রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

আমার একদিন

হোসেন আবদুল মান্নান

আমার একদিন

এখন হেমন্তকাল। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি দিনগুলো এমনিতেই ছোট। সূর্য ওঠার পর থেকে যেন অস্থির দৌড়ের ওপর থাকে দিনের রৌদ্রচ্ছায়ার খেলা।

যেন চোখের পলকে উড়ে যায় সময়ের ভেলা। এখন সকাল, এই তো দুপুর গড়িয়ে গেল, হঠাৎ দেখব দিনাবসানের অন্তিম মৃদু আলোয় ঝাপসা আসছে চারদিক। তবে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া বিধায় সবকিছুতে চিত্ত-জুড়ানো কোলাহলের আমেজ পাওয়া যাবে। ভোর থেকেই কল্পনার জালের ভিতর দিয়ে আমার চোখে ভাসছে- সেই আসা-যাওয়ার পথের ধারে ছড়ানো আছে সোনালি ধানের গ্রামীণ চিত্রকল্প। গাড়ি থেকে দুই পাশে তাকালেই পাব আমাদের এ নবান্নের দেশে এখনো সেই চিরায়ত ম-ম নতুন ধানের গন্ধভরা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। পাড়াগাঁয়ের মানুষ এখনো খেলাধুলা, গান-বাজনায় উৎসব মুখরিত হয়ে আছে। এমন আরও কত শত ভাবনা এসে ভিড় করে আছে।

২. ঝলমল করছে আজকের সকালটা। নেত্রকোনা সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণ। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি। যাকে বলে নিট অ্যান্ড ক্লিন। গাড়ির সিটে গা লাগতেই ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি ৯টা ১৫ মি.। যাব দুর্গাপুরের বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি এবং তৎসংলগ্ন স্থানগুলো দর্শনে। জেলা প্রশাসক আমার একসময়ের অনুজপ্রতিম সহকর্মী। সফরে আমাকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দেওয়ার জন্য একজন নবীন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। আমি তাঁর প্রতি সকৃতজ্ঞ আনন্দিত।

নবীনের নাম সাইফুল ইসলাম।

সে জানায়, স্যার মাত্র ঘণ্টাখানেকের রাস্তা।

বল কী! আমার ধারণা ছিল আরও অনেক বেশি।

না স্যার, এখন রাস্তাঘাট খুবই উন্নত হয়েছে। এতে সময় কমে গেছে।

ভালো বলেছ তো তুমি,

কত ব্যাচ তুমি? পড়াশোনা কোথায়?

৩৭তম ব্যাচ স্যার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি সাহিত্য।

বাঃ! শোনো, ইংরেজি সাহিত্যে পড়ার কারণে চাকরিতে সব সময় কিছুটা অ্যাডভান্টেজ পাবে। ভালো। তোমরা বোধকরি মাঠে এখন পর্যন্ত শেষ ব্যাচ?

জি স্যার।

মনে মনে বলছিলাম, ‘তোমার হলো শুরু আমার সারা’।

নবীন-প্রবীণের অনির্ধারিত এমন কথোপকথনের মাঝেই সহসা পাড় হলাম কংস নদ। যদিও নবীন অফিসার তাৎক্ষণিক নদের নাম মনে করতে পারেনি। পথে পথে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। ভোট হচ্ছে। চিরাচরিত কেন্দ্র, সীমানা পরিবেষ্টনী, পুলিশ-আনসার বাহিনীর প্রাণান্ত চেষ্টা। পোস্টার, ব্যানার, মানুষের জটলা পাকানো আড্ডা, চা পান সিগারেট খাওয়ার গতানুগতিক চরিত্র। এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। মসৃণ সড়কপথের কোথাও খানাখন্দের অস্তিত্ব নেই। বলা যায়, সারা দেশেই এমন অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে যা বছর দশ আগেও কল্পনার অতীত ছিল। দুই পাশ ভরে আছে আমন ধানের শীষের হাতছানি। শীষগুলো যেন স্বভারে অবনত হয়ে তার শিকড়কে কুর্নিশ করছে।

আহা! ডান পাশেই জারিয়া রেলক্রসিং অদূরে স্টেশন। আশৈশব কত গল্প শুনেছি, এরপর নাকি আর লাইন নেই, এখানে ট্রেন খুব ধীরগতিতে চলে, চলন্ত অবস্থায়ও মানুষ ওঠানামা করে, এখানেই ইঞ্জিন ঘোরাতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এ তো আরেকটা বড় নদী। নাম কী? এবার আমার সহযাত্রী নবীন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। সুমেশ্বরী নদী। আংশিক বালুময়। একসময় রূপবতী ও প্রবহমান ছিল। নেত্রকোনার ঐতিহ্য মহাশোল মাছের আদিনিবাসও ছিল এ নদী।

৩. দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ ভবনে।

সাইফুল আমরা উপজেলায় কেন?

ইউএনও সাহেব আপনাকে চা খাওয়ার অনুরোধ করেছেন স্যার।

কী আশ্চর্য, উনি নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত আছেন। তা ছাড়া আমি তো চায়ের বেশি অভ্যস্ত নই।

স্যার মাত্র ৫ মিনিট নেব স্যার।

ঠিক আছে। চল।

ইউএনও জামালপুরের মানুষ। রাজীব উল আহসান। একজন তরুণ লেখক। জানলাম একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা। জলদি চা ও অন্য কিছু হয়ে গেল। বাড়তি হিসেবে হাতে বই পেয়ে গেলাম। নাম ‘দুহিতার বেসাতি’ গল্পগ্রন্থ এটি।

এখন দ্রুত নিচে নেমে আসি।

এবার চল বিরিশিরি স্পটে।

সাইফুল বলল, কাছেই স্যার, এই তো দেখা যায়। ২ মিনিট লাগবে মাত্র।

কালচারাল একাডেমি বিরিশিরি। ভিতরটা প্রায় জনশূন্য। কারণ ইউপি নির্বাচন। আজ কেউ নেই।

তথাপি দুজন ঘুরছি। জানা গেল পরিচালক আছেন, তবে রেস্ট হাউসে।

খবর পেয়ে এলেন এক সুঠামদেহী যুবক। সুজন। সুজন হাজং। কথা হতেই বললেন, আমি তো চিনি আপনাকে। কবি আসলাম সানী ভাই আপনার কথা আমাকে অনেক বলেছেন।

একটু খবর দিয়ে এলে ভালো হতো না? সুজনকে নিয়ে একাডেমি চত্বর ঘুরে দেখা হলো।

একটা ছোট্ট জলহীন পুকুর!

এটা কী?

সুজন জানায়, প্রয়াত কবি রফিক আজাদ সাহেব এখানে ছয় বছর ছিলেন। মাছ চাষের জন্য তিনি এমন সুন্দর একটি সমতল ভূমিকে পুকুর করেছিলেন। এখন এটা না পুকুর না মাঠ। কোনো কাজেই আসছে না।

জানতে চাই, আপনি কী করতে চান?

আমি ভরাট করে পুনরায় মাঠ বানাতে চাই। এখানে অনায়াসেই বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো করা যাবে। সুজন হাজংয়ের কাছ থেকে গারো-হাজংদের কিছু তথ্য পেলাম।

৪. সারা দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চলছে। মানুষের ত্রস্ত-ব্যস্ততা, ছোটাছুটি দৃশ্যমান। সাইফুল গাইড হিসেবে মন্দ নয়। সে সাহিত্যের ছাত্র আর আমি লেখাজোকার শ্রমিক। প্রহরগুলো ভালোই কাটছে।

বললাম, চল আজকে আমার আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে। নেত্রকোনার দিকে ফেরত চল। একই রাস্তা ধরে ফিরছি। পথে আবার জারিয়া রেলস্টেশন। বাঁশের সিগন্যাল পড়েছে, থেমে যাই।

বললাম, চল সাইফুল আমাদের গল্পশোনা স্টেশনটার প্ল্যাটফরমে গিয়ে দাঁড়াই।

সে বলল, স্যার আসুন এখানে একটি ছবি তুলে রাখি।

তবে তান্ডই হোক।

আমরা ছবি তোলার জন্য দাঁড়ালে কিছু লোক কৌতূহলভরা চোখে তাকায়। স্টেশনের পেছনে এক মিষ্টি বিতানে টকটকে লাল জিলাপি দেখেই জিবে জলের স্পর্শ অনুভব করি। ড্রাইভার যাও তো, অল্প করে নিয়ে আস। গাড়িতে বসে সবাই মিলে গরম জিলাপি। সার্থক আমাদের এ সফর।

এবার সোজা শ্যামগঞ্জ হয়ে নেত্রকোনায় পৌঁছাতে লাগে সোয়া ঘণ্টা। সাইফুলকে সঙ্গী করেই একই বাহনে বারহাট্টা-নিশ্চিন্তপুর-কবি নির্মলেন্দু গুণের গ্রাম যশমাদব বাঁয়ে রেখে আমুগাইল গ্রামে আমার মামাশ্বশুরদের বাড়ি গিয়ে হাজির হই। আমার প্রয়াত স্ত্রীর জন্মস্থান এটি। গ্রামে তাঁর নামে নির্মাণাধীন হাসপাতাল দেখি।

মধ্যাহ্নভোজ সেরে আবার নেত্রকোনায় নবীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুলকে ড্রপ করে ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে অবস্থিত বন্ধু সিরাজের মহতী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত তাঁর ডিগ্রি কলেজ পরিদর্শন করি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। গোধূলির আলোমাখা আকাশপটে অপরূপ সৌন্দর্যের আভা ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম দিকটায়। কলেজের অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকমন্ডলীকে নিয়ে মাঠের সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর হাঁটছি। কথা বলছিলাম শিক্ষকবৃন্দের সঙ্গে। নিজের এলাকায় এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য বাল্যবন্ধু সিরাজকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই।

৬. সূর্যাস্ত মাথায় নিয়ে শম্ভুগঞ্জ থেকে ঈশ্বরগঞ্জ-নান্দাইল-মুসল্লি হয়ে কিশোরগঞ্জ আসতে লাগল মাত্র ১ ঘণ্টা ৮ মিনিট। গাড়িতে না ড্রয়িংরুমে বসেছিলাম বোঝার সাধ্য ছিল না। তন্দ্রাচ্ছন্ন না হওয়ার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। ভাবছিলাম, আহা! কী অভূতপূর্ব  উন্নতি হয়েছে আমার দেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার। সবাই অবলীলায় রাস্তা ব্যবহার করেন তবে কজনই তা গর্বের সঙ্গে বলেন? বিদেশ করে এসে ওদের সড়ক ব্যবস্থাপনার গল্পে মুখে খই ফোটাই আমরা। অথচ আমার একজীবনেই ছাত্রাবস্থায় এই সমান রাস্তার জন্য লাগত ৪ ঘণ্টার মতো। কিশোরগঞ্জের বাইপাস ধরে কালিয়াচাপরা-কটিয়াদী-ভৈরব-নরসিংদী-ভুলতা হয়ে রাত ঠিক ৯টা ১৫ মিনিটে ইস্কাটনের বাসায় পৌঁছে যাওয়ার অভাবনীয় ও কাকতালীয় এক গল্প বুননের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গেল আমার জীবনের এ অপরাহ্ণ বেলায় এসে। এমন আশ্চর্য যোগসূত্রে আমি কেন যে কেউ বিস্মিত না হয়ে পারবে না। তা হলো- নেত্রকোনা সার্কিট হাউস থেকে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে গাড়িতে উঠে বসি; দিনভর উড়ে চলে সব মিলিয়ে প্রায় ৪৭০ কিমি জার্নি করে রাত ঠিক ৯টা ১৫ মিনিটেই আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন। ১২ ঘণ্টার বিচিত্র এ ভ্রমণ যেন রূপকথার কাহিনিকেও হার মানাল।

 

                লেখক : গবেষক ও গল্পকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর