শনিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

কেন কঠোর অবস্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

সৈয়দ বোরহান কবীর

কেন কঠোর অবস্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

ঘটনাটি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। হঠাৎ করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল। ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এ নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দফতর। যাঁদের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা তাঁরা সবাই দক্ষ, মানবিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। ক্রসফায়ার দূরের কথা এসব কর্মকর্তা জনগণের প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশের জন্য নানাভাবে আলোচিত। যেমন পুলিশপ্রধান (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের কথাই ধরা যাক। আইজিপির দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি পুলিশের মনোজগতে পরিবর্তন আনার কাজ করছেন। পুলিশকে মানবিক করার ক্ষেত্রে তাঁর বেশ কিছু উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালে পুলিশ যেভাবে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে তা গর্ব করার মতো। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ, সাইবার জগতে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধেও বেনজীর আহমেদ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। তা ছাড়া র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাব সম্পর্কে যারা ন্যূনতম জ্ঞান রাখেন তারা জানেন, র‌্যাবপ্রধান কখনো অপারেশনে যান না। তাই শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর কেন এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো তা এক রহস্যময় ব্যাপার।

বাংলাদেশে ‘ক্রসফায়ার’ কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হয় কি না- এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দীর্ঘদিনের। র‌্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে। ২০০৫ সালে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ছিলেন কর্নেল চৌধুরী ফজলুল বারী। সে সময় র‌্যাবের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ উঠেছিল। উইকিলিকসের তথ্যানুযায়ী সে সময় কর্নেল ফজলুল বারীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মার্কিন দূতাবাসে। কর্নেল বারী ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন। মার্কিন দূতাবাসও তা পরোক্ষভাবে কবুল করেছিল। পরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে সোচ্চার থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেমন মাথা ঘামায়নি। ২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ফজলুল বারী তখন কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার হন। দায়িত্ব নেন ডিজিএফআইয়ের। ওয়ান-ইলেভেনে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তাঁর মধ্যে ফজলুল বারী অন্যতম। এবার তিনি দেখা করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটিনেসের সঙ্গে। এ বৈঠকেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু এসব ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সে সময় কোনো কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেনি। বরং ফজলুল বারী এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটেছে ২০০১ থেকে ২০০৩ সালে, ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’-এর মাধ্যমে।

র‌্যাব প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবসে। অপারেশন ক্লিনহার্টে যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটে তাকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বিবৃতি দিয়েছিল। ব্যস এটুকুই। অপারেশন ক্লিনহার্টের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কারও ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়নি। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত র‌্যাব বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। এ সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন র‌্যাব নিষিদ্ধের দাবি করে। কিন্তু র‌্যাব কিংবা ক্রসফায়ার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তেমন উদ্বিগ্ন দেখা যায়নি। ২০০৫ সালে র‌্যাবকে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে র‌্যাব আধুনিকীকরণে অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়ার বিষয়েও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময়ও র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার ইশতেহারে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও ক্রসফায়ারের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি’ ঘোষণা করে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন যেহেতু র‌্যাব বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় প্রতিষ্ঠিত, তাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে র‌্যাব বিলুপ্ত হতে পারে। এ রকম একটি দাবিও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা র‌্যাব বিলুপ্ত করেননি। বরং একে আরও শক্তিশালী করেছেন। র‌্যাবের পরিধি বেড়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, র‌্যাবের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ এখন অনেক কমে এসেছে। র‌্যাব এখন সুন্দরবনে জলদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা, মাদকবিরোধী অভিযান, জঙ্গি দমনের জন্য আলোচিত এবং প্রশংসিত।

১৭ বছরে র‌্যাব নিজেদের অপরিহার্য একটি সংগঠনে পরিণত করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোয় র‌্যাবের প্রচুর সমালোচনা হয়, এটা সত্যি। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় এই এলিট ফোর্সটি। আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্রসফায়ারসহ কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যা সমর্থন করি না। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটু কথা বললে দেখা যায়, কিছু ভয়ংকর অপরাধীর ব্যাপারে ক্রসফায়ার যৌক্তিক বলে তারা মনে করে। ক্রসফায়ার এখন একটি জনপ্রিয় বোল হয়েছে। প্রকাশ্যে কেউ অপরাধ করছে- সাধারণ মানুষ বলছে, ‘একে ক্রসফায়ারে দেয় না কেন?’ পত্রিকায় কারও দুর্নীতির খবর পড়ে সাধারণ মানুষ বলে, ‘এগুলোকে ক্রসফায়ারে দিলে দেশটা ঠিক হবে।’ দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ মনে করে চিহ্নিত অপরাধী, দুর্নীতিবাজ দমনে ‘ক্রসফায়ার’ উত্তম পন্থা। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, আইনি প্রক্রিয়ার নানা ধাপ এবং জটিলতার কারণে এ দেশে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নিয়ে এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। তাই অনেক নির্যাতিত, নিপীড়িত এবং সাধারণ মানুষ দীর্ঘ বিচারের পথের চেয়ে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড সমর্থন করে। একটি মানবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটি কাম্য নয়, কিন্তু এটিই বাস্তবতা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধীরে ধীরে এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে র‌্যাবের বিরুদ্ধে যত বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ উঠেছিল, গত দুই বছরে (২০২০-২০২১) তা তিন-চতুর্থাংশ কমে এসেছে। এটি বিরাট অর্জন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধে শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা, দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি, সাক্ষী সুরক্ষাসহ ১১টি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ক্রসফায়ার এখন প্রধান ইস্যু নয়। প্রশ্ন হলো, যখন র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যা সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে ঠিক তখনই কেন সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো? এ প্রশ্নের উত্তরে নানা জন নানা মত দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার মানবাধিকার রক্ষায় কী করছে, সেই বার্তাটা কি মার্কিন প্রশাসন ও বিশ্বকে যথাযথভাবে দিতে পারছে। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশকে গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ না জানানো, সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পেছনে একটি রাজনৈতিক কার্যকারণ রয়েছে। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের দূতাবাস কী করল?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষর করে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করল তখন স্বাধীন-সার্বভৌম জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নির্লিপ্ত! জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক। শুরুতেই তিনি মানবাধিকার কমিশনকে একটি তৎপর স্বাধীন সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন মানবাধিকার ইস্যুতে তিনি সরব ছিলেন। ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ মানবাধিকারের প্রতিটি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেন। অনেক সময় মনে হয়েছিল তিনি বোধহয় সরকারের প্রতিপক্ষ। কিন্তু ড. মিজান দেখিয়ে দিয়েছিলেন একটি স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন মানবাধিকার কমিশনের কাজ কী হওয়া উচিত। একদিকে দেশে সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করেছেন, প্রতিকারের জন্য দৌড়ঝাঁপ করেছেন; অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফোরামগুলোয় বাংলাদেশের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। জেনেভায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার বৈঠকে তিনি যেভাবে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছিলেন তা অনন্য, ঐতিহাসিক। ফলে দেশে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মহল তথ্য-উপাত্তের জন্য জাতীয় মানবাধিকারের ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করে। কিন্তু ড. মিজানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এই স্বতন্ত্র কমিশনটি চলে গেল আমলাদের দখলে। আমলারা চোখ বন্ধ করে রাখেন। সরকারকে সন্তুষ্ট করতে চাটুকারিতায় মনোযোগী হন। স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় সরকারের একান্ত অনুগত, পদলেহী সংস্থা। এখন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও একজন আমলা। মানবাধিকার ইস্যুর চেয়ে তাঁর মনোযোগ মন্ত্রীদের খুশি করায়। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বার্তা যাচ্ছে বাংলাদেশে মানবাধিকার কমিশন স্বাধীন নয়। দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদারকি হচ্ছে না। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন বাংলাদেশে বিভিন্ন তথ্যের জন্য নির্ভর করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, অধিকার, ব্লাস্টের মতো এনজিওর ওপর। আমরা যদি মার্কিন নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত বিবৃতিটি ভালো করে পড়ি তাহলে দেখব, এ তথ্যগুলো নেওয়া হয়েছে বেসরকারি সংস্থা থেকে। প্রধানমন্ত্রী কি বলেছেন মানবাধিকার কমিশনকে অকার্যকর করতে? প্রধানমন্ত্রী কি বলেছেন মানবাধিকার কমিশন জাতির পিতাকে নিয়ে গান লিখবে, কবিতা লিখবে? মানবাধিকার কমিশন যখন দেশের মানবাধিকার সুরক্ষার কাজ না করে মুজিববর্ষ উপলক্ষে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করবে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো তথ্যের জন্য এনজিওদের দ্বারস্থ হবেই। এনজিওদের তথ্য দিয়ে তারা যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে দোষটা কার?

প্রশ্ন উঠতেই পারে- একটি এনজিও তথ্য দিল আর মার্কিন প্রশাসন তা যাচাই-বাছাই না করে সিদ্ধান্ত নিল, এটা কীভাবে সম্ভব? বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বে যেন ভুল বার্তা না যায় তা দেখার দায়িত্ব আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস-গুলোর। তারা কি সে দায়িত্ব পালন করছে যথাযথভাবে? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভাগ্যবান ব্যক্তি। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলে তিনি এলেন, এমপি হলেন, মন্ত্রীও হলেন। ছাত্রজীবনে তিনি এনএসএফ করতেন কি না, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গোলটেবিলে যাওয়ার গল্প তিনি কেন ফেঁদেছিলেন, সে প্রশ্নও আমি করব না। এ সরকারে কিছু ব্যক্তি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছেন, ড. মোমেন তাঁদের একজন। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে আট বছর জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি রেখেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের আগে শুনলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর ‘হাই লেভেল’ কানেকশন আছে। তার নমুনা এই! মার্কিন প্রশাসন সম্পর্কে যাঁরা ন্যূনতম ধারণা রাখেন তাঁরা জানেন এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হয়। আমাদের ওয়াশিংটন দূতাবাস একটি বারও জানল না? বাংলাদেশকে যখন গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হলো না তখনই বোঝা গিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভুল বার্তা পাচ্ছে। অথচ তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বক্তব্য দিলেন তা শিশুসুলভ বালখিল্যতাকেও হার মানায়। সাত কর্মকর্তার নিষেধাজ্ঞার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য কূটনৈতিক শিষ্টাচার-বহির্ভূত। আমরা জানি, সরকার জানে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাঙালিরা জানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠীর আত্মীয়স্বজন সক্রিয়। তাদের হাজার হাজার কোটি টাকা রয়েছে। লবিস্ট ফার্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বীকৃত এবং বৈধ। এসব লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় তারা বিরামহীনভাবে কাজ করছে। এমনকি এবার প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘ সফরের সময় তার আলামত দেখা গেল। দেশবিরোধী এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী করেছে আমাদের দূতাবাস, পররাষ্ট্র দফতর? ওয়াশিংটনে দূতাবাস কর্মকর্তাদের কাজ কী? এরা কেতাদুরস্ত কর্মকর্তা সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদের কমিটমেন্ট নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। আমার মনে হয় এ রকম গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় স্মার্ট অফিসারের চেয়ে রাজনীতিমনস্ক কর্মকর্তা জরুরি। এ প্রসঙ্গে একটু উদাহরণ দিতে চাই। কিছুদিন আগে অনুজপ্রতিম শাবান মাহমুদকে ভারতে বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার করা হলো। তার এ নিয়োগে অনেকে আর্তনাদ করে উঠেছিল। শাবান ওখানে কী করবে, ইংরেজি ঠিকমতো বলতে পারে না, কূটনৈতিপাড়ায়ও তার আনাগোনা ছিল না। কিন্তু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে দিল্লিতে শাবান তার ক্যারিশমা দেখাচ্ছে। দিল্লি এবং কলকাতার প্রেস ক্লাবে বঙ্গবন্ধু কর্নার করেছে। ভারতের জাঁদরেল সাংবাদিকদের সঙ্গে শখ্য গড়ে তুলেছে। শাবান পেরেছে, কারণ সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে। শাবান পেরেছে, কারণ এ সরকারের প্রতি তার দায়িত্ববোধ আছে। অনর্গল ইংরেজি বলে স্যুট-টাই পরে ঘুরে বেড়ালেই ভালো ডিপ্লোম্যাট হওয়া যায় না। ভালো ডিপ্লোম্যাট তিনি যিনি নিজের ক্যারিয়ারের চেয়ে দেশের ও সরকারের স্বার্থ দেখেন। তাই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতের মতো স্পর্শকাতর জায়গাগুলোয় এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া উচিত যারা রাজনীতি বোঝেন, সরকারকে হৃদয়ে ধারণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ রকম পদক্ষেপের আগেই বাংলাদেশ দূতাবাসের বিষয়টি জানা উচিত ছিল। এ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তাদের কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করেননি। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন, কোন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস সক্রিয়, সংবেদনশীল সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর কোনো কোনো মহল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নানা কথা বলছে। যে কেউ মার্কিন নীতি ও কৌশলের সমালোচনা করতেই পারেন। খোদ আমেরিকাতেই প্রতিদিন মার্কিন প্রশাসন নানা ইস্যুতে সমালোচনার মুখে পড়ে। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে যেভাবে তুলাধুনা করা হলো তা-ই মার্কিন গণতন্ত্রের শক্তি। কোথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী করছে সে হিসাব বের করে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। দুই দেশের সম্পর্কের তিক্ততা বাংলাদেশের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ১৯৭১-এ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিল। এটা যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য- জন এডওয়ার্ড কেনেডি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। আমরা কি ভুলি ১৯৭১-এর ১ আগস্টের কথা। ওই দিন নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করা হয়েছিল। রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন ওই কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন। এখান থেকে আড়াই লাখ ডলার অর্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। তাই দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলে আমরা যেন সংকটকে আরও গভীর না করি। যুক্তরাষ্ট্রকে প্রকৃত তথ্য বিশ্বাসযোগ্য পদ্ধতিতে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা মিয়ানমার, চীন কিংবা রাশিয়া নই। জাতির পিতা আমাদের বিশ্বনীতির পথরেখা এঁকে দিয়েছেন একটি বাক্যে, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারও সাথে বৈরিতা নয়’। সে আলোকে এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার রেশ টেনে ধরতে হবে। মানবাধিকার কমিশন, তথ্য অধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমলামুক্ত করতে হবে। এগুলোকে স্বকীয় স্বাধীন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা কেবল সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেয়নি, বাংলাদেশের প্রতি এ এক ধরনের অনাস্থা দিয়েছে। তাই সম্মিলিতভাবেই এ ভুল বোঝাবুঝি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববাস্তবতায় কোনো দেশই মার্কিন প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে না। বাংলাদেশ তো নয়ই।

 

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর