শনিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

একজন আবুল হাসেমের যেভাবে উত্থান

অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু

একজন আবুল হাসেমের যেভাবে উত্থান

দেখতে দেখতে চোখের পলকেই যেন আরও একটা বছর কালের গর্ভে হারিয়ে গেল। এই তো সেদিন সন্ধ্যায় কভিড আক্রান্ত তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়ে এলাম। পরিবারের সদস্যরা জানালেন উন্নতির দিকে। তবু দুশ্চিন্তার মধ্যেই ঘুমাতে গেলাম। ফজর নামাজের পর জানতে পেলাম রাত ১টা ২০ মিনিটে হাসেম ভাই ইন্তেকাল করেছেন। সেদিন ছিল ২৪ ডিসেম্বর, ২০২০। হ্যাঁ বলছি আমাদের সময়ের একজন সফল মানুষের প্রতিকৃতি, দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শিল্পপতি এম এ হাসেমের কথা। সেদিন সংবাদটি শুনে স্তম্ভিত হয়ে যাই। কিন্তু কোথা থেকে এক অসীম তাড়না-টান এসে ভর করেছিল, সে কারণেই হয়তো অনেক স্মৃতির ঝড় আমার কলমে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। পরদিন দুটি জাতীয় পত্রিকার প্রিন্ট ভার্সনে লেখাটি ছাপা হয়েছিল। এবার তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে এ রকম একটি টান থেকে লিখতে বসেছি। বিগত এক বছরে কভিড-১৯-এর ছোবলে অনেক স্বজন, বন্ধু-বান্ধব হারিয়েছি। কিন্তু এরূপ শূন্যতা কখনো অনুভব করিনি। দেশের শিল্প-বাণিজ্যের অন্যতম এই প্রাণপুরুষের সঙ্গে বস্তুত ২০০১ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে গিয়ে পরিচয় ঘটে। পরিচয়ের প্রথম দিনেই মনে হচ্ছিল কত দিনের জানাশোনা। কয়েকদিনের মধ্যেই দেশনেত্রী খালেদা জিয়া তাঁর ক্যাবিনেটে একজন কনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে আমাকে প্রথমে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এবং তারপর ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর এম এ হাসেমের সঙ্গে সম্পর্কটা আরও গভীর হয়ে ওঠে। তিনি বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড় হলেও তাঁর মানসিক শক্তি, কাজের অদম্য স্পৃহা, উদ্দীপনা সব ব্যবধান ঘুচিয়ে দেয়। তাঁর অভিভাবকত্ব ভ্রাতৃসুলভ স্থান থেকে পিতৃত্বের স্থান দখল করে নেয়। আমার কাছে তিনি হয়ে ওঠেন সফলতার এক জীবন্ত কিংবদন্তি। এম এ হাসেম ২০০১ সালে এমপি হলেও আপাদমস্তক ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। শিল্প-বাণিজ্যের উন্নয়নই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু ১/১১-এর লুটেরা সরকার এম এ হাসেমকেও রেহাই দেয়নি। আমরা একসঙ্গে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলাম। কারাগারের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক দিনগুলোও এম এ হাসেমকে দিগ্ভ্রান্ত করতে পারেনি, মানবিকতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কাশিমপুর-১সহ বিভিন্ন কারাগার ঘুরে কাশিমপুর-২ কারাগারে আমাদের ঠাঁই হলো। একদিন পিজি হাসপাতালে আমরা চিকিৎসার জন্য আসব কিন্তু আমাদের একই দিনে একসঙ্গে পাঠাবে না। হাসেম ভাই বেঁকে বসলেন। আমরা অনুরোধ করলাম আপনি বয়সে আমাদের অনেক বড় আপনার চিকিৎসার দরকার অনেক বেশি। কিন্তু আমাদের ছাড়া তিনি আসবেন না। পরিণতিতে হাসেম ভাইকে বরগুনা কারাগারে, ফরিদপুরের এমপি খন্দকার নাসিরউদ্দিনকে ময়মনসিংহ এবং আমাকে নরসিংদী কারাগারে বদলি করা হলো। এ নিয়ে হাসেম ভাইয়ের মধ্যে কোনো ধরনের আক্ষেপ দেখিনি। যেন নিজ ভাইদের জন্য কিছু করতে পেরে তাঁর মুখজুড়ে ছিল প্রশান্তির হাসি।। আমরা কিছুদিন পর আবার কাশিমপুর-২ কারাগারে ফিরে এলাম। কিন্তু হাসেম ভাই বরগুনা কারাগার থেকে কাশিমপুর ফিরে এলেন প্রায় এক বছর পর। হাসেম ভাই, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের পুত্র সাবেক এমপি নাসের রহমান ও আমি এ তিনজনের এক রুমে ঠাঁই হলো। পাশের রুমে ছিলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সালাহউদ্দীন আহমেদ ও রেদোয়ান আহমেদ এবং এর পরবর্তী রুমে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আওয়ামী লীগ নেতা সালমান এফ রহমান। আমাদের ঠিক ওপরে তৃতীয় তলায় ছিলেন সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও গিয়াস উদ্দিন আল মামুন। কয়েকদিন আগে কারাগারের এই কয়েকটি সেল এলাকাজুড়ে জিনের ভীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। রাতে হাসেম ভাইয়ের আর্তচিৎকার জিন, জিন। আমি রুমের এক কোণে ঠাঁই নিলাম। নাসের রহমান অদ্ভুত ধরনের আওয়াজ করছিলেন, প্রকৃতপক্ষে হাসেম ভাইয়ের চিৎকারে জেল কর্তৃপক্ষ ছুটে এলেন। তৎকালীন জেল সুপার (বর্তমানে ডিআইজি প্রিজন) জনাব তওহীদ এলেন। পরদিন কয়েকজন মাওলানা সাহেব সঙ্গে নিয়ে তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকীসহ কারা কর্তৃপক্ষের সবাই এলেন, ঝাড়ফুঁক চলল। নাসের রহমানের গলায় লাল চিহ্ন, যেন কেউ গলা টিপে ধরেছিল, নাসের রহমান ধবধবে ফরসা সুন্দর মানুষ, জানা গেল মেয়ে জিন নাকি তাঁকে আসর করেছিল! সবাই হাসি-তামাশা করলেও সেদিন হাসেম ভাইয়ের মধ্যে সন্তানসুলভ বাৎসল্য দেখেছি। দেখেছি কি পরম মমতায় নাসের রহমানকে আগলে রাখতে, তা মনে হলেই আজ দুই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে আসছে। কাশিমপুর-২ কারাগারের অনেক স্মৃতি আজ আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এত বড় বড় জাতীয় নেতৃবৃন্দ একই কারাগারে থাকলেও সে সময় হাসেম ভাইয়ের কাছে ভিড় লেগে থাকত। কষ্টের মধ্যেও হাসেম ভাইয়ের অনুপ্রেরণাদায়ক জীবনের গল্প সবার মধ্যে আশার সঞ্চার করত। তাঁর শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, তাঁর বাবার মৃত্যুর পর মায়ের সামান্য সঞ্চয় নির্ভর করে ছোট থেকে বড়, বড় থেকে ব্যবসায়ের মহিরুহে রূপান্তরের গল্প, একজন আবুল হাসেমের শিকড় থেকে শিখরে পৌঁছানোর গল্প, এ যেন ছিল যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার চেয়েও রোমাঞ্চকর। তিনি বলতেন, সততা, একনিষ্ঠতা, মেধা দিয়ে জীবনে যে কোনো সাফল্য অর্জন করা যায়। বলতেন, দেশের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার মূলে হলো সততা, নিষ্ঠার অভাব। তাঁর সঙ্গে গল্প করার জন্য সন্ধ্যার পর ঢাকা থেকে চলে যেতেন ডিআইজি প্রিজন মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকী। বিপদে ধৈর্য না হারিয়ে পাহাড়ের মতো তিনি ছিলেন অটল, অবিচল। আজ হয়তো অনুভব করছি কারাজীবনে হতাশা থেকে মুক্ত থাকতে হাসেম ভাই কতটা সঞ্জীবনী শক্তির মতো অপরিহার্য ছিলেন। ১/১১-পরবর্তী প্রায় ১২ বছর হাসেম ভাইয়ের স্নেহ-মমতা থেকে কখনোই বঞ্চিত ছিলাম না। হঠাৎ দুপুরে ফোন আসত খেয়েছি কি না, বলতেন চলে আসো একসঙ্গে খাব। গিয়ে দেখতাম টেবিলে আরও ১২-১২ জন। নিজে খেতেন একেবারেই বাঙালি খাবার কিন্তু অন্যদের জন্য থাকত অনেক রকমের খাবার। হাসেম ভাই খুব ভালো রান্না করতে জানতেন। বিদেশে গেলে নিজ হাতে রান্না করতেন, বাইরের খাবার খুব একটা পছন্দ ছিল না। হাসেম ভাইয়ের মতো খাওয়াতে এত ভালোবাসেন আমার জীবনে এরূপ দ্বিতীয়জনকে দেখিনি। হাসেম ভাই সিটি ব্যাংক, ইউসিবিএল এ দুটি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। দুটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানও ছিলেন। চেয়ারম্যান ছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির সংখ্যা ৭৭টির বেশি। ৭৫ হাজার জনের বেশি কর্মচারী-কর্মকর্তা পারটেক্স গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠনে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর সঙ্গে গল্পের সময় দেখেছি কত কর্মকর্তা-কর্মচারী মারাত্মক ভুল করে ক্ষমা চেয়েছেন, তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমি যখনই যে কোনো বিষয়ে তাঁর কাছে গিয়েছি কোনো দিন বিরক্ত হতে দেখিনি, কোনো দিন ফিরিয়ে দেননি। বস্তুত তাঁর কাছে পৌঁছতে পারলে কাউকে তিনি ফিরিয়ে দিতেন না। এমন বিশাল হৃদয়ের মানুষ আজকের যুগে খুঁজে পাওয়া ভার।

এক সফল জীবনের অধিকারী একজন এম এ হাসেম এবং বেগম সুলতানা হাসেম দম্পতির পাঁচ পুত্রসন্তান। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে বিশাল শিল্পসাম্রাজ্যের নেতৃত্ব ও দায়িত্ব নেওয়ার মতো করে সন্তানদের গড়ে তুলেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই যেমনি উচ্চশিক্ষিত তেমনি পিতার মতো অসম মেধা, সততা ও প্রতিভাদীপ্ত। তাঁদের প্রথম সন্তান আজিজ আল কায়সার টিটু পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং দি সিটি ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান, দ্বিতীয় সন্তান আজিজ আল মাহমুদ মিঠু পারটেক্স স্টার গ্রুপের এমডি এবং আইডিএলসি ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান, মেজ দুই পুত্র আশফাক আজিজ রুবেল এবং আজিজ আল মাসুদ তাঁরা উভয়েই পারটেক্স ও পারটেক্স স্টার গ্রুপের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং পঞ্চম পুত্র শওকত আজিজ রাসেল আম্বার গ্রুপের এমডি। মরহুম এম এ হাসেমের সহধর্মিণী বেগম সুলতানা হাসেম এবং এ দম্পতির পাঁচ পুত্রবধূ যথাক্রমে তাবাসসুম কায়সার, সাভেরা এইচ মাহমুদ, সৈয়েদা সাইরিন আজিজ, জি ইউন শি এবং ফারহানাজ আজিজ পারটেক্স ও পারটেক্স স্টার গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসেবে যুক্ত আছেন। এ ছাড়া পুত্রবধূরা যেমন উচ্চশিক্ষিত তেমনি তাঁরা ব্যাংক, বীমা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসেবে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মরহুম এম এ হাসেমের দ্বিতীয় প্রজন্মের সঙ্গে ইতিমধ্যে তৃতীয় প্রজন্মও শিল্পবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আমাদের প্রত্যাশা তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে সবাই এম এ হাসেমের দেখানো পথ ও ঐতিহ্য ধারণপূর্বক প্রাগ্রসর চিন্তার মাধ্যমে নেতৃত্ব প্রদান করে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক শিল্পপতির স্বপ্ন সার্থক করবেন। যিনি শিকড় থেকে শিখরে আরোহণের এক কিংবদন্তিসম ইতিহাস রচনা করে গেছেন। এম এ হাসেমের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

লেখক : সাবেক উপমন্ত্রী ও সাংগঠনিক সম্পাদক

বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটি।

সর্বশেষ খবর