শনিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

রাবেয়া খাতুন স্মৃতির খসড়া

আমীরুল ইসলাম

ফরিদুর রেজা সাগরের সঙ্গে কুয়ালালামপুর গিয়েছি এক চলচ্চিত্র উৎসবে। গোলাম রব্বানী বিপ্লবের চলচ্চিত্র সেই উৎসবে প্রদর্শিত হবে। আমরা দু-তিন দিন থাকব কুয়ালালামপুর। কিন্তু উৎসবের উদ্বোধনী পর্ব শেষ হতেই সাগর ভাই বললেন, মাঝরাতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট। রেডি হয়ে নাও। ফিরে যাব। ভোরবেলা ঢাকা নামলাম। সাগর ভাই ছুটে গেলেন বাসার দিকে। তাঁর প্রটোকল অফিসার লাগেজ নিয়ে পরে যাবেন। আমি বুঝতে পারলাম রাবেয়া খাতুনের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা। খালাম্মা ঘন ঘন ফোন দিয়েছেন সাগর ভাইকে। তাতে সাগর ভাই টের পেয়ে যান মায়ের কাছে ফিরে যেতে হবে। সব ফেলে, উপেক্ষা করে সাগর ভাই ঢাকা ফিরে এলেন। মাতা-পুত্রের এমনই শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসা। মাতৃভক্তির আদর্শ স্থাপন করেছেন সাগর ভাই। মায়ের চোখের আড়ালে তিনি একটি মুহূর্ত থাকেননি। অফিস আর মিটিংয়ের বাইরে সর্বক্ষণ মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ। স্ত্রী-কন্যা, ভাই-বোন সবাইকে সাগর ভাই জড়িয়ে রাখেন মা রাবেয়া খাতুনকে কেন্দ্র করে। সাগর ভাইয়ের মাতৃভক্তি নিয়ে কিছু লিখতে গেলে সেই লেখার খেই হারিয়ে যাবে। শুরু ও শেষ থাকবে না।

আমি একদিন দুষ্টুমিভরা কণ্ঠে খালাম্মাকে বললাম, কি সৌভাগ্যবান নারী আপনি। পুত্র-কন্যারা আপনার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারেন। জীবনে মা হিসেবে এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? খালাম্মা স্মিত হাসলেন। তারপর বললেন, ‘মনে রেখ আমীরুল, ভালোবাসা কোনো দিন একতরফা হয় না। আমার ভালোবাসা বেশি বলেই ওরা আমাকে এত ভালোবাসে। তবে এও ঠিক, আমার ছেলেমেয়েদের মতো এমন সন্তান কোথাও নেই।’

খালাম্মা সন্তানদের নিয়ে খুব গর্ব করতেন। বাকি সন্তানরা সময়-সুযোগ মতো প্রমাণ করতেন তিনি সাগর ভাইকে অনেক বেশি ভালোবাসেন। খালাম্মা ভ্রমণ ভালোবাসতেন। সাগর ভাই সুযোগ পেলেই খালাম্মাকে নিয়ে লম্বা ট্যুরে বের হয়ে পড়তেন। আম্মা খুশি হলেই সাগর ভাই খুশি হতেন। অচ্ছেদ্য বন্ধন। কত স্মৃতিই মনে পড়ে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখা না গেলে সেই হোটেল রুমে খালাম্মা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। স্বল্পাহারী ছিলেন। প্রতিদিন সকালে ও রাতে সাগর ভাইয়ের সঙ্গে খেতেন।

আমি একবার জিজ্ঞেস করলাম, খালাম্মা আপনি সাগর মিয়া বলেন কেন?

ও তো ব্যবসায়ী। ভালো ব্যবসা বোঝে। ব্যবসায়ী সাগরকে তাই সাগর মিয়া ডাকি। সাগর ভাই দূরের যাত্রা ভ্রমণে খালাম্মা ছাড়া যেতে চাইতেন না। মন তার ছটফট করত। তাই আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে সব সময় ‘না’ করতেন সাগর ভাই। খালাম্মা সঙ্গে থাকলে সাগর ভাইয়ের ভ্রমণ হতো আনন্দময় ও চিন্তাহীন। ২০২০ সালে চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় যেতে বাধ্য হলেন সাগর ভাই। আম্মার জন্মদিন ২৭ ডিসেম্বর। জন্মদিন উদ্যাপন করে সাগর ভাই, কণা আপা আমেরিকা উড়াল দিলেন।

কী নিষ্ঠুর পৃথিবী! কোয়ারেন্টাইনের জালে বন্দী। ৩ জানুয়ারি বিকালে জননী রাবেয়া খাতুনের প্রয়াণ। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু। একেবারেই নিঃশব্দে। কাউকে জ্বালাতন করেননি। কাউকে কষ্ট দেননি। শয্যাশায়ী হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকেননি। সমগ্র জীবনেই রাবেয়া খাতুন কখনো কাউকে বিব্রত করেননি। মৃত্যুর সময়ও একাকী প্রস্থান করলেন। এমন সুরুচিসম্পন্ন নৈতিক মহিলা আমাদের সমাজে বিরল। বয়সকে তিনি জয় করেছিলেন। যেমন ইমদাদুল হক মিলন, সাগর ভাইয়ের প্রিয় বন্ধু। মিলন ভাইয়ের সঙ্গে খালাম্মার ছিল নিবিড় সম্পর্ক। মিলন ভাই বলতেন, ‘আমার বন্ধু রাবেয়া খাতুন’। অভিনেতা আফজাল হোসেনও ছিলেন খালাম্মার পুত্রসম ভক্ত। খালাম্মা বলতেন, ‘সাগরের বন্ধুরা একসময় আমার বন্ধু হয়ে গেল। মিলন, আফজাল, ফরীদি সবাই আমারও বন্ধু।’ খালাম্মা যখন চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন তখন তাঁর পাশে নেই প্রাণের প্রিয় অধিক সন্তানরা। শুধু দেশে ছিলেন বিশিষ্ট রন্ধনবিদ কেকা ফেরদৌসী আর ছিলেন মুকিত মজুমদার বাবু। প্রিয় পুত্র ফরিদুর রেজা সাগরের আসার কোনো উপায় নেই। করোনা সংকটের কারণে ইচ্ছা করলেই রওনা দেওয়া যাবে না। কী দুর্ভাগ্য! সাগর ভাই, প্রবাল ভাই, কাকলী আপা হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থান করছেন। মায়ের সঙ্গে সারা জীবন জড়িয়ে থাকলেন। মৃত্যুর সময় উপস্থিত থাকতে পারেননি। জীবন এত কঠিন কেন? প্রকৃতি এত নিষ্ঠুর কেন?

আমি জানি সাগর ভাই, কণা রেজা, প্রবাল ভাই, নিকি ভাবী, মামুন ভাই, কাকলী আপা কারও চোখের জল বাকি জীবনে ফুরাবে না।

সাগর ভাই সব সময় বলতেন, ‘আমি তো মায়ের আশ্রয়ে থাকি। আমার তো কোনো ঘরবাড়ি নেই।’ যখন বনানীর বাসায় উঠলেন তখন একটাই চিন্তা মা যেন কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতা অনুভব না করেন। বিখ্যাত স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর সেভাবেই নকশা করলেন।

পুবমুখী খালাম্মার প্রশস্ত ঘর। আলো-বাতাসের খেলাধুলা। মূল দরজাটা সব সময় খোলা থাকত। উল্টো দিকে ড্রয়িংরুম। আর একটা চেয়ার। অবসরে সাগর ভাই সেই চেয়ারে বসেন। ড্রয়িংরুমে বিশাল টেলিভিশন। টিভির সঙ্গেই খালাম্মার ঘরের দরজা। সেখানেই প্রশস্ত খাট। খাটে খালাম্মা বসে থাকেন। সাগর ভাই টিভি দেখতে দেখতে উঁকি দেন। খেয়াল করেন খালাম্মা কী করছেন। আবার খালাম্মাও চোরা চোখে দেখে নিতেন সাগর ভাইকে। ডান দিকে বেডরুম। রাতে দু-এক বার ঘুম ভাঙলে সাগর ভাই উঁকি দিয়ে যেতেন। আম্মা ঘুমাচ্ছেন কি না। আম্মা ঘুমিয়ে আছেন এ দৃশ্য দেখে সাগর ভাই পরম নিশ্চিন্তে আবার ঘুমিয়ে পড়তেন।

খালাম্মার কোনো মৃত্যুচিন্তা ছিল না। তিনি ছিলেন অসম্ভব জীবনবাদী। খালাম্মা প্রায়ই সাগর ভাইকে বলতেন, ‘এত কাজ করার দরকার নেই। বিশ্রাম নাও। তোমার যদি কিছু হয়!’

খালাম্মার চোখ ভিজে উঠত। আমাদেরও বলতেন, ‘যাও বস। অসুস্থ হয়ে গেলে তোমাদের কী হবে?

খালাম্মা ছিলেন গভীর মমতাময়ী দরদি জননী। বটবৃক্ষের মতো। মাথার ওপর ছিলেন তিনি। তাঁর ছায়ায় আমরা প্রাণিত থাকতাম। আমার অনেক বড় ভরসার স্থান ছিলেন প্রিয় রাবেয়া খাতুন।

মৃত্যু তো জীবনের স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এ মৃত্যু আমাকে চিরবেদনার উৎসমুখে দাঁড় করিয়েছে। খালাম্মা আপনি না থাকায় আমরা যে আশ্রয়হীন আপনি কি জানতেন? আর কোথাও ঘুরতে যাওয়া হবে না। আপনার সঙ্গে দেখা হবে না। আপনাকে ছাড়া যে কোনো আনন্দই নিরানন্দ।

সর্বশেষ খবর