বুধবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বৈধ বনাম গ্রহণযোগ্য নির্বাচন

মেজর (অব.) আখতার

বৈধ বনাম গ্রহণযোগ্য নির্বাচন

নির্বাচন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা রাষ্ট্রের রুটিন বা নিয়মিত কার্যক্রম। রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে নির্বাচন হচ্ছে। সব নির্বাচনই আইনের দৃষ্টিতে বৈধ। গত ৫০ বছরের কোনো নির্বাচনই আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ ঘোষিত হয়নি। যারাই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন তারা সব সময়ই বৈধভাবে নির্বাচিত হওয়ার সনদ পেয়েছেন। নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে ব্যাপক কোনো আপত্তি আজ পর্যন্ত আলোড়নও তুলতে পারেনি। তবে যে বিষয়টি নির্বাচনের আগে বা পরে ব্যাপক আলোচনা বা প্রতিবাদ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করছে তা হলো নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। রাজনীতিবিদদের এক ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও স্ববিরোধী আচরণের কারণে পরাজয় মেনে নেওয়ার প্রচন্ড হীনমন্যতা ও দাম্ভিকতা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে রাজনীতিবিদদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সবার আগে দরকার।

সংবিধানে নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। সংবিধান সব নির্বাচনের সুস্পষ্ট দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের ওপর। যেমন সংবিধানের সপ্তম ভাগে ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হিসেবে পরিষ্কার বলা হয়েছে : ১১৯।“[(১) রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী-(ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; (খ) সংসদ-সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; (গ) সংসদে নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন; এবং (ঘ) রাষ্ট্রপতি পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুত করিবেন।] (২) উপরি-উক্ত দফাসমূহে নির্ধারিত দায়িত্বসমূহের অতিরিক্ত যেরূপ দায়িত্ব এই সংবিধান বা অন্য কোন আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে, নির্বাচন কমিশন সেইরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন। কাজেই নির্বাচনের সকল দায় দায়িত্ব এককভাবে নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন যেভাবেই নির্বাচন কমিশন করাবে তার বৈধতা নিয়ে আইনগত কোনো প্রশ্ন করার তেমন সুযোগ কারও নেই। তবে নির্বাচন কমিশন যদি কোনো নির্বাচন সঠিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি বলে মনে করে তাহলে সেই নির্বাচন বাতিল করার সর্বময় ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে।

নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। যে কোনো নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য করতে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ সাংবিধানিকভাবে বাধ্য এবং তা নির্বাহী বিভাগের কর্তব্য। সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সহায়তাদানকল্পে ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইব।’ সংবিধানের ৪র্থ ভাগে নির্বাহী বিভাগ হিসাবে প্রথম পরিচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি, ২য় পরিচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদ, ৩য় পরিচ্ছেদে স্থানীয় শাসন, ৪র্থ পরিচ্ছেদে প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ এবং ৫ম পরিচ্ছেদে অ্যাটর্নি-জেনারেলকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কাজেই নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পরিচালিত সব নির্বাচনে সহায়তা করা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ ও অ্যাটর্নি জেনারেলের পালনীয় কর্তব্য। কাজেই নির্বাচন কমিশন পরিচালিত কোনো নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারও সুযোগ নেই।

নির্বাচন কমিশনকে তার দায়িত্ব পালনে যেরূপ কর্মচারী প্রয়োজন তা প্রদান করবেন রাষ্ট্রপতি। এ ব্যাপারে সংবিধানের নির্দেশনা হলো ‘নির্বাচন কমিশনের কর্মচারীগণ ১২০। এই ভাগের অধীন নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবে’। সংবিধানে নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য রাষ্ট্রের সমগ্র নির্বাহী বিভাগকে নির্বাচন কমিশনের আজ্ঞাবহ করে দিয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশন যে নির্বাচনই পরিচালনা করবে তা সর্বৈব বৈধ। এ ব্যাপারে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই।

নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে গঠিত একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের (১) উপ-অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ‘১১৮ [(১) প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া] বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবে।’ কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় কোনো প্রকার ফাঁক-ফোকর রাখা হয়নি। যে অদ্যাবধি ‘উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইন’ নেই তাই রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের (৩) উপ-অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশন ও চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করবেন।

সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে একক সিদ্ধান্তে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করার ক্ষমতা দেয়নি এবং সংসদও কোনো আইন করে রাষ্ট্রপতিকে সে রকম কোনো ক্ষমতা দেয়নি। কারণ সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের (৩) উপ-অনুচ্ছেদে বলা আছে ‘(৩) এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।

সংবিধান দৃশ্যমানভাবে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষমতা দিয়েছে কিন্তু ক্ষমতাটি মূলত প্রধানমন্ত্রীর। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেন না এবং পারবেন না। যদি রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ তথা অনুমোদন না নিয়ে অন্য সবার সঙ্গে আলোচনা করে এমনকি কোনো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেও যদি নির্বাচন কমিশন গঠন করেন তা হলেও সেই নির্বাচন কমিশন অবৈধভাবে গঠিত হয়েছে বলে গণ্য হবে। তাই জনগণের ধারণা হলো নির্বাচন কমিশন গঠনকল্পে রাষ্ট্রপতি আলোচনা করার যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা নিছক লোক দেখানো। এর সাংবিধানিক ও আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশন গঠনকল্পে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করতে যাচ্ছে বা যেতে আগ্রহ প্রকাশ করছে তাতে ওইসব দলের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই ফুটে উঠছে বলে জনগণের ধারণা। নির্বাচন কমিশন গঠন করার একক দায়িত্ব খোদ প্রধানমন্ত্রীর। এমনকি নির্বাচন কমিশন গঠন করার ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদেরও কোনো এখতিয়ার নেই। রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী কী পরামর্শ দেবেন তা একান্তই প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব। এখন যদি প্রধানমন্ত্রী স্বীয় বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করতে চান তাহলে তা হবে প্রধানমন্ত্রীর একটি চমকপ্রদ রাজনৈতিক পদক্ষেপ বা কৌশলী ফাঁদ। এখন সেই ফাঁদে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল বা দলগুলো পা দেবে কি না তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে ওইসব দল বা দলগুলোর নেতাদের মেধা, বুদ্ধি, দূরদর্শিতা এবং তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক কৌশলের ওপর।

সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বৃহৎ জনগণও মনে করে বর্তমান সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা সোনার পাথরবাটির মতোই অলীক কল্পনা। তবে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্পও নেই। চরম অপ্রিয় হলেও তার চেয়েও চরম অপ্রিয় সত্য হলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প প্রধানমন্ত্রীর সামনে এখন আর খোলা নেই। শুধু নেতৃত্বহীন দুর্বল বিএনপিকে বিবেচনায় নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর আস্থা রেখে যেনতেন নির্বাচনের সুযোগ জনগণ হয়তো দেবে না। আগামী নির্বাচন যদি গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা তৈরি হবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল এবং দলগুলোর। তখন জনগণ পরিবর্তনের জন্য অধৈর্য হয়ে যেতে পারে। রাজনীতিতে সময় যেমন একটি বড় নিয়ামক তেমনি পুরনো কৌশলও বিপদের মহাকারণ হয়ে দাঁড়ায়।

নির্বাচনের বিকল্প শুধু নির্বাচনই হতে পারে। ২০১৮ সালের নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই জনগণ আগামী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। জনগণ ভালো করেই জানে সরকার আগামী নির্বাচনে নতুন কৌশল নেবে। তবে সরকারের সেই কৌশল মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েও জনগণ ভাবছে। আগামী নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে ভাবনার চেয়ে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনগণের ভাবনা অনেক বেশি। কাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলো তা নিয়ে জনগণের কোনো ভাবনা নেই। কারণ জনগণ মনে করে নির্বাচন কমিশন সরকারেরই বশংবদ হবে; কিন্তু দিনের শেষে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতেই হবে। না হলে তরী ডুবে যেতে পারে!

                লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর