বুধবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

আবদুর রাজ্জাক এক স্মরণীয় নাম

বাহালুল মজনুন চুন্নু

আবদুর রাজ্জাক এক স্মরণীয় নাম

জাতীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শিক সৈনিক এবং তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক শীর্ষ যোদ্ধা। তিনি ছিলেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর। সারা জীবন লড়ে গেছেন বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর দৃপ্ত শপথ লড়াইয়ে রক্তে ভেজা রাজপথের, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের অনিশ্চিত এক জীবনই ছিল তাঁর নিয়তি। ষাটের দশকের আগ্নেয়গিরির লাভার মতো জ্বলন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে স্বাধিকার আন্দোলনগুলোয় তাঁর ছিল সরব ও তেজোদীপ্ত উপস্থিতি। যার ফলে শাসক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে সহ্য করতে হয়েছে বছরের পর বছর কারাপ্রকোষ্ঠের অন্ধকারময় জীবন, ভোগ করতে হয়েছে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন-নিপীড়ন। রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়ে, সারা দেশ চষে বেড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক সারা দেশের মানুষকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করাই ছিল যেন জীবনের একমাত্র ব্রত। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছিষট্টির ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। দীর্ঘ সংগ্রাম পরিক্রমার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যখন স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি নিজ জীবন তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দেশমাতৃকার প্রতি প্রবল ভালোবাসা আর বঙ্গবন্ধুর প্রতি তীব্র আবেগ তাঁকে রণক্ষেত্রে সবর্দা সাহস জুগিয়ে গিয়েছিল। ওই সময় গঠিত মুজিব বাহিনীর একজন সংগঠক ও রূপকারও ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডারের (মুজিব বাহিনীর চার সেক্টর কমান্ডারের একজন) দায়িত্ব পালন করেছেন। দেরাদুনে ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া এই বীরযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষকও ছিলেন। স্বাধীনতার পর সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আবদুর রাজ্জাক। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা এবং সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার আজীবন লড়াই-সংগ্রামের পাশাপাশি শান্তি আন্দোলনেও অবদান রেখেছিলেন তিনি। বাঙালি জাতির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষাময় স্বাধীনতা অর্জন ও তৎপর চূড়ান্ত বিজয়ের পর থেকে রাজ্জাক ভাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ বাস্তবায়নে কাজ করে গিয়েছিলেন নিরলস। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দলকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন জাতির পিতার নির্দেশ পালন করে। পরে বাকশালের সম্পাদক হিসেবে জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি সাফল্যমন্ডিত করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছিলেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার নির্মম হত্যাকান্ডের পর প্রায় দীর্ঘ আড়াই বছর তিনি কারাবন্দী থাকেন। দলের নেতা-কর্মীরা যখন দিশাহারা সেই সময়টায় তিনি জেলে বসেই দলকে সংগঠিত করার জন্য, জাতির পিতা হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করে দল পরিচালনা করতেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী যে দুঃসময় গেছে, যে দুর্যোগ ঘটেছে জাতীয় জীবনে, সামরিক জান্তার শোষণ-নিপীড়নে ছাত্রলীগ কর্মীরা যখন অসহায়-দিশাহারা হয়ে পড়েছিল, তখন সেই পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য ছাত্রলীগ কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। তা করার জন্য কারাগার থেকে তিনি আমাদের যাবতীয় দিকনির্দেশনা দিতেন সব সময়। তিনি তা করতে আমাদের দিকনির্দেশনা দিতেন জেল থেকেই। পঁচাত্তর-পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারীরা নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও তাঁকে তাদের অনুগত করতে পারেনি। শত নিপীড়নেও তিনি কাবু হননি, মাথা নত করেননি। বঙ্গবন্ধুর দীক্ষাই তাঁকে দুঃসাহসী করে তুলেছিল। তাই নিঃশঙ্ক চিত্তে তিনি শত নির্যাতন, শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেছেন। সুবিধাভোগী বা সুযোগসন্ধানী হওয়ার অভিলাষের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। জেল থেকে মুক্তি পেয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের দিগ্ভ্রান্ত কর্মীদের আবারও সংগঠিত, আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত দলে পরিণত করার কাজে।

রাজ্জাক ভাই তাঁর কর্মী বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে দলকে সংগঠিত করতে জেলায় জেলায় ঘুরতেন, জনসভায় জনসভায় বক্তৃতা দিতেন, নেতা-কর্মীদের নানান দিকনির্দেশনা দিতেন। তাঁর ভরাট জলদগম্ভীর কণ্ঠের তেজোদীপ্ত ভাষণ জনসভার শ্রোতাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠের উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিভাত হতো। রাজ্জাক ভাই ছিলেন দূরদর্শী-বিচক্ষণ এক রাজনীতিবিদ, তাই তিনি বুঝেছিলেন এই বাংলায় আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রাখার জন্য, আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার জন্য বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি যে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, যে পরিমাণ অক্লান্ত পরিশ্রম তাঁকে করতে হয়েছে তা একটা সময় তাঁর শরীরে নানা রোগব্যাধি সৃষ্টি করেছিল। সামরিক জান্তা শাসনকালে বহুদিন থাকতে হয়েছে আত্মগোপনে। খাবার -দাবারে অনিয়মে শরীরে রোগ বাসা বাঁধে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়েছিল যে তিনি লন্ডনের একটি নয়, দুটি হাসপাতালে দীর্ঘ কয়েক মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। দীর্ঘকাল লিভারের জটিল অসুখে ভুগছিলেন। তাঁর দেহে নতুন লিভার সংযোজন জরুরি হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত একটি লিভারের ব্যবস্থা হলো। কিন্তু সেটি সুস্থ লিভার নয়। চিকিৎসায় অর্থাভাবও ছিল। অর্থের সংস্থানও হলো; বন্ধুরা হাত বাড়ালেন। কিন্তু নতুন লিভার সংস্থাপনের মতো শারীরিক অবস্থা তাঁর ছিল না। চিকিৎসকরা দেহে অস্ত্রোপচারের জন্য সময় নিচ্ছিলেন। কিন্তু বিড়ম্বিত ভাগ্যই যেন। দেখা গেল যার কাছ থেকে লিভার পাওয়া নিশ্চিত ছিল তিনি নিজেই অসুস্থ। একটি লিভারের অভাবে তাঁকে বাঁচানো যাবে না, স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তখনই। চিকিৎসকরাও বলছিলেন অপারেশন সহ্য করার মতো সবল নয় তাঁর শারীরিক অবস্থা। শেষ পর্যন্ত লাইফ সাপোর্ট মেশিনে রাখা হয়েছিল। যখন চিকিৎসকরা স্পষ্ট হলেন যে জীবন রক্ষার আর কোনো উপায় নেই তখন শরীর থেকে খুলে নেওয়া হলো লাইফ সাপোর্ট। দিনটি ছিল শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর। ঢাকায় খবর পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে পড়ি শোকে। কষ্টে বুক ভেঙে যাচ্ছিল। পিতার মতো, বটবৃক্ষের মতো ¯েœহ, ছায়া, মমতা এবং জীবন চলার দিকনির্দেশনাদাতা আর নেই, এমনটা ভাবতেই খাঁখাঁ শূন্যতায় ভরে উঠেছিল বুক।

এখনো তাঁর শূন্যতা শেল হয়ে বেঁধে বুকে। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা, দেশপ্রেম, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল থাকার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যা যুগ যুগ ধরে আলোর পথ দেখিয়ে যাবে বাঙালি জাতিকে।

 

লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

সর্বশেষ খবর