শনিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সমুদ্রে প্রসারিত হোক সুনীল অর্থনীতি

শাইখ সিরাজ

সমুদ্রে প্রসারিত হোক সুনীল অর্থনীতি

কেমন হবে আগামীর বাংলাদেশ? কী হবে ৫০ থেকে ১০০ বছর পরের আমাদের খাবারের সংস্কৃতি? গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য সংস্কৃতির পরিবর্তন খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি আমাদের প্রতিদিনের প্রতিবেলার খাবারের থালায় খাদ্য উপকরণ কীভাবে পাল্টে চলেছে। এক সময় যে থালায় ভাতই ছিল প্রধান, সেখানে কখনো কখনো ভাত সরে গিয়ে যুক্ত হয়েছে নানান উপকরণ। ১৯৭১ সালে, দেশ স্বাধীনের পর আমাদের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। এই সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হয়েছি। ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ লাখ টন; যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ। আর আজ এই মুহূর্তে খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুদ ১৫.৭৬ লাখ মেট্রিক টন। জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ষোলো কোটির অধিক। জমি বাড়েনি; বরং কৃষি জমির পরিমাণ দিন দিন কমেছে। তারপরও বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। করোনার মতো মহামারীতে যেখানে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ উতরে গেছে সাফল্যের সঙ্গে। এর পেছনে যেসব অনুঘটক কাজ করেছে তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষকের অক্লান্ত শ্রম, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষির সম্প্রসারণ, কৃষিকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারি নীতি প্রণয়ন, সেচপ্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, কৃষিতে লাগাতার ভর্তুকি, কৃষি গবেষণার সাফল্য, প্রযুক্তির ব্যবহার, বেসরকারি সহযোগিতা, গণমাধ্যমের ভূমিকা, কৃষি খাতে অকৃষি খাতের অবদান ও কৃষিতে শিক্ষিত তরুণের অংশগ্রহণ।

শুধু কৃষি ক্ষেত্রেই নয়, আমাদের উন্নয়ন যাত্রাটা বহুমুখী। অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং সার্বিক যোগাযোগ উন্নয়নে ও ডিজিটাইজেশনে অভূতপূর্ব সাফল্য আমাদের। এই সময়ের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। একটি স্বয়ম্ভর জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্তরগুলো আমরা ক্রমেই পার করে এসেছি। আমরা ক্ষুধাকে জয় করে চলেছি। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২১-এ ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১০১তম ও ৯২তম।

বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের সমুদ্র অর্থনীতি অর্থাৎ ব্লু-ইকোনমি পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। তারই ধারাবাহিকতায় গত মাসে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের কার্যক্রম দেখে আসলাম। এর আগেও বহুবার ওই গবেষণা কেন্দ্রে যাওয়া হয়েছে। সত্যি কথা বলতে প্রতিবারই আশাহত হয়েছি। যেমনটা প্রত্যাশা ছিল কার্যক্রম ততটা ছিল না। সুবিস্তৃত ও আইনগতভাবে অর্জিত বিশাল সমুদ্রসীমা আমাদের সামনে মেলে ধরেছে বহুমুখী সম্ভাবনা। সরকারে শত বছরের ডেল্টা প্ল্যানের মধ্যে এই সমুদ্রসীমার বহুবিধ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ রয়েছে। রয়েছে সুনীল অর্থনীতিকে জাতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করার প্রয়াস। এখনকার তৎপরতাকে খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মউদ্যোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে। নিশ্চিত করে বলা যায়, অনেক নতুন নতুন সম্ভাবনা আমাদের সমুদ্রসীমা থেকে বের হবে, যেগুলো এখনো অজানাই রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামুদ্রিক কেন্দ্রের একদল গবেষক প্রাণির জীবিত খাদ্য নিয়ে গবেষণা করছেন। সামুদ্রিক পরিবেশে খাদ্য শৃঙ্খলের ভিত্তিই হচ্ছে ফাইটোপ্লাংকটন, মাইক্রো অ্যালজি। গবেষকরা জানালেন, মাইক্রো অ্যালজি এককোষী, যা লবণাক্ত বা পরিষ্কার পানিতে জন্ম নেয় এবং সূর্যের আলো থেকে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে তাদের জীবনীশক্তি তৈরি করে। ঝিনুক জাতীয় প্রাণির বৃদ্ধির সব পর্যায়ে, কিছু প্রাণির লার্ভা পর্যায়ে এবং কিছু মাছের প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়ে মাইক্রো অ্যালজি অপরিহার্য খাদ্য উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। অধিক পরিমাণে জুয়োপ্লাংকটন উৎপাদনে মাইক্রো অ্যালজি ব্যবহৃত হয়। সেখানে দায়িত্বরত ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকিয়া হাসান ব্যাখ্যা করছিলেন তার কাজ সম্পর্কে। বলছিলেন, সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা বিকাশে ল্যাবের তৎপরতা অনেক বেড়ে গেছে। জাকিয়া হাসানের অণুবীক্ষণ যন্ত্রে সমুদ্র থেকে সংগৃহীত জীবিত খাদ্যকণা পরখ করে দেখার সুযোগ হলো। পাশের আরেকটি বিভাগে চলছিল সমুদ্র শৈবাল চাষাবাদের নানাদিক নিয়ে গবেষণা। মনে হচ্ছিল রীতিমতো এক শেকড় বাঁকড়ের প্রদর্শনী। শৈবাল গবেষণার একটি প্রকল্পের আওতায় কাজ করছিলেন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম। তিনি জানালেন এই ম্যানগ্রোভ শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত শৈবাল এর বিভিন্ন দিক নিয়ে। বিশাল সমুদ্র উপকূলের মানুষের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস হতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ। সামুদ্রিক শৈবাল সমুদ্র থেকে সরাসরি খনিজ পদার্থ আত্তীকরণ করে ফলে এটা আমাদের খাদ্য তালিকার এককভাবে সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবার যা অধিক পরিমাণে ভিটামিন ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান সমৃদ্ধ। অনেক সামুদ্রিক শৈবালই মাংসের থেকে বেশি আমিষ ও দুধের থেকে বেশি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। এর আগে আমার জাপান, কোরিয়া ও চীনে সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। চীন-জাপানের খাবারের দোকানগুলোতে সামুদ্রিক শৈবালের ব্যাপক চাহিদা দেখেছি। সুপারশপের কর্নারে নানারকম সামুদ্রিক শৈবালের পসরা সাজিয়ে রাখতে দেখেছি।

কেন্দ্রের একটি কক্ষে কাঁকড়া নিয়ে গবেষণা চলছে। মনে পড়ল বছর দশেক আগে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে কাঁকড়া চাষ ও তৃণমূল জনগোষ্ঠীর সুবিধা অসুবিধার চিত্র তুলে ধরেছিলাম। তখন তারা প্রাকৃতিক উৎস থেকে কাঁকড়া ধরে এনে বড় করত। এখানে গবেষকরা চেষ্টা চালাচ্ছেন কাঁকড়ার হ্যাচারি তৈরি করার। যাতে প্রাকৃতিক উৎস থেকে কাঁকড়া সংগ্রহ করতে গিয়ে কোনো জাত হারিয়ে না যায়। নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী উদ্যোগ। কাঁকড়া চাষকে টেকসই করতেই বিজ্ঞানীরা বেশ তৎপর।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারের এই সমুদ্রকেন্দ্র স্টেশনের বাইরে কী ধরনের গবেষণা চলছে তা দেখতে গিয়েছিলাম সমুদ্রসৈকত এলাকায়। দেখলাম বিস্তৃত এলাকাজুড়ে চলছে ওয়েস্টার চাষ নিয়ে গবেষণা। বাংলাদেশের মাটি ও পানির গুণাগুণ শামুক, ঝিনুক ও ওয়েস্টার চাষ উপযোগী। ফলে ওয়েস্টার বিদেশে রপ্তানি করে অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। শামুক ঝিনুকের পাশাপাশি ওয়েস্টারেরও রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য। ঝিনুকের চেয়ে শামুক বা ওয়েস্টার দ্রুত বৃদ্ধি পায় বলে এর চাষ পদ্ধতি অত্যন্ত লাভজনক। তবে শামুক বা ঝিনুক মিঠা ও নোনা উভয় পানিতে চাষ করা গেলেও সামুদ্রিক ঝিনুক চাষ করতে লবণাক্ত পানির প্রয়োজন।

অদূরেই লবণ পানিতে চলছে খাঁচায় ভেটকি মাছের চাষ প্রকল্প। লবণ পানিতে খাঁচায় ভেটকি মাছের চাষ অত্যন্ত লাভজনক। উপকূলের তৃণমূল মৎস্যজীবীরা এই চাষ করে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে হ্যাচারির পোনার ওপর নির্ভর করতে হবে। দেখলাম ভেটকি মাছের চাষ ও সমস্যা সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। কথা হলো মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কক্সবাজার সমুদ্র ও কেন্দ্রের আরেকজন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাহনুর জাহিদুল হাসানের সঙ্গে। তিনি জানালেন ভেটকি চাষ নিয়ে গবেষণার নানান সম্ভাবনার কথা।

আগেই বলেছি, আমরা যে সুনীল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা বলি, সেই বিবেচনায় এসব গবেষণা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। অবশ্য শাহনূর জানালেন ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই কেন্দ্র কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার কাজ করেছে। এগুলো আমাদের সমুদ্র অভ্যন্তরে মাছের জাত ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে।

সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা বিবেচনায় একই সঙ্গে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান গবেষণা শুরু করেছে। গবেষণার ধরনগুলো অনেকটা একই রকম। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় আছে কি-না, সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে কথা বলেছিলাম বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারের কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনিও বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন বলে জানালেন। বলছিলেন, সমন্বয়ের মাধ্যমে গবেষণাগুলো এগিয়ে নিয়ে গেলে সমুদ্র নির্ভর কৃষি অর্থনীতিকে দ্রুত একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

আমাদের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্ণ হলো। এই সময়ের মাঝে বাংলাদেশের বড় অর্জনের একটি মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। কিন্তু জনপ্রতি মাছ প্রাপ্যতার হিসেবে বড় ধরনের ব্যবধান রয়েছে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড় হিসেবে প্রতিজন প্রতিদিন ৬৩ গ্রাম মাছ খেতে পারছি। অনেক নিম্নআয়ের মানুষ মাছ খেতে পারছেন না। অন্যদিকে, খাদ্য নিরাপত্তায় আমাদের সাফল্য থাকলেও পুষ্টি নিরাপত্তায় আমরা রয়েছি অনেক পিছিয়ে। এই সংকটগুলো আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় এক বাধা।

পৃথিবীব্যাপী মানুষের খাদ্যবৈচিত্র্য বেড়েছে। সমুদ্র উপকূলের অনেক দেশ সমুদ্র সম্পদ থেকেই তাদের পুষ্টির বড় একটি অংশ পূরণ করছে। এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের খাদ্য বৈচিত্র্যে ও পুষ্টি নিরাপত্তায় সমুদ্র সম্পদের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। সমুদ্রসম্পদ নিয়ে আরও জোরদার ও অর্থবহ গবেষণা শুরু করতে হবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যে কর্ম উদ্দীপনা জেগেছে, এর গতি আরও বাড়াতে হবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর বড় বড় শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে অথবা তাদের সেরা অনুশীলনগুলোর মতো গতিশীল করতে হবে আমাদের সমুদ্র সম্পদ গবেষণা। তাহলে, অল্পদিনেই আমরা নিশ্চিত করতে পারবো বহুমুখী প্রাপ্তি। পুষ্টি উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে সূচিত হবে নতুন এক অগ্রগতির ধারা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর