বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

কাদের বিজয় উৎসব করে বাংলাদেশ?

তসলিমা নাসরিন

কাদের বিজয় উৎসব করে বাংলাদেশ?

একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে   বাংলাদেশ জয়ী হয়েছিল। এ আমরা সকলেই জানি। পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যরা এ দেশ ছেড়ে মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল। এও আমরা জানি। কিন্তু যে আদর্শের জন্য বাংলাদেশ যুদ্ধ করেছিল, সেই আদর্শের কতটুকু বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পর অবশিষ্ট আছে? এই প্রশ্নের উত্তর কে কেমন ভাবে দেবে, আমি জানি না। তবে আমি জোর গলায় বলবো, প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। প্রায় কিছুই অবশিষ্ট যে নেই, তার হাজারো উদাহরণ আছে। একটি উদাহরণ তো আমিই। আমি তো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে একশত ভাগ বিশ্বাস করি, এবং সেই আদর্শেই আমি জীবন যাপন করি, লেখালেখি করি, অথচ সেই দেশে আমার কোনও স্থান নেই। সেই দেশে বাস করার কোনও অধিকার আমার নেই। আমাকে খালেদা জিয়া ১৯৯৪ সালে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলেন, মৃত্যুশয্যায় থাকা মা’কে দেখার জন্য   শেখ হাসিনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমি দেশে ঢুকেছিলাম বটে, কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে খালেদা জিয়ার মতো একই কায়দায় শেখ হাসিনা আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলেন। আজ ২৭ বছর আমি আত্মীয় পরিজনহীন, বন্ধু বান্ধবহীন, ঘর বাড়িহীন জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছি।

আমি কি মুক্তিযুদ্ধে শত্রু সৈন্যদের সহযোগী আলবদর, রাজাকার, আলশামসের কেউ ছিলাম? না, আমি নিতান্তই শিশু ছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রবল সমর্থক ছিলাম  এবং আমার পরিবারের অনেকেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমি কি বড় হয়ে খুনী ধর্ষক চোর ডাকাত হয়েছিলাম? না, আমি একটি সেক্যুলার শিক্ষিত পরিবারের চিকিৎসক পিতার সন্তান চিকিৎসা বিজ্ঞান অধ্যয়ন করে চিকিৎসক হয়েছিলাম। বছরের পর বছর  গ্রাম গঞ্জের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সরকারি চিকিৎসক হিসেবে স্বাস্থ্য সেবা দিয়েছি, এমনকী ঢাকা শহরের সরকারী  হাসপাতালগুলোয় অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার মহান কাজে দিবস রজনী ব্যস্ত থেকেছি। চিকিৎসার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা ছিল আমার অন্যতম শখ। কৈশোর থেকে কবিতা লিখি। আর আমার গল্প উপন্যাস নিবন্ধ  প্রবন্ধের বিষয় কী ছিল? বাংলাদেশের সংবিধানে যা ছিল, তার সবকটা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ; ছিল নারী-পুরুষের সমতা, মানবাধিকার, মানবতা। ছিল ধর্মান্ধতার, নারীবিদ্বেষের, সন্ত্রাসের, আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। পাকিস্তানপন্থী, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী, নারীবিদ্বেষী ধর্মান্ধ অপশক্তি আমার বিরুদ্ধে খুব স্বাভাবিকভাবেই সরব হয়ে উঠলো। আসলে  ব্যক্তি আমি তাদের টার্গেট ছিলাম না, সবই ছিল নিরীহ আমাকে উপলক্ষ করে রাজনৈতিকভাবে তাদের সবল হয়ে ওঠার ফন্দি। এই ফন্দির বিষয়ে বাংলাদেশের খালেদা সরকার জানতেন, হাসিনা সরকারও জানতেন। তাঁরা কেউ আমার পাশে দাঁড়াননি, দাঁড়িয়েছেন ওই পাকিস্তানপন্থী ধর্মান্ধ অপশক্তির পাশে। আমাকে হারিয়ে দিয়ে, তাদের তাঁরা জিতিয়ে দিয়েছিলেন। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সমস্ত সুযোগ এবং সুবিধে তাদের   দিয়েছিলেন আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়ে। শুধু তাই নয়, অপশক্তিকে খাতির যত্ন করে সংসদে বসিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তিকে দেশের সব সরকারই নত হয়ে কুর্নিশ করেছেন। তাদের দাবি এক এক করে মেনে নিয়েছেন। নিজেদের গড়ে তুলেছেন তাদেরই আদলে। সরকারে বসলে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম এবং শত ইসলামি গোষ্ঠী যা করতো, তা-ই আশির দশকের জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে হালের শেখ হাসিনা করে যাচ্ছেন।

আমার পরিবার পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছিল। আমার বাবাকে অকথ্য নির্যাতন করার পর  প্রায় মৃত অবস্থায় বাড়ির বাইরে ফেলে রেখেছিল সৈন্যরা। বাড়িতে ঢুকে আমাদের সব সোনাদানা টাকা পয়সা লুঠ করে নিয়ে গিয়েছিল। তরুণীদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছিল। আমার পরিবারই আবার অত্যাচারিত হয়েছে তথাকথিত স্বাধীন বাংলাদেশে। শত্রু সৈন্যদের দোসর দ্বারা, তাদের উত্তরসূরি দ্বারা,   পাকিস্তানের ধর্মীয় রাজনীতির সমর্থক দ্বারা। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষক, চিত্র পরিচালক, সুরকার, গায়ক, যাঁরাই ছিলেন বাঙালির গৌরব, তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। ঠিক সেভাবেই প্রগতিশীল মানুষকে হত্যা করার টার্গেট করেছে পাকিস্তানপন্থী ধর্মান্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী। এই জঙ্গিদের সমর্থক আজ সারা বাংলাদেশে নেহাত কম নয়। নেহাত কম নয় ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধ গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীকেই আজ মদদ করছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের পতাকা আজ অপশক্তিও ওড়ায়। কারণ তারা জানে পাকিস্তানের ধর্মীয় রাজনীতির আদর্শেই বাংলাদেশ সরকার দেশ শাসন করছে। সে কারণেই আজ সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম স্থান পেয়েছে, নামকাওয়াস্তে আছে গণতন্ত্র, পারিবারিক আইন সমানাধিকারের ভিত্তিতে নয়, ধর্মের ভিত্তিতে যেমন ছিল পাকিস্তান আমলে, আজও তেমনই আছে। অমুসলমানের ওপর হামলা চলে ক’দিন পর পর। পাকিস্তানেও ঠিক তাই। গত পঞ্চাশ বছরে বিভিন্ন সরকারের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে একটি দ্বিতীয় পাকিস্তান। অবিকল পাকিস্তানের আদলে গড়ে তুলেছে পাকিস্তান থেকে যুদ্ধ করে পৃথক হওয়া হাজার মাইল দূরের এই ভূখন্ড। আজকের বিজয় দিবস রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং তাদের মন্ত্রে মগজধোলাই হওয়া অগুনতি ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীর।  একাত্তরে হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের বিজয়। আজ হচ্ছে ধর্মান্ধ মানুষের বিজয়। এই বিজয় আমার নয়। এই বিজয় লক্ষ লক্ষ মসজিদ মাদরাসার পৃষ্ঠপোষকদের, এই বিজয় নারীবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী ওয়াজ ব্যবসায়ীদের, এই বিজয় রাজাকার এবং তাদের উত্তরসূরিদের। একাত্তরে বাংলাদেশের ভেতরে একটি ক্ষুদ্র পাকিস্তান ঘাঁপটি মেরে বসে ছিল, সেই পাকিস্তানটি গায়ে গতরে বড় হয়ে এখন দৈত্যের আকার নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, সভ্যতা, এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সেই পাকিস্তানের বিজয় হয়েছে, তাদের বিজয় উৎসব সে কারণেই।

আমাকে আমার দেশ থেকে উৎখাত করেছে বাংলাদেশের সরকার। যাঁরা প্রগতিশীল-ধর্মনিরপেক্ষতায়, নারীর সমানাধিকারে এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, তাঁদের খুন করেছে পাকিস্তানপন্থী ধর্মান্ধ বাহিনী। সরকার সেই খুনীদের গ্রেফতার করায়, বিচার করায় অনীহা দেখিয়েছে, নৃশংসতার বিরুদ্ধে রুখে ওঠায় অনীহা দেখিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী। যাঁরা প্রগতিশীল, তাঁরা দেশ ছেড়ে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। যাঁরা দেশে আছেন, তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটে বেঁচে আছেন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র শুধু পাকিস্তানপন্থী রাজাকারপ্রেমী শিশুধর্ষক নারীবিদ্বেষী হিন্দুবিদ্বেষী খ্রিস্টান-বৌদ্ধবিদ্বেষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ আমি, আমার জন্য কোনও নিরাপত্তা নেই বাংলাদেশে। আমার আশংকা হয়, সরকারের সহযোগিতায় এবং আশকারায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়েও একটি ভয়ংকর জঙ্গিরাষ্ট্র হয়ে উঠবে, যে রাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি প্রাণীরও জীবনের কোনও নিরাপত্তা থাকবে না। সকলকে মরতে হবে, অথবা দেশ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে। মানুষ স্বীকার করুক বা না করুক, গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের এমনই করুণ পরিণতি হয়েছে।

দেশের নামটি এখনও বাংলাদেশ, জাতীয় সঙ্গীত এখনও রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা। বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মারমুখো লোকেরাই একদিন এই জাতীয় সঙ্গীত বদলে দেবে। এই আশংকার কারণ তো জলজ্যান্ত। দেশে সবচেয়ে বড় মিছিলটি কাদের হয় আমরা দেখেছি, দেশের কোন শক্তির কাছে সরকার মাথানত করে আমরা দেখেছি, কাদের অন্যায় দাবি সরকার মেনে নেয় আমরা জানি। দেশ কোন পথে এগোচ্ছে তাও কারও অজানা নয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এখন সংখ্যালঘু, বিশ্বাস না হয় জরিপ করে দেখা হোক।

পাকিস্তানেও এত ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে এভাবে কুপিয়ে  হত্যা করেনি কেউ। পাকিস্তানে কি নাস্তিক নেই? প্রচুর আছে। তাঁদের এত দুর্দশা হয়নি ওই দেশটিতে, যত হয়েছে বাংলাদেশে। কোনও লেখককে কি আমার মতো ধরে বেঁধে পাকিস্তানের কোনও সরকার বের করে দিয়েছে? দেয়নি। যে প্রগতিশীল লোকেরা পাকিস্তানের কোনও সরকারের শাসনামলে দেশ থেকে নিরাপত্তার জন্য বেরিয়ে গেছে, তারাও সরকার বদল হলে দেশে ফিরতে পারে। মানববাদী এক লেখক আমি, আমাকে  কিন্তু কোনও সরকারের শাসনামলেই দেশে ফিরতে দেওয়া হয় না। দীর্ঘ বছর ধরে একটি অন্যায় ঘটে চললে লোকে অন্যায়টিকে স্বাভাবিক ধরে নেয়। আমার বিরুদ্ধে ২৭ বছর ধরে যে অন্যায় করে চলেছে একের পর এক সরকার, এটিকেই দেশের লোকেরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছে।

৩০ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে যে দেশ আমরা পেয়েছিলাম, সেই দেশে এখন বিজয় উৎসব কারা করে? কোন আদর্শকে বাঁচায়ে রাখতে এই উৎসব?   মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি অস্ত্রের জোরে সরকারে আছে বটে, কিন্তু সেই শক্তি এখন সংখ্যালঘু। যে রাজাকার এবং পাকিস্তানপন্থী ধর্মান্ধ অপশক্তি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেশময়, তারাও ঢুকে গেছে ক্ষমতার দলে। তাদের কাছে নত হওয়া সরকার এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অনেকটাই   কেটে ছেঁটে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে উড়িয়ে দিয়ে, ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন বজায় রেখে আপোষ করে চলেছেন। জানি না এই বিজয় দিবস কতদিন অবধি পালন করা সম্ভব। আমার আশংকা হয় একদিন একাত্তরের শত্রু সেনাদের দোসর এবং তাদের উত্তরসূরিরা বিজয় দিবস আর পালন করবে না, দেশটি অন্ধকারে ডুবে যাবে, পাকিস্তানে আর কতই বা অন্ধকার, তারও চেয়ে বেশি অন্ধকার গ্রাস করবে এই দেশকে। অনেকটা আফগানিস্তানের মতো। আমার প্রিয় দেশকে তখন হয়তো চিরকালের জন্য বিদায় জানাবো আমি, এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব নাগরিক।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর