকৃষ্ট করেছে। স্বামী তাঁর বক্তব্যে ক্ষমাহীন ছিলেন : “কোনো মানুষ, কোনো জাতি- অন্যদের ঘৃণা করে বাঁচতে পারে না। যেদিন তারা ‘মেøচ্ছ’ (বহিরাগত, অস্পৃশ্য) উদ্ভাবন করেছে এবং অন্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বন্ধ করেছে, সেদিন থেকে ভারতের ধ্বংস লিখিত হয়ে গিয়েছিল...। পৃথিবীর কোনো ধর্মই এমন অহংকার নিয়ে মানবতার মর্যাদার কথা প্রচার করেনি এবং হিন্দু ধর্ম ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো ধর্মই দরিদ্র ও নীচু অবস্থানের মানুষকে এত হীনভাবে বিচার করেনি...। প্রথম প্রয়োজন খাদ্য এবং এরপর ধর্ম...। কোনো মতবাদই ক্ষুধার তাড়না নিবারণ করে না। এখানে দুটি অভিশাপ রয়েছে : প্রথমত আমাদের দুর্বলতা, দ্বিতীয়ত আমাদের ঘৃণা ...।”

আত্ম-বিকৃতির স্তরের আড়ালে হারিয়ে গেছে হিন্দু ধর্মের চেতনা। ১৮৯৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দ দক্ষিণ ভারতের মনমুদ্রায় শ্রোতৃম-লীর উদ্দেশে বলেন : “আসুন আমরা কাউকে দোষারোপ করব না, আসুন আমরা আমাদের নিজেদের কর্মকে দোষারোপ করি। ...বিগত ৬০০ বা ৭০০ বছরের অবক্ষয়ের কথা ভাবুন, যখন লাখ লাখ বয়স্ক মানুষ বছরের পর বছর ধরে আলোচনা করেছে যে আমরা এক গ্লাস পানি ডান হাত দিয়ে পান করব, না বাম হাত দিয়ে; আমাদের দুই বার বা চার বার হাত ধোয়া উচিত কিনা; আমাদের পাঁচ বা ছয় বার গড়গড়া করা উচিত কিনা... আমাদের অধিকাংশই এখন বেদান্তি নই, পুরাণিক বা তান্ত্রিকও নই। আমরা শুধু ‘আমাদের স্পর্শ কর না’ মতবাদী। আমাদের ধর্ম রান্না ঘরের মধ্যে। আমাদের ভাগবান হচ্ছে রান্না করার হাঁড়ি-পাতিল এবং আমাদের ধর্ম হচ্ছে, ‘আমাকে স্পর্শ কর না, আমি পবিত্র।’ এ অবস্থা যদি আর একটি শতাব্দী চলতে থাকে, তাহলে আমাদের প্রত্যেকের আশ্রয় হবে পাগলা গারদে।”

স্বামী বিবেকানন্দ স্বীকার করেন যে, ইউরোপীয় সমাজ বিস্ময়কর শক্তি অর্জন করেছে, কিন্তু ভারতীয় দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন ভারতীয় ব্যবস্থাপত্র। “আপনারা ভারতের দিকে তাকান, ভারতীয়রা কী দিয়েছে? সর্বত্র চমৎকার মন্দির। মুসলমানরা কী দিয়েছে? চমৎকার প্রাসাদ। ইংরেজরা কী দিয়েছে? মণের পর মণ ব্র্যান্ডির ভাঙা বোতল ছাড়া আর কিছুই নয়!” তিনি যুক্তি দেখান, ইসলামে যদি ভালো কিছু না থাকে, তাহলে কীভাবে এটি টিকে থাকতে পারে?

“মুহাম্মদ ছিলেন সমতার, মানুষের ভ্রাতৃত্বের, সব মুসলিমের ভ্রাতৃত্বের নবী। ...আমাদের মাতৃভূমির জন্য একমাত্র ভরসা হচ্ছে, দুটি মহান বিধান হিন্দুত্ব ও ইসলামের সমন্বয়। আমি আমার মনের চোখে দেখতে পাই যে, এই বিশৃঙ্খলা ও দ্বন্দ্ব থেকে বের হয়ে বেদান্তের মস্তিষ্ক এবং ইসলামের দেহ নিয়ে ভবিষ্যতের খাঁটি ভারত উঠে আসছে।”

সিপাহি বিদ্রোহের ২৮ বছর পর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৫ সালে এবং প্রতিষ্ঠার ৩৫ বছর পর ১৯২০ সালে গান্ধী কংগ্রেসের প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন এবং ১৯২১ সালে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হন। অহিংসায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ গণভিত্তিক জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করতে দলকে তাঁর পুনরাবিষ্কার এত ব্যাপক ছিল যে, যার সঙ্গে তাল মেলাতে বিদ্যমান নেতৃত্ব অনেকাংশেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল। দলের ব্যাপক কর্মতৎপরতার প্রশ্নে গান্ধীর সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত, আইন অমান্যমূলক শান্ত কর্মসূচিতে তাঁর কথাই ছিল শেষ কথা। গান্ধীকে ছাড়া কংগ্রেস ছিল একটি শূন্য খোলস মাত্র, শব্দ সৃষ্টির উপযোগীও নয়। গান্ধী তাঁর অবস্থানের কর্তৃত্বের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলেন। কংগ্রেসকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার চালিকাশক্তিতে পরিণত করা, সামাজিক সংস্কার সাধনের মাধ্যমে ভারতকে শক্তিশালী করে তোলা এবং স্বাধীনতা বা স্বরাজের অভিন্ন লক্ষ্যে সব ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে সমন্বয় সাধন- এ দুটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেন। ১৯২৬ সালের ৮ এপ্রিল তাঁর জার্নাল ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’য় ‘আজকের হিন্দু ধর্ম’র ওপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন :

“হিন্দু ধর্ম গঙ্গার মত, এর উৎসে খাঁটি এবং পরিশুদ্ধ; কিন্তু পথে সব বর্জ্য গ্রহণ করে। এমনকি সামগ্রিক প্রভাবের ক্ষেত্রে এটি গঙ্গার মতোই কল্যাণকর- হিন্দু ধর্মের পবিত্রতা নির্ভর করে এর অনুসারী বা ভক্তের আত্মসংযমের ওপর। যখনই তাদের ধর্ম বিপদে পড়েছে, হিন্দুরা তখন প্রায়শ্চিত্তের কঠোর পরীক্ষার মাঝ দিয়ে গেছে, বিপদের কারণ অনুসন্ধান করেছে এবং সেগুলো মোকাবিলার পন্থা বের করেছে।” এই পন্থাগুলো কী ছিল? অযোগ্যতা ও প্রতিকূলতাকে ঝেড়ে ফেলা ও নিজেকে পুনরাবিষ্কার করা। তিনি যুক্তি দিয়েছেন :

“এক সময়ে প্রাণী বলি দেওয়ার চর্চা করা হতো বলে কি আজ আমাদের তা পুনরুজ্জীবিত করতে হবে? হিন্দু ধর্ম স্থবিরতাকে ঘৃণা করে... হিন্দু ধর্ম এবং অন্য সব ধর্মকে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হচ্ছে। চিরন্তন সত্য একটিই এবং তা হচ্ছে, ঈশ্বর এক।”

১৯১৫ সাল থেকে পরবর্তী তিনটি দশক ধরে কাজ ও দৃষ্টান্ত স্থাপনের মধ্য দিয়ে গান্ধী ভারতীয়দের প্রশিক্ষণ দেন তাদের শক্তি গড়ে তোলার, যাতে যখন তাদের সত্যের মুহূর্ত উপস্থিত হবে, সেই মুহূর্তে একটি শেষ সত্যাগ্রহের জন্য সে প্রশিক্ষণকে কাজে লাগাতে পারে, যা ব্রিটিশকে এদেশ থেকে বিতাড়ন করবে। গান্ধী বিশ্বাস করতেন, ১৯৪২ সালের ১১ এপ্রিল স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার জন্য বিমানে আরোহণের পর সেই সময় উপস্থিত হয়েছে। এপ্রিল ও মে মাস যদি কংগ্রেসকে নির্দেশনা দান ও প্রস্তুত করার কাজে ব্যয় হয়ে থাকে, তাহলে জনগণের কাছে জোরালো বার্তা পৌঁছানোর কাজ শুরু হয়েছিল জুন মাস থেকে। ১৯৪২ সালের ৪ জুন গান্ধী বিকালে এক ঘণ্টা করে ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করেন আমেরিকান সাংবাদিক লুইস ফিশারকে। ফিশার ওয়ার্দার আশ্রমে অবস্থান করেন। গায়ে ফোস্কা পড়ার মতো প্রচন্ড গরম। মহাত্মাকে খোঁচা দেওয়ার উদ্দেশে ফিশার বললেন, তাদের পরবর্তী সাক্ষাৎকার কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্থানে হতে পারে কিনা, সম্ভবত ভাইসরয়ের প্রাসাদে। গান্ধী উত্তর দেন, এ ব্যাপারে তিনি ভেবে দেখবেন। গান্ধী স্মরণ করেন, তাঁর মতে তিনটি ত্রুটি ক্রিপসের প্রস্তাবকে অর্থহীন করেছে। ক্রিপস যে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের প্রস্তাব করেছিলেন, সেটি স্বাধীনতা ছিল না; রাজন্য শাসিত রাজ্যগুলোকে ক্রিপস নিরাপত্তা দিতে চেয়েছিলেন, যা ব্রিটিশদের দ্বারা তাদের নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য নৈরাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখার নামান্তর ছিল এবং ‘পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দান’, যা ক্রিপস তার প্রস্তাবে অনুমোদন করেছিলেন, তা অগ্রহণযোগ্য ছিল। হিন্দু-মুসলিম মতভেদ ছিল ব্রিটিশ নীতির উপজাত পণ্যের মতো, যা ১৯০৯ সালে সূচিত হয়েছিল পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে এবং ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর এটি হারিয়ে যাবে। বিষয়টি ক্রিপস উল্লেখ করেছিলেন : ‘এখন ক্রিপসের প্রস্তাবে তাদের সর্বোচ্চ সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’ ব্রিটিশরা যতদিন এখানে থাকবে ততদিন ভারতে কোনো ঐক্য সৃষ্টি হতে পারে না। যে কোনো অবস্থায় অবিলম্বে ব্রিটিশের ভারত ত্যাগ করতে হবে। গান্ধী ফিশারকে বলেন, “আমি ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতিতে আগ্রহী নই। আমি যুদ্ধের পর স্বাধীনতায় আগ্রহী নই। আমি এখনই স্বাধীনতা চাই।”

(এম জে আকবরের “গান্ধী’স হিন্দুইজম : দ্য স্ট্রাগল অ্যাগেইনস্ট জিন্নাহ’স ইসলাম” থেকে)

সর্বশেষ খবর