রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

একজন আজিজ কোম্পানি

শাইখ সিরাজ

একজন আজিজ কোম্পানি

আমি বরাবরই বলে আসছি কৃষিতে বিনিয়োগের আগে অবশ্যই বুঝেশুনে নেওয়া উচিত। একজনের সাফল্য দেখেই না বুঝে বড় ধরনের বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে। সময়টাই এখন ভিন্ন রকম। উচ্চমূল্যের ফলফসল চাষে সাফল্য দেখিয়ে একশ্রেণির উদ্যোক্তার উদ্দেশ্যই থাকে চারা বিক্রি। বাণিজ্যিক কৃষি উৎপাদনের আগে অনেক পরিমাপক ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া দরকার। উৎপাদন খরচ, বিক্রয়মূল্য কত হবে, বাজারজাত কীভাবে করা হবে সবকিছু সম্পর্কে সম্যক ধারণা না নিয়ে হুজুগে বিনিয়োগ করলে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার কৃষক আজিজ বেশ সচেতন। এলাকার মানুষ অবশ্য তাঁকে চেনে আজিজ কোম্পানি হিসেবে। তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজকর্মের মাধ্যমে একাই কোম্পানি হয়ে উঠেছেন। নিজেকে চাষা পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। গত দেড় দশকে বহুবার তাঁর কাছে যেতে হয়েছে তাঁর অভূতপূর্ব কৃষি কর্মকান্ড দেখতে। ২০০৮ সালে তিনি পান ‘চ্যানেল আই কৃষি পদক’। আর এখন তিনি সারা দেশে পরিচিত এক উদ্ভাবনী কৃষক হিসেবে। দু-এক বছর পরপরই তিনি দেখান নতুন বৈচিত্র্য। বর্তমান সময়ে দেশে উচ্চমূল্যের ফলবাগান কিংবা পরিকল্পিত খামার গড়ে তোলার ধুম পড়েছে। যখন এ উদ্যোগগুলো মানুষের মনে বিস্ময় জাগাত চাষা আজিজ তখন দেখিয়েছেন চমক। লেবুবাগান, মাল্টাবাগান, কুলবাগান, ট্যাং ফল বা প্যাসন ফলের বাগান গড়ে চাষা আজিজ সাড়া ফেলেছেন। বলে রাখা ভালো, আজিজ এক অন্যরকম খ্যাপাটে কৃষক। বিত্তবৈভব কিংবা চাকচিক্যের প্রতি তাঁর মোহ নেই। তাঁর গভীর আকর্ষণ মাটির প্রতি। কৃষি ও কৃষকের প্রতি। গত ২০ বছরে তাঁর বাড়িটিরও কোনো পরিবর্তন নেই। তিনি বলেন, এখানে যে প্রাণের সন্ধান পান নতুন কিছু করে সেখানে তা পাবেন না।

এবার চাষা আজিজ নতুন এক বার্তা নিয়ে এসেছেন উদ্যোগী খামারিদের জন্য। দেশের মাটিতে ছড়িয়ে পড়া কমলার বাগান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ তাঁর। তাঁর মতে আমাদের দেশে এখন নার্সারি ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে বহু ধরনের জাত বিক্রির চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমাদের মাটিতে কোনটি উপযুক্ত হতে পারে সে বিষয়ে জানা জরুরি। বাণিজ্যিক চাষের আগে জাত নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। আজিজ তাই কমলা ও মাল্টার যতগুলো জাত নার্সারিতে পাওয়া যায় সব সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলক চাষ করেছেন। তিনি তাঁর বাগানের বিভিন্ন জাতের কমলার বাগান ঘুরে দেখাতে দেখাতে বলছিলেন, ‘ম্যান্ডারিন ও দার্জিলিং জাতের কমলা আমাদের দেশে বাণিজ্যিকভাবে বাগান করলে খুব একটা লাভবান হওয়া যাবে না।’ দেখলাম বেশ কিছু গাছে উপরিভাগের কমলা শুকিয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে পাতাও। আবার বিভিন্ন ধরনের রোগের আলামতও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আজিজ বলছিলেন, রোদ্রতাপে পুড়ে গেছে। কিন্তু আমার মনে হলো রোদে নয়। অন্য কোনো কারণ আছে। তাই ফিরে এসে কমলার এ অবস্থা নিয়ে কথা বলেছিলাম সরকারের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. মেহেদী মাসুদের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এফিড, হোয়াইট ফ্লাইজ এবং স্কেল ইনসেক্ট এ তিন ধরনের পোকার আক্রমণে প্রচুর হানিডিউ সিক্রেশন করে। হানিডিউ যেহেতু মিষ্টি এতে ফাঙ্গাসের সংক্রমণ হয়। ফলে কমলার গায়ে কালো দাগ পড়ে। তিনি আরও জানালেন ১৪ ফিটের মতো একটি গাছের দৈনিক ৫৩ লিটার সেচ প্রয়োজন এবং মাঝারি ধরনের একটি গাছে কমপক্ষে দৈনিক ২৫ লিটার সেচ দেওয়া প্রয়োজন হয়। তিনি জৈবসার প্রয়োগ ও মালচিং করার পরামর্শ দিয়েছেন। গত বছর করোনার কঠিন সময়ে এসে দেখেছিলাম চাষা আজিজ প্রযুক্তিনির্ভরতায় নতুন উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনে নিয়োজিত হয়েছেন। ৩ একর জমিতে বলসুন্দরী কুল চাষ করেছিলেন। এ বছর আর সেখানে আটকে নেই। সেই কুলের বাগানের জায়গাটিতেই এখন উৎপাদন হচ্ছে কমলা। কুল গাছ কেটে দিয়ে কমলার গাছ বড় করেছেন। ৩ একর জমিতে ১ হাজার চায়না ম্যান্ডারিন আর ১ হাজার দার্জিলিং জাতের কমলা গাছ। গাছে গাছে ব্যাপক কমলা ধরেছে। তবে আজিজ বলছিলেন জমির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে পেঁপে চাষের উদ্যোগ নিয়ে এবার বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তিনি জানালেন রংপুর থেকে ২ হাজার ৫০০ পেঁপের চারা আর ৫ হাজার মরিচের চারা রোপণ করেছিলেন। পেঁপের ২৫%-এর মতো চারা ফল দিয়েছে। বাকিগুলো টেকেনি। মরিচের চারার অবস্থা আরও খারাপ। তিনি মনে করেন চারার ব্যাপারে নার্সারি কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভরশীলতা যেমন কমিয়ে আনতে হবে, চারার মান নিয়ন্ত্রণে নার্সারিগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।

আজিজ বরাবরের মতো বাগানে জৈবকৃষি অনুশীলনকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। দেখালেন একই গাছে এক ডালের ফলে রং আনতে প্রয়োগ করেছেন ওষুধ। অন্য ডালে প্রাকৃতিক উপায়ে ফল পাকাচ্ছেন। বললেন, মানুষ বেশি রং পছন্দ করে। অথচ রঙিন ফল খেতে গিয়ে রাসায়নিক খাচ্ছে বেশি। চাষা আজিজ একটি কাজ সব সময় করেন। বাগানের ফল মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন। এর আগে যেবার প্রথম তাঁর বাগানে মাল্টা হলো, তিনি বাগানের মাল্টা কেটে সারাটি গ্রামের মানুষের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে অনেকের বাড়িতেও গিয়েছিলাম। তাঁর স্বপ্ন ছিল স্কুলের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মুখে নিয়মিত ফল তুলে দেওয়া। আবার বছরের প্রথম দিন কৃষকদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান। আর যাওয়ার সময় হাতে তুলে দেন ফলের চারা। এবারও উপস্থিত কৃষকের জন্য চাষা আজিজ বাগানের ড্রাগন ফল খাওয়ানোর উদ্যোগ নিলেন। আজিজ বরাবরই খেদ প্রকাশ করেন, কৃষকের কোনো স্কুল নেই। তিনি টেলিভিশনকে দেখেন কৃষকের স্কুল হিসেবে। সেই বিশ্বাসে নগরকে বাঁচানোর তাগিদও সৃষ্টি হয়েছে তাঁর। পাহাড়ি মাটির আনারস কীভাবে ছাদকৃষিতে পৌঁছে দেওয়া যায় সে লক্ষ্যে কাজ করছেন তিনি। অনেক ছাদকৃষিতেই আনারস গাছ দেখেছি। তারা নিশ্চয়ই চাষা আজিজের এ উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হবেন। বিশ্বাস করি অল্প দিনেই অনেক ছাদকৃষিতে এ পাহাড়ি আনারসও পৌঁছে যাবে চাষা আজিজের বদান্যতায়।

আগেই বলেছি চাষা আজিজ বরাবরই বাণিজ্যিক কৃষিতে মনোযোগী। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন কৃষি কখনো নিশ্চিত লাভের মাধ্যম নয়। এখানে উত্থান-পতন থাকবেই। প্রতিনিয়ত নতুন বৈচিত্র্যের পথে এগিয়ে যেতে হবে। চাষা আজিজের ক্ষেত্রে তা বেশি প্রমাণিত। তাঁকে বিশেষ কোনো ফলফসলের চাষি হিসেবে পৃথক করার সুযোগ নেই। তিনি প্রতিনিয়ত ভাঙচুর করেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। কৃষির নতুন প্রযুক্তি খোঁজেন, নিজেও নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে চান। সব সময় কাজের সঙ্গে মানবিকতা যুক্ত করেন তিনি। এখনো স্বপ্ন দেখেন সেই আগের মতোই- সব মানুষকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।

আজকের দিনে কৃষিতে বিনিয়োগ করছেন যে কোনো পেশার মানুষ। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গৃহবধূ পর্যন্ত আসছেন কৃষিতে। শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তারা কৃষিতে ভালো করছেন। এরই মধ্যে বহু সাফল্যের নজির দেখেছি। তবে একটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তা হচ্ছে আমরা কোন গাছ রোপণ করব, কোন জাত এ মাটির জন্য উপযোগী হবে। কোনটি স্বল্পমেয়াদি আর কোনটি হবে দীর্ঘমেয়াদি। ফলফসলের সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যার বিষয়টিও জানা জরুরি। নতুন উদ্যোক্তারা কোনোভাবে প্রতারিত হলে এ শুধু ওই ব্যক্তি উদ্যোক্তার জন্য ক্ষতি নয়, ক্ষতি গোটা কৃষির জন্য। এ ক্ষেত্রে চাষা আজিজের মতো গভীর বোধসম্পন্ন ও বিজ্ঞানপ্রিয় কৃষকদের চিন্তাভাবনা ও পরামর্শ আমাদের অনেক বেশি প্রয়োজন।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর