বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং বাংলার জনপদ

বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান (এম আর হাসান)

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং বাংলার জনপদ

১৩ অক্টোবর ২০২১ ভোররাতে কুমিল্লার নানুয়া দিঘিরপাড়ের পূজামন্ডপে একটি পবিত্র কোরআন পাওয়া যায়। কোরআন শরিফটি কোনো ব্যক্তি বাইরে থেকে এনে বিগ্রহের ঊরুর ওপর স্থাপন করেছে বলে ধারণা করা হয়। ঘটনা পরবর্তীতে বিগ্রহের ছবি দেখিয়ে এও বলা হয় যে একই সঙ্গে ওই বিগ্রহের হাতে থাকা একটি গদাও অপসারণ করা হয়। কে বা কারা, কখন এবং কী উদ্দেশ্যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে এসব বিষয় জানার আগেই ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে বলে সংবাদ ও গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এর মধ্যে চাঁদপুর-কুমিল্লায় পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং হতাহতের সংবাদও ছিল। বাংলাদেশে এবং দেশের বাইরেও এসব ঘটনা কেন্দ্র করে অনেক যৌক্তিক ও অযৌক্তিক বক্তব্য, নিন্দা প্রকাশ ও প্রতিবাদ এবং এসবের পাশাপাশি অনেক অপপ্রচার, অতিরঞ্জন, উগ্রতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা ইত্যাদি ছিল লক্ষণীয়। ঘটনা পরবর্তীতে ইকবাল নামে জনৈক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা বা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বা উল্লিখিত ঘটনার সত্যতা, কারণ বা বিচার বিশ্লেষণ এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং এ ঘটনা কেন্দ্র করে একটি যৌক্তিক ও প্রত্যাশিত দৃষ্টিভঙ্গি বিনির্মাণ করার একটি বিনম্র প্রয়াস এটি।

আলোচনার শুরুতে বলা প্রয়াজন, এ যাবৎকাল প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ১৩ অক্টোবর রাত ২টা বা ৩টার পর ওই পূজামন্ডপে স্থাপিত হনুমানের বিগ্রহের ঊরুর ওপর পবিত্র গ্রন্থটি কেউ একজন রেখে যায় এবং একই সঙ্গে বিগ্রহের হাত ও কাঁধে স্থাপিত গদা (একটি ভারী দন্ড) অপসারণ করে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি করা হয়।

এখানে এটা স্বীকৃত ও প্রমাণিত যে ওই পূজামন্ডপ ও বিগ্রহ পাহারা দেওয়ার জন্য কেউ ছিলেন না বা কোনো প্রকার পাহারার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এমনকি কোনো সিসিটিভি ক্যামেরাও স্থাপন করা হয়নি ওই পূজামন্ডপে। কারণ হিন্দু বা মুসলিম সম্প্রদায়ের কেউ (এমনকি প্রশাসনও) এ পূজামন্ডপ বা বিগ্রহের কোনোরূপ নিরাপত্তার অভাব ছিল বা ক্ষতির কারণ ছিল বা এখানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার সূত্রপাত হতে পারে এমনটি মনে করেননি। এটাই সত্য। এটাই বাস্তবতা। এ দেশে সাম্প্রদায়িক সুসম্পর্কের এটাই অকাট্য প্রমাণ। এ প্রমাণ কেউ তৈরি করেনি। এ প্রমাণ কোনো পরিকল্পনার অংশ নয়। এ দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার একটি অবিচ্ছেদ্য পরিচয় ও সংস্কৃতি রয়েছে। তা হলো- বাঙালি পরিচয়। বাঙালি সংস্কৃতি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দালনের সূত্রপাত ‘উর্দু ভাষা’ এবং বাংলা ভাষার সংঘাতকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে- ‘বাংলা’ না ‘উর্দু’? ফলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ, জাতীয় পরিচয়, জাতীয় ঐক্য ও ঐতিহ্য হলো এ দেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক চিন্তা, চেতনা ও সমাজবোধের ভিত্তি। এটি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সুসম্পর্কের একটি বাস্তব কারণ। এ ভূখন্ডে বরাবরই জাতিগত পরিচয় আদি ও মৌলিক। কোনো দেশে এরূপ ভাষাভিত্তিক জনগোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশের কথা আমার জানা নেই। যদিও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এরূপ চেতনার উপস্থিতি এবং প্রাধান্য লক্ষণীয়।

অন্য একটি ভিডিও ফুটেজে দেখানো হয়- জনৈক ব্যক্তি (যার নাম বলা হয় ইকবাল) ১৩ অক্টোবর রাত ২টার দিকে কোরআন -সদৃশ একটি গ্রন্থ নানুয়া দিঘিরপাড়ের নিকটস্থ দারোগাবাড়ির মাজারসংলগ্ন মসজিদ থেকে নিয়ে যায়। ধারণা করা হয়, ওই ব্যক্তিই পবিত্র গ্রন্থটি মাজারের মসজিদ থেকে অপসারণ করে রাত ২টার পর কোনো একসময় ওই পূজামন্ডপে বিগ্রহের ঊরুর ওপর রেখে যায় এবং বিগ্রহের হাতে ও কাঁধে স্থাপিত গদাটি নিয়ে যায়। তবে আমার দেখা ওই ভিডিও ক্লিপে এই ব্যক্তিকে পবিত্র কোরআন হাতে পূজামন্ডপে প্রবেশ করতে বা সেখান থেকে গদা হাতে বের হতে দেখা যায়নি। পূজামন্ডপের সামনের রাস্তায় ওই ব্যক্তির আকস্মিক প্রবেশের দৃশ্য দেখা যায় এবং মন্ডপের সামনের রাস্তায় তাকে গদা হাতে মন্ডপ অতিক্রম করে ফ্যাশন শোর মডেলদের মতো কিছুটা এগিয়ে এসে আবার ইউটার্ন নিয়ে বাঁ পাশের (মন্ডপের বিপরীত দিকের) একটি রাস্তায় মিলিয়ে যেতে দেখা যায়। ইকবাল নামের ওই ব্যক্তির পক্ষে এরূপ কাজ করা সম্ভব কি না এ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা হয়। এসব বিষয়ে কোনো আলোচনা করা বা এগুলোর বিষয়ে কোনোরূপ ইঙ্গিত করাও এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কারণ এসব বিষয়ে আমার কোনো প্রত্যক্ষ বা সুস্পষ্ট জ্ঞান নেই।

এ দৃশ্যপটে আমার বক্তব্য হলো- মসজিদের খাদেম, ইমাম বা মুয়াজ্জিন বা মুসলিম সম্প্রদায় কেউ এটা কখনো মনে করেননি যে মসজিদ থেকে পবিত্র কোরআন চুরি বা অপসারণ হতে পারে। তেমনি করে পূজামন্ডপের পূজারি বা আয়োজকরাও মনে করেননি যে সেখানে কোনো প্রকার পাহারার প্রয়াজন রয়েছে।

অর্থাৎ ঘটনা যা ঘটেছে তার পুরোটাই ছিল হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, আস্থা ও অভিজ্ঞতার বাইরের বিষয়। তাদের সন্দেহের বা ধারণার অতীত। এখানেই রয়েছে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের প্রমাণ ও ঐতিহ্য, যা প্রবহমান স্মরণাতীতকাল থেকে।

এ প্রসঙ্গে একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনার কথা বলব। সময়টি ছিল সম্ভবত ২০১৫ সাল। তখন আমি একটি ফৌজদারি ডিভিশন বেঞ্চে প্রিসাইড করছিলাম। তখন একটি মামলার শুনানি চলাকালে প্রসঙ্গক্রমে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম-  মি. ... সূর্য কোন দিক উদিত হয়? তিনি এ রকম একটি সাদামাটা প্রশ্ন শুনে এবং এর প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে না পেরে কিছুটা বিস্ময়ভাব নিয়ে (আমাকে সম্মানসূচক সম্বোধন করে) উত্তর দিলেন, ‘সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়।’ আপনি নিজ চোখে দেখেছেন? ‘জি’। কত বছর যাবৎ দেখছেন? ‘তা ৫৫/৫৭ বছর হবে। অর্থাৎ আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে।’ কিন্তু আমি বললাম, বাস্তবে সূর্য আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে স্থির থাকে। পৃথিবী তার নিজস্ব অক্ষে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তিত হয়। এতে করে আমরা দেখি যে সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায়, আর পৃথিবী তার জায়গায় স্থির আছে। Day and night are due to the Earth rotating on its axis. বিজ্ঞান পরবর্তীতে এটিই প্রমাণ করেছে। অর্থাৎ, আমরা লক্ষ-কোটি মানুষ নিজ চোখে যা দেখছি তা ভুল। ফলে চোখের দেখায়ও ভুল থাকতে পারে। এটা আমাদের মনে রেখে নিরপেক্ষ মন নিয়ে সত্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে হবে। অনুসন্ধানের বিষয় যা-ই হোক না কেন, সত্যে উপনীত হতে হবে এটা মাথায় রেখে যে চোখে দেখা ঘটনা, যা আমরা সত্য বলে মেনে থাকি, তা-ও ভুল প্রমাণিত হতে পারে।

যা হোক উল্লিখিত ঘটনার আলোকে আরেকটি প্রাসঙ্গিক স্মৃতিচারণা করা যেতে পারে। অনিয়মিতভাবে হলেও মাঝেমধ্যে একসময়কার পাঠকপ্রিয় ইংরজি সাপ্তাহিক ‘Dhaka Courier’, বাংলা সাপ্তাহিক ‘বিচিন্তা’ এবং পরবর্তীত সাপ্তাহিক ‘প্রিয় প্রজন্ম’সহ বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে লিখতাম।

সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্মে প্রকাশিত আমার একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘আক্রান্ত প্রেস ক্লাব : ভূলুণ্ঠিত আইনের শাসন’। সম্ভবত ১৯৮৭-এর দিকে লেখা। ঢাকা প্রেস ক্লাবে এক নজিরবিহীন পুলিশি হামলার ঘটনা কেন্দ্র করে লিখেছিলাম।

যা হোক, ১৯৮০-এর দশকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় সনাতন ধর্মের একজন অবতার সম্পর্কে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। এটি কোনো মুসলিম লেখক লেখেননি। যিনি লিখেছেন তার ধারণা তিনি সম্পূর্ণ নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে লেখাটি লিখেছেন এবং এটি তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়। এ লেখাটির কারণে সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের অনেকে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। ওই সময় (এরশাদ সাহেবের শাসনামলে) সরকার ওই সংখ্যাটির প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে এবং ওই সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেয়। চট্টগ্রামের শতাধিক সনাতন ধর্মাবলম্বী বিজ্ঞ আইনজীবী ওই লেখকের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন। এদের নেতৃস্থানীয় ছিলেন চট্টগ্রামের বিজ্ঞ আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত (যিনি বর্তমানে হিন্দু বৌদ্ধ  খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মহাসচিব)। পত্রিকাটি এবং লেখক আইনি সহায়তার জন্য আমার কাছে আসেন। আমি এবং চট্টগ্রাম বারের বিজ্ঞ আইনজীবী ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল (বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি), রানা দাশগুপ্ত, খুরশিদ আলম, আনোয়ার হোসেন, সালাউদ্দিন প্রমুখ প্রায়শই পুরনো বার ভবনের হলরুমে একই টেবিলে আড্ডা দিতাম। ফলে আমাদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক ছিল।

অতএব জনাব রানা দাশগুপ্ত, ওই নিবন্ধের লেখক ও পত্রিকাটিকে আমি বলেছিলাম যে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে মামলাটি তুলে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া আমি ওই নিবন্ধের লেখককে বলি যে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজ বা মানুষের কাছে একটি বিশ্বাসের আবেদন থাকে এবং তিনি সেটাকে বস্ত্রের মতো আঁকড়ে থাকেন ততক্ষণ সেটা নিয়ে টানাটানি করা উচিত নয়। কোনো বস্তু বা বিশ্বাসের উপযোগিতা কখনো ফুরিয়ে গেলে একসময় তা মানুষ বা সমাজ এমনিতেই বর্জন করে। কারোরই উচিত নয় নিজের পরিধেয় বস্ত্র (অর্থাৎ নিজের বিশ্বাস বা মতামত) অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। যা হোক, বিষয়টির আন্তরিক ও সুন্দর সমাধানের লক্ষ্যে আমরা একটি ক্ষুদ্র সমাবেশ ও সফল আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। সময় বিকালবেলা, স্থান চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা নামক স্থানে অ্যাডভোকেট মি. সুভাষ চন্দ্রের বাসভবন। বিশেষ অতিথি ছিলেন মি. জি এস ধর। তখন তিনি চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার। আমি আমার আলোচনার একপর্যায়ে বললাম, স্বাধীনতার আগে, ১৯৭০-এর নির্বাচনকালে যেখানে আমরা বাঙালিরা ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ, আজ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা বাঙালিরা কী করে সংখ্যালঘিষ্ঠ হলাম? আন্তরিক, উষ্ণ এবং সুন্দর পরিবেশে সবকিছু নিষ্পত্তি হয়। অনুষ্ঠান শেষে চা-চক্রের সময় মি. জি এস ধর আমাকে বললেন, আপনি খুব সুন্দর কথা বলেছেন। আমি বললাম, ওটা আমার বিশ্বাস। আমি আমার বিশ্বাসের কথা বলেছি। আমার এ বিশ্বাসকে কেউ যেন নাড়াতে না পারে। বিশেষ করে আজ যখন আমরা প্রায় ১৮ কোটি বাঙালি, যা কি না ১৯৭০-এর তুলনায় দ্বিগুণের বেশি।

            লেখক :  বিচারপতি, হাই কোর্ট বিভাগ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

সর্বশেষ খবর