মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

জহিরুল হক শামীম

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

অনেক স্বপ্ন নিয়ে ছেলে মিজানুর রহমান নয়নকে লেখাপড়া করাচ্ছিলেন দিনমজুর ফরিদুল আলম। অসচ্ছল এ পরিবারের একমাত্র স্বপ্ন মিজানুর রহমান নয়ন। ছেলে অপহৃত হওয়ায় সে স্বপ্নটুকুও হারিয়ে যাচ্ছিল। র‌্যাব-১৫-এর সহায়তায় অপহৃত ছেলেকে ফিরে পেয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন তিনি। উদ্ধার হওয়া সন্তান কায়সার আহমেদকে ফিরে পেয়ে কাঁদলেন আরেক বাবা আবদুর রহিম। ১১ ডিসেম্বর ২০২১ সালে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ কার্যালয়ের সামনে অপহরণ চক্রের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া ছেলেদের বুকে জড়িয়ে ধরে বাবাদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। দিনমজুর ফরিদুল আলম এবং আবদুর রহিম যখন তাদের হারানো সন্তানদের ফিরে পেয়ে চোখের জলে র‌্যাপিড ব্যাটালিয়ন ফোর্সকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন, এমনি সময়ে মার্কিন অর্থ দফতরের ‘ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল অফিস’ (ওএফসি) বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ জন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন- র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, র‌্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মুস্তফা সরওয়ার, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও আনোয়ার লতিফ খান এবং বাহিনীটির সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে ১১ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বস্তুনিষ্ঠভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। তারা অতিরঞ্জিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি অভিযোগ ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তদন্ত হয়। কোনো সংস্থা মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব মুখপাত্র বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, গুলিবিনিময় বা ক্রসফায়ারের ঘটনা। আমরা মনে করি একটি দেশের সুস্থ বা স্বাভাবিক নাগরিক হিসেবে নিজের আত্মরক্ষার যে অধিকার, এটা কিন্তু দেশের আইন দিয়েছে। ‘আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন অভিযানে যে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে আমরা যখন প্রতিরোধের শিকার হয়েছি বা আমাদের ওপর যখন সন্ত্রাসীরা গুলি চালিয়েছে, তখনই আমরা গুলি করেছি। এ গুলিবিনিময়ে আমাদের এখন পর্যন্ত ২৮ সদস্য শহীদ হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে গুলিবিনিময়ের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত হয়। সেখানে যাচাই-বাছাই করা হয়’। ‘এই বাহিনীর নিজস্ব যে আইনশৃঙ্খলা রয়েছে, তা অত্যন্ত কঠোরভাবে পালন করা হয়। এখানে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।’ বাংলাদেশ এ নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। অসন্তোষের কথা মার্কিন দূত আর্ল আর মিলারকে ডেকে জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ বা কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে দেশভেদে এসব নিষেধাজ্ঞার প্রকৃতি হয় আলাদা। সন্ত্রাস এবং মাদকবিরোধী নিষেধাজ্ঞার আওতায় বিভিন্ন দেশের একাধিক ব্যক্তির ওপরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। এসব নিষেধাজ্ঞা সাধারণত অর্থনৈতিক যা ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল অফিস জারি করে। বিশ্লেষকদের মতে, নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি মোটেই ব্যক্তিগত নয়। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের। যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেটি র‌্যাবের বিরুদ্ধে। তারই অংশ হিসেবে র‌্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী ও সাবেক মহাপরিচালক ড. বেনজীর আহমেদসহ (আইজিপি হিসেবে নয়) র‌্যাবের আরও চারজন কর্মকর্তার ব্যাপারে এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

জঙ্গিবাদ এবং মাদকের বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নেই র‌্যাব তার সর্বশক্তি বিনিয়োগ করেছে এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছে। বাংলাদেশ মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করছে। বাংলাদেশকে জঙ্গি বা মাদক নিয়ন্ত্রণে ভিন্ন কোনো দেশের বা জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হয়নি। বাংলাদেশ পুলিশ ও র‌্যাব, কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার সুসংহত করেছে। সুন্দরবনের জলদস্যুদের দস্যুতা থেকে ফিরিয়ে এনে সমাজে পুনর্বাসিত করা সম্ভব হয়েছে। মাদকাসক্তদের সহায়তায় চালু করা হয়েছে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’। করোনাকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যখন বিপর্যস্ত তখনো বাংলাদেশ পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের খাবার ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা বিধান ছাড়াও জানাজা থেকে দাফন পর্যন্ত থেকেছে সদা তৎপর। জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সুনাম বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও মিয়ানমারের ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, কর্ণফুলী টানেলসহ নানা প্রকল্প যখন পুরোদমে এগিয়ে চলেছে, এসব প্রকল্পে নিয়োজিত বিদেশিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাংলাদেশ উন্নয়ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে সম্মুখ পানে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্য এ ক্ষেত্রে বিশাল। ঠিক এমন মুহূর্তে এমনি ধরনের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জনগণকে হতাশ করেছে। যদিও সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ নিষেধাজ্ঞায় হতাশ হওয়ার কিছু নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক সময়ই নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করে থাকে।  তবে র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির তীব্র সমালোচনার মুখে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট সর্বশেষ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ হ্রাস পাওয়ায় প্রশংসা করা হয়েছে। এতে কার্যত র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

                লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর