রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মীর মশাররফ হোসেন

মীর মশাররফ হোসেন

মীর মশাররফ হোসেন জীবন ও সাহিত্যে সব রকম বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন। লেখকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’। উপন্যাসটি জনপ্রিয়তায় কালজয়ী। তাই ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ হিসেবে সকল সমাজেই এ গদ্যকাব্য বিষাদ সিন্ধুর সমান আদর। “বিষাদ সিন্ধু” উপন্যাসে লেখক স্বদেশ চেতনার জ্বলন্ত প্রমাণ দেন। এর কিছু অংশ হলো স্বাধীনতা কি মধুমাখা কথা। স্বাধীন জীবন কি আনন্দময়। স্বাধীন দেশ কি আরামের স্থান। স্বাধীন ভাবের কথাগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশ করিলে হƒদয়ের সূক্ষ্ম শিরা উপশিরা পর্যন্ত আনন্দোচ্ছ্বাস ফিত হইয়া উঠে এবং অন্তরে বিবিধ ভাবের উদয় হয়। মন মহাহর্ষে নাচিতে থাকে।’ (পঞ্চম প্রবাহ, উদ্ধার পর্ব)।

স্বাধীনতা ধনে বঞ্চিত হইলে সহজে সে মহামণির মুখ আর দেখা যায় না। বহু আয়াসেও আর সে মহামূল্য রত্ন হস্তগত হয় না। স্বাধীনতা সূর্য একবার অস্তমিত হইলে পুনরুদয় হওয়া বড়ই কঠিন। (প্রথম প্রবাহ, এজিদ বধ পর্ব)।

মীর সাহেব জন্ম নিয়েছেন পরাধীন ভারতে। স্বদেশ অন্যের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় লেখক পরাধীনতার জ্বালা ও লাঞ্ছনা এবং স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও স্বদেশপ্রীতির যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র ক্ষোভ ও মাতৃভূমির প্রতি গভীর প্রেমেই ধ্বনিত হয়েছে। এখানে উনিশ শতকের নবলব্ধ স্বাধীনতা চেতনা ও স্বদেশপ্রেমের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বলেছেন, ‘জন্মভূমি কাহার না আদরের? মানুষের তো কথাই নাই, পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গগণ জন্মস্থানের মায়া-মমতা বোঝে, আদর যত্ন করে। জন্মভূমির দৃশ্য নয়ন-মন প্রীতিকর। বসবাসে, আনন্দে, সুখোচ্ছ্বাসে হƒদয়ের শান্তি। যাহার প্রীতিপদ স্থান, মহাপবিত্র পুণ্য ক্ষেত্র ধূলিময়লা আবর্জনা প্রকৃত সুসন্তান পক্ষে স্বর্ণ-রজত অপেক্ষাও মূল্যবান। মাতৃদ্রোহী সন্তানের পক্ষে নহে, স্বদেশদ্রোহী কুলাঙ্গারের পক্ষে নহে, জন্মভূমি বৈরীনিষ্ঠুর পামরের পক্ষে নহে।’ (তৃতীয় মুকুল, ইসলামের জয়)।

আরব ভূখন্ডের সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন কালে, ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতেও লেখক জন্মভূমিকে ভুলতে পারেননি। রোম সেনাদের বিপর্যয়ের পর মহাবীর জাফরের কণ্ঠে আমরা লেখকের কণ্ঠস্বরই শুনি। ‘স্বরাজ্যে স্বরাজ অপেক্ষা গৌরবের কথা অস্থায়ী জগতে আর কি আছে ভাই? স্বরাজ যদি পররাজ হইল, তবে গোলামী করিয়া জীবন ধারণ করা অপেক্ষা জীবনপাত করাই শ্রেয়। সিংহজীবন জীবনের মায়ায় কুকুরের জীবনে পরিণত করিয়া লাভ কি? পরিণামে জঠর জ্বালায় বিজেতাদিগের চর্বিত চর্বণ পাদুকা লেহন ভিন্ন আর কি উপায় আছে? জন্মভূমির মায়া যে নরাধম পামরের হƒদয়ে নাই, তাহার জীবন বৃথা। নিজ জীবন রক্ষা করিতে স্বদেশের স্বাধীনতা যাহারা পরহস্তে তুলিয়া দেয় তাহাদের ন্যায় কুলাঙ্গার দেশবৈরী আর কে আছে? পবিত্র জন্মভূমি অপরের পাদুকাতলে দলিত হইবে, স্বাধীন জীবন পরাধীনতা শৃঙ্খলে বাঁধা পড়িবে। গলায় রজ্জু দিয়া বাঁদর নাচন নাচাইয়া লইয়া বেড়াইবে। ইহা কোন প্রাণে সহ্য হইবে?’ (অষ্টম মুকুল, ইসলামের জয়)।     

আফতাব চৌধুরী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর