মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সৃজনশীল সুশীল সেবক

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সৃজনশীল সুশীল সেবক

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাঠ প্রশাসনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে সম্মান করা, তাঁদের সৃজনশীল উদ্যোগকে উৎসাহিত করা, সেসবের বাস্তবায়নে সহায়তা করা বিশেষ তাৎপর্যবাহী। আজকের জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে তাদের সৃজনশীল আমলা বা প্রশাসনযন্ত্রের অয়োময় প্রত্যয়, প্রযত্ন ও উদ্ভাবনী অবদান মুখ্য ভূমিকায় বা প্রেরণায় রয়েছে। সেখানকার ১৮৬৮ সালের মেইজি নবজাগরণ ও পুনর্জাগরণ প্রয়াসের অন্যতম উপায় ও উপলক্ষ ছিল দেশের মেধাবী আমলাদের ক্ষৈত্রিক পর্যায়ে পরিচালিত শিল্প বিনিয়োগ বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুপারিশকৃত, গৃহীত, অর্জিত ও পরিচালিত প্রকল্পসমূহের সফল বাস্তবায়ন। এমনকি এই ভারতবর্ষে ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনামলে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা জনপ্রশাসনে নতুন নতুন কর্মসূচির সূচনাই শুধু করতেন না, তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান কাজে লাগাতে যেসব গ্রন্থ বা প্রতিবেদন প্রকাশ করতেন তা পাথেয় হয়ে থাকত সরকারের নিত্যনতুন পদক্ষেপ গ্রহণের উপায় ও প্রেরণা হিসেবে। সে সময়কার ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্টস, স্পেশাল রিপোর্ট এমনকি পাবলিক সার্ভেন্ট সূচিত বিভিন্ন কর্মসূচি (যেমন গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলন, আখতার হামিদ খানের কুমিল্লা মডেল-বার্ড, মহীউদ্দীন খান আলমগীরের উলশী) সবই ইনোভেশন অব পাবলিক সার্ভিসের অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি অর্থনীতিই বাংলাদেশ অর্থনীতির মেরুদন্ড। সেই কৃষি অর্থনীতিকে যুগোপযোগীকরণে, আধুনিকীকরণে মাঠ প্রশাসনের নানান উদ্ভাবনী ভূমিকার অবকাশ রয়েছে। এ মুহূর্তে কৃষিতে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারই হচ্ছে কৃষিপ্রযুক্তি বা অ্যাগ্রো টেকনোলজি। কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন কলাকৌশল, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া প্রদর্শন করে নতুন উদ্ভাবনকে বিস্তারের জন্য অ্যাগ্রো টেকনোলজি পার্ক স্থাপন একটি অন্যতম সৃজনশীল উদ্যোগ। কৃষকের মধ্যে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি বিস্তারের লক্ষ্যে প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলা পরিষদ চত্বরে তেমনি একটি অ্যাগ্রো টেকনোলজি পার্ক গড়ে উঠেছে যার নাম শ্যামনগর অ্যাগ্রো টেকনোলজি পার্ক। আর তার উদ্ভাবক ছিলেন তদানীন্তন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সায়েদ মোহাম্মদ মনজুর আলম।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর একটি স্বাভাবিক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। এখানকার মানুষ মূলত কৃষিনির্ভর। কিন্তু ফারাক্কার প্রভাবে উজান থেকে মিষ্টি পানিপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় সুন্দরবনসহ শ্যামনগরসংলগ্ন নদী ও জলাশয়ে ক্রমাগত লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং সিডর-আইলা ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ এলাকার কৃষি অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি নানা মহলের উদ্যোগ সত্ত্বেও শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসনের দৃষ্টিতে যেসব সমস্যা-সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়েছে সেগুলো হলো- ১. নির্দিষ্ট ইকোসিস্টেমে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে অভিযোজনে সক্ষম সম্ভাব্য সব সফল প্রযুক্তির সমন্বিত প্রদর্শনের ব্যবস্থা না থাকা। ২. হাতে-কলমে কৃষিপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ দানের উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাব। ৩. প্রশিক্ষণ স্থানের কাছে প্রদর্শনী প্লট ও ফলাফল প্রদর্শনীর ব্যবস্থা না থাকা। ৪. স্থানীয় ফসলের জাত, মূল্যবান ঔষধি গাছগাছড়া ও স্থানীয় প্রযুক্তি সংরক্ষণে ব্যবস্থা না থাকা।

সেবার ঈদের ছুটি কাটাতে গিয়ে এক অবসরে উপজেলা সদরে সরেজমিনে পরিদর্শনের সময় দেখলাম ও জানতে পারলাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজে বেশ কয়েকটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ ও পন্থা উদ্ভাবন করেছেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ক. কৃষিপ্রযুক্তি হস্তান্তরজ্ঞান ও দক্ষতা বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কাছে মৌসুমভিত্তিক কৃষির সব জাতের ফসল ও ট্রায়াল প্লটের মাধ্যমে প্রদর্শনের জন্য ০.৭৫ একর জমিতে অ্যাগ্রো টেকনোলজি পার্ক স্থাপন। খ. এলাকার ভেষজ উদ্ভিদ ও বিলুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাতের বিভিন্ন শস্য সংরক্ষণে বীজভান্ডার ইনসিটো কনজারভেশনের ব্যবস্থা। এবং গ. তার অধিক্ষেত্রসংলগ্ন সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব একটি ইকো পার্ক স্থাপন; যা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও সহায়সম্পদের সংরক্ষণ পর্যবেক্ষণব্যবস্থার প্রতি জনসচেতনতা ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং পর্যটনশিল্প উৎসাহিত হবে।

এসব উদ্যোগের তাৎক্ষণিক ফলাফল- ১. কৃষির মৌসুমভিত্তিক, পরিবেশবান্ধব, জলবায়ু পরিবর্তনে ইকোসিস্টেমভিত্তিক অভিযোজন-সহায়ক প্রযুক্তি এবং অপ্রতুল ভূমি ও পানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য লাগসই প্রযুক্তি প্রদর্শন করে গত ছয় মাসে হাতে-কলমে ৩৫০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ চর্চা করা হয়েছে। পাশাপাশি এখানে কৃষক, ছাত্রছাত্রী, কৃষি বিশেষজ্ঞ, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অসংখ্য মানুষ এসব প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেছে যা চলমান রয়েছে। এবং ২. এ উদ্যোগের মাধ্যমে ৫৪ প্রজাতির স্থানীয় ফসল ও ৪৫ প্রজাতির ভেষজ গাছ চাষ ও বীজ সংরক্ষণ করে ইনসিটো কনজারভেশন করা হচ্ছে। বাংলার মাটিতে আবহমানকাল ধরে যেসব প্রাকৃতিক ফল ও ফসলের উৎপাদন প্রক্রিয়া বিদ্যমান সেগুলোর পরিবর্তে বিদেশি প্রযুক্তি ও প্রজাতির গাছপালা, শস্য ও মাছ চাষের যে উদ্যোগ দেখা যায় তাতে দেশি মূল্যবোধ, আবেগ-আকাক্সক্ষা, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ফলফসল তথা খাদ্যশস্য বিলুপ্তির পথে। যেমন ইউক্যালিপটাস গাছ, আফ্রিকান মাগুর, থাই কই, হাইব্রিড ধান, ফার্মের মুরগি এগুলো দেশি ব্যবস্থাপনাজাত দেশি শস্য ও প্রাণী সম্পদকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে। নিজেদের ভাষা, নিজেদের সংস্কৃতির স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে দেশের মানুষ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে সে দেশে এখন তথাকথিত আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে ভিনদেশি ভাষা, আচার-আচরণ মূল্যবোধসম্পন্ন সংস্কৃতি উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, বাংলাদেশের সব গৃহপ্রাঙ্গণে বিকৃত রুচি এসে নিজের ভাষা, ব্যক্তি ও পারিবারিক ¯েœহ-সম্মান-সমীহের সম্পর্ক ও আবহমান সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ঘরছাড়া করছে। নিরুসাহ করছে নিজের সংস্কৃতির লালনপালন ও অনুসরণকে। সংকর ও হাইব্রিড সংস্কৃতির কবলে বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ যেমন তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ দেশের খাদ্যশস্য ও প্রাণিসম্পদ। এসব পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের স্বার্থে অ্যাগ্রো টেকনোলজি পার্ক একটি অত্যন্ত মহৎ ও কার্যকর উদ্যোগ। এখানে যে টেকনোলজির সমাহার ঘটানো হয়েছে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য মাটির সর্বোত্তম ব্যবহার করে শস্য নিবিড়তা বাড়ানো- একই জমিতে এক ফসলের পরিবর্তে দুই, তিন ও চার ফসল উৎপাদন; সাথী ফসলের চাষ; জমির আইলের ওপর সবজি চাষ; লবণাক্ত এলাকায় বাঁশ নির্মিত টাওয়ারে সবজি চাষ; ঘেরের আইলে সবজি চাষ; ভাসমান ও দেয়ালে সবজি চাষ; মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় ভার্মিকপোস্ট, কুইক কম্পোস্ট ও বিভিন্ন জৈবসার ব্যবহার; কোকোডাস্ট ব্যবহার করে মাটিবিহীন সবজি উৎপাদন; স্বল্প সেচের গম, যব, ডালজাতীয়, মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদন; ড্রিপ সেচ, স্প্রিংলার সেচসহ ফসলের কম পানি ব্যবহারের বিভিন্ন কলাকৌশল; পলিথিন শেড নির্মাণের মাধ্যমে সারা বছর সবজি উৎপাদন; লবণাক্ত উপকূল অঞ্চলের শস্যপর্যায় নির্ণয় (এলাকাভিত্তিক); ফেরোমন ফাঁদের ব্যবহার করে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন; নিম তেল, মেহগনি তেলসহ অন্যান্য জৈব কীটনাশক ব্যবহার;, লিফ কালার চার্ট ব্যবহার করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগের নিশ্চয়তা, লাইট ট্রাপ ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকা দমন; সরিষা খেতে মৌমাছি পালন; ইনসিটো কনজারভেশনের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় ঔষধি গাছ ও ফসলের বীজ সংরক্ষণ; অনফার্ম কনজারভেশনের মাধ্যমে কৃষকের বীজ সংরক্ষণ; অপ্রচলিত বিদেশি ড্রাগন, থাই পেয়ারা ও স্ট্রবেরি ফলের চাষ। ধান চাষের ক্ষেত্রে যেসব টেকনোলজি উদ্ভাবন করা হয়েছে তা হলো- ১. SRI পদ্ধতিতে চারা লাগানো (প্রতি গোছায় একটি মাত্র চারা রোপণ)। ২. সরাসরি গজানো বীজ বপন। ৩. লাইনে ধান রোপণ। ৪. লবণসহনশীল বিলুপ্তপ্রায় দেশি ধানের (ইনচি, পাটনাই, হাতিজোড়া, চিনিকানি, হলদেবাটালি) আবাদ করে অনফার্ম কনজারভেশনের মাধ্যমে উপযোগী জাত চিহ্নিতকরণ ও কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ। ৫. ধান খেতে পার্সিং (ডাল পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা) পদ্ধতিতে পোকার আক্রমণ কম করা। ৬. হাইব্রিড, উচ্চফলনশীল ও স্থানীয় জাত একই স্থানে রোপণের ফলে স্থানীয়ভাবে বেশি ফলনশীল, কম সময় ও অল্প পানি ব্যবহার-উপযোগী জাত চিহ্নিতকরণ। ৭. আধুনিক পানি ব্যবস্থাপনার আওতায় ডিপনালা পদ্ধতির ব্যবহার। ৮. AWD ব্যবহার করে পানির অপচয় রোধ।

শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসনের ইনোভেটিভ এসব পদক্ষেপ ও কার্যক্রম অনুসরণ করে, অনুপ্রাণিত হয়ে সবাই স্বপ্ন দেখতে পারি, প্রত্যাশা করতে পারি- ১. শ্যামনগর অ্যাগ্রো টেকনোলজি পার্কটি দেশের বিভিন্ন উপজেলায় সম্প্রসারিত হতে পারে। ২. এলাকার উপযোগী (location specific) প্রযুক্তি নির্বাচন করে নিকটবর্তী গবেষণা কেন্দ্রগুলোকে সম্পৃক্ত করে স্থানীয় ইকোসিস্টেম-উপযোগী ফসল বিন্যাস তৈরি করা যেতে পারে এবং ৩. অ্যাগ্রো টেকনোলজি পার্ক মডেল কৃষক প্রশিক্ষণ/প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহার/রূপান্তরিত হতে পারে।

                লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর