বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মুরাদের পদত্যাগ নারীবাদী আন্দোলনে এক মাইলফলক

তসলিমা নাসরিন

মুরাদের পদত্যাগ নারীবাদী আন্দোলনে এক মাইলফলক

বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান যখন বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ফিরে পেতে চেয়েছিলেন, তাঁর প্রতি ধর্মান্ধরা ক্রুদ্ধ হলেও আমার শ্রদ্ধা জেগেছিল। কিন্তু সেই শ্রদ্ধা পরে মুখ থুবড়ে পড়েছে যখন তিনি বিরোধী দলের নেত্রীর নাতনি জাইমা রহমান সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করলেন। বললেন জাইমা রহমান ‘লুইচ্চা, কুলাঙ্গার’। বললেন ‘কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে প্রতি রাতে না ঘুমোলে জাইমার ঘুম হয় না’।

জাইমা রহমান রাতে একা ঘুমোবেন নাকি কারও সঙ্গে ঘুমোবেন, সে সম্পূর্ণই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাঁর প্রেমিক বা শয্যাসঙ্গী কৃষ্ণাঙ্গ না শ্বেতাঙ্গ, সেও তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। প্রতি রাতে তিনি একজনের সঙ্গে ঘুমোবেন না দশজনের সঙ্গে ঘুমোবেন সেও তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তিনি যদি কারও ইচ্ছের বাইরে জোর জবরদস্তি কাউকে বিছানায় না নেন, তাহলে কারও অভিযোগ করার কিছু নেই। প্রতিমন্ত্রীর নারীবিদ্বেষ আর বর্ণবিদ্বেষ, ভয়ঙ্কর।

যখনই বাংলাদেশের ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত প্রগতিশীল পুরুষদের দেখি, ভেবে নিই ওরা হয়তো মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, হয়তো নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাসী। কিন্তু দু-একদিন পরই টের পাই জিহাদিরা যেমন নারীবিদ্বেষী, তাদের অনেকেই একই রকম নারীবিদ্বেষী।

মুরাদ হাসান কিন্তু শেখ হাসিনার ভীষণ ভক্ত, হাসিনার জন্য তিনি মরতে পর্যন্ত পারেন বলেছেন। আমার আশঙ্কা হয়, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে তিনি হয়তো ভোল পাল্টাবেন। যতই হোক, শেখ হাসিনা তো নারী। নারীবিদ্বেষীরা তো কোনও নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় না।

জাইমাকে নিয়ে তাঁর অশ্লীল মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছি বলে মুরাদ হাসান আমার বিরুদ্ধে এক সাক্ষাৎকারে চূড়ান্ত অশ্লীলতা করলেন। যতই জামায়াতবিরোধী কথা বলুন না কেন, লোকটি আসলে জামায়াতপন্থী। আমাকে চেনেন না, জানেন না, আমার কোনও বই পড়েননি, আমার আদর্শ আর বিশ্বাসের, আমার সততা এবং সংগ্রামের কিছুই না জেনে আমার সম্পর্কে বিজ্ঞের মতো বলে গেলেন কতগুলো কুৎসিত মিথ্যে। ঠিক জামায়াতিরা যা বলেন এবং যেভাবে বলেন। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী? আমি নাকি কাপড় তুলে বা খুলে কোথাও প্রশ্রাব করেছি। প্রশ্রাব করলে তো কাপড়ে করা ঠিক নয়, কাপড় খুলে বা তুলেই করতে হয়। আমাকে প্রশ্রাব করতে দেখেছেন জামায়াতিরা, ওয়াজিরা আর মুরাদ হাসান। আমি নিশ্চয়ই তাহলে এমন জায়গায় প্রশ্রাব করেছি যেখানে জামায়াতিরা আর ওয়াজিরা ভিড় করেছিলেন, আর তাঁদের দোসর হিসেবে মুরাদ হাসান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তা না হলে ওঁরা সবাই আমাকে কী করে প্রশ্রাব করতে দেখলেন!

জামায়াতিরা যেভাবে আমার বয়ফ্রেন্ডের সংখ্যা গোনেন, ঠিক একই ভাবে মুরাদও গুনেছেন। আমার নাকি অনেক বয়ফ্রেন্ড। তা থাকুক না অনেক। আমি তো পুলিশ, এনএসআই, ডিজিএফআই ইত্যাদি পাঠিয়ে কোনও পুরুষকে জোর করে, বেঁধে, থ্রেট করে তুলে এনে বয়ফ্রেন্ড বানাইনি! মাহিকে মন্ত্রী যেমন নিজের সম্পত্তি ভেবেছেন, তেমনি দেশের তাবৎ মেয়েকেও হয়তো নিজের সম্পত্তিই ভেবে নিয়েছেন, তাই মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড নিয়ে তাঁর এত মাথাব্যথা।

ধর্ষক মুরাদ বললেন, আমাকে কোনও দেশই নাগরিকত্ব দেয় না। এও জামায়াতি স্টাইলের মিথ্যে। প্রশ্ন হলো, অন্য দেশের আমাকে নাগরিকত্ব দিতে হবে কেন? আমি তো একটি দেশের নাগরিক, যে দেশে ধর্ষক মুরাদ বহাল তবিয়তে বাস করছেন! আমি যে দেশের বাইরে, আমাকে যে আমার দেশে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে মুরাদের সরকার, এ কি আমার অপমান? নাকি তাদের, যারা ক্ষমতায় বসে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমার নাগরিক অধিকার অন্যায়ভাবে লঙ্ঘন করছে আজ সাতাশ বছর! ধর্ষকদের দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের জায়গা হয় না। হয়তো এ কারণেই আমার জায়গা হয় না। আর আমার জায়গা হয় না বলে ধর্ষকদের সে কী আনন্দ!

এরপর লোকটির ফোনালাপ শুনলাম। কারও পা চাটতেও লোকটির লজ্জা নেই, কাউকে ভয় দেখাতে, হুমকি দিতে, অশ্লীল গালিগালাজ করতে, কাউকে ধর্ষণ করতেও লজ্জা নেই। মন্ত্রী থাকাকালীন মুরাদ হাসান খুব ব্রুটালি চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। আমরা যারা তাঁর সেই ফোনালাপ শুনেছি, তারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে লোকটি অসংখ্য মেয়েকে ধর্ষণ করেছেন। তাঁর চালচলন আচার ব্যবহার কথাবার্তা সব বলে দেয় যে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। তাঁর ঔদ্ধত্য দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয়। কে তাঁকে এত বর্বর আর নৃশংস হওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছে? আমরা নিশ্চয়ই জানি। রাষ্ট্র ক্ষমতা তাঁকে এমনই আশকারা দিয়েছে যে তিনি ভেবেছেন তিনি আকাশে উঠেছেন, আসলে তিনি কিন্তু পাতালে নেমেছেন।

ক্ষমতাধর পুরুষেরা নারীদের কীভাবে যৌন হেনস্থা করেন, অপমান-অপদস্থ করেন, তা মুরাদ হাসানের এক ফোনালাপেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফোনে মনে হচ্ছিল ক্ষমতা কথা বলেছেন এক নারীর সঙ্গে, দম্ভ কথা বলেছেন এক রমণীর সঙ্গে, অত্যাচারী রাজা কথা বলেছেন এক প্রজার সঙ্গে, ধর্ষক কথা বলছেন তাঁর শিকারের সঙ্গে। ক্ষমতাধরদের ভয়ে সাধারণ মানুষ কী রকম তটস্থ থাকেন, তা ইমন আর মাহির কণ্ঠস্বরই বলে দেয়। ওঁরা ঠিক সাধারণ মানুষ নন, রীতিমতো নামি শিল্পী। ওঁদেরই যদি এই হাল, তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে, অনুমান করেই শিউরে উঠি।

এত দ্রুত নারীকে যৌন হেনস্থা করার বিচার কখনও হয়েছে বাংলাদেশে? আসলে দ্রুত তো দূরের কথা, অতি ধীরেও নির্যাতিত মেয়েরা সুবিচার পায় না। হাজারো নারী যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছে প্রতিদিন, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, কজন নারীনির্যাতক আর ধর্ষকের বিচার হয়? সব ধরনের অপরাধীই টাকা পয়সার জোরে বা প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় পার পেয়ে যায়। নারীবিদ্বেষীদের দেশে অভূতপূর্ব একটি ঘটনা ঘটলো বটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিমন্ত্রী মুরাদকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। বীভৎস চরিত্রের অধিকারী মুরাদ হাসান পদত্যাগ করলেন বটে, কিন্তু তিনি জাতীয় সংসদে, এবং আওয়ামী লীগে বহাল তবিয়তেই বহাল রইলেন।

এই ঘটনার পর আমরা কি ভেবে নেব শেখ হাসিনা নিজে নারীবাদী আদর্শে বিশ্বাস করেন? আমি অন্তত তা মনে করি না। বিশ্বাস করলে তিনি আমার পুরস্কারপ্রাপ্ত নারীবাদী বই ‘আমার মেয়েবেলা’ অশ্লীলতার দোষ দিয়ে নিষিদ্ধ করতেন না, আর গত চার দশক ধরে নারী নির্যাতনের বিপক্ষে এবং নারীর অধিকারের পক্ষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লেখালেখি করা আমাকে আমার নিজের দেশে প্রবেশে বাধা দিতেন না। তিনি খালেদা জিয়ার সমালোচনা করেন বটে, তবে খালেদা জিয়া আমার বিরুদ্ধে যা করেছেন, অবিকল তা-ই তিনি অনুসরণ করছেন।

মুরাদ হাসান নারীনির্যাতক, ধর্ষক। ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোতে কি এমন চরিত্র আর নেই? জানি অনেকে সমস্বরে বলে উঠবে, নিশ্চয়ই আছে। কজনকে মুরাদ হাসানের মতো পদচ্যুত করবে সরকার? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে-এই আশংকা তো আছেই। কোনও ভিডিও ভাইরাল না হলে, কারও বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষেপে না উঠলে সবই যেমন আছে, তেমন থাকবে। কিন্তু ভিডিও বা ফোনালাপ ভাইরাল হলে, চারদিক থেকে মানুষ ছিঃ ছিঃ করলেই তো সরকার রিয়্যাক্ট করে না। বাকস্বাধীনতা বিরোধী ৫৭ ডিজিটাল এক্ট নিয়ে তো কম ছিঃছিঃ হচ্ছে না, সরকার কি সেই আইন বাতিল করেছে? তা তো করেনি। মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণ, আমার যা মনে হয়, বিশ্বজুড়ে মী টু আন্দোলনের ফলে যৌনহেনস্থা করে হোমড়া চোমড়া কেউই যে রেহাই পায়নি সেটা থেকে কিছুটা শিক্ষা, তাছাড়া দীর্ঘকাল যাবৎ নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীবাদীদের সংগ্রামের প্রভাব সমাজে কিছু হলেও পড়েছে। তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগ পর্যন্তও নারীকে ধর্ষণের হুমকি দিলে আমার মনে হয় না প্রভাবশালী লোকদের ওপর মানুষ ক্ষুব্ধ হতো। তখন বলতো, ধর্ষণের হুমকিই তো শুধু দিয়েছে, ধর্ষণ তো আর করেনি। আর যদি ধর্ষণ করে, তাহলে বলতো, মেরে তো আর ফেলেনি, ধর্ষণই তো করেছে শুধু, ওই ধর্ষণে মেয়েটির আপত্তি ছিল কে বলল, যদি প্রমাণ হয় মেয়েটির আপত্তি ছিল তাহলেও বলত, মেয়েদের না মানে হ্যাঁ, সে তো সবাই জানে; যদি প্রমাণও মেলে মেয়েটি সত্যিই চিৎকার করেছিল, বাধা দিয়েছিল, তাহলে বলতো, পুরুষের টেস্টোস্টেরোন হরমোনের কারণে সেক্সড্রাইভ একটু বেশিই। তখন দোষ দিলে আর ধর্ষক পুরুষকে নয়, সৃষ্টিকর্তাকেই দোষ দিতে হয়, সে কারণে সকলে নিশ্চুপ থেকেছে।

মুরাদ হাসান স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি। তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। পদত্যাগপত্রে লিখেছেন তিনি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর কুকীর্তি এবং অশ্লীলতার কথা পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করা উচিত ছিল। অথবা রাষ্ট্রপতির উচিত ছিল সেসব উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়ে তাঁকে মন্ত্রীপরিষদ থেকে বহিষ্কার করা।

আমার মনে হয় না মুরাদ হাসান তাঁর কুকীর্তি বন্ধ করবেন। তিনি সংসদ সদস্য পদও হারাননি, দেশের সবচেয়ে বড় এবং ক্ষমতাশালী পার্টির সদস্য পদও তাঁর এখনো বাতিল হয়নি। এরপর আর তিনি কাঁচা কাজ করবেন না, পাকা কাজই করবেন। যেভাবে অন্য প্রভাবশালীরা করে থাকেন। খুব বেশি কিছু প্রমাণ থাকে না ধরা পড়ার।

 লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর