রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

শরিকানা ও সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ে যে ভুলগুলো করবেন না

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

শরিকানা ও সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ে যে ভুলগুলো করবেন না

আপনি জমি কিনতে আগ্রহী এমন সংবাদ চাউর হওয়ার পর দালাল বা প্রতারক চক্র এসে আপনাকে সস্তায় ভালো জমির খবর দেবে এবং জমি যাতে হাতছাড়া না হয় তার জন্য আপনাকে দ্রুত বায়না কিংবা রেজিস্ট্রি করে মূল্য পরিশোধ করার বিষয় তাগিদ দেবে। কিন্তু কেনার পর আপনি দেখবেন বিক্রেতা ওই জমির প্রকৃত মালিক হিসেবে দখলকার ছিলেন না কিংবা ওই জমি নিয়ে অন্য অংশীদারদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিবাদ চলেছে কিংবা বিক্রেতা ইতিপূর্বে তার সবটুকু অংশ বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে তার বিক্রিযোগ্য কোনো স্বত্ব নেই কিংবা জমিটি অর্পিত সম্পত্তি কিংবা সরকার কর্তৃক হুকুমদখলকৃত জমি কিংবা যে ওয়ারিশসূত্রে বিক্রেতা মালিকানা দাবি করেছে তা উপযুক্ত আদালত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শরিক ফাঁকি দেওয়া, ফারায়েজের অংশ নিয়ে লুকোচুরি খেলা, জমি ক্রেতাকে ভুল তথ্য দেওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই এজমালি সম্পত্তি কেনার আগে ওয়ারিশান সনদপত্র যাচাই করে নিন; যা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যান কর্তৃক ইস্যু করা হয়। এজমালি সম্পত্তি বিক্রেতার নিজ নামে নামজারি বা মিউটেশন হয়েছে কি না দেখে নিন। যদি না থাকে তাহলে দেখে নিন বিক্রেতার পূর্বপুরুষ অর্থাৎ বিক্রেতা যার ওয়ারিশ হিসেবে সম্পত্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন তার নামে রেকর্ড হাল খতিয়ান আছে কি না। যদি থাকে তাহলে দেখে নিন বিক্রেতার ফারায়েজ-মতো প্রতি দাগে প্রাপ্ত বিক্রয়যোগ্য অংশ। আর যদি কোনো এজমালি সম্পত্তির লিখিত বাটোয়ারা দলিল থাকে তবে তা অবশ্যই রেজিস্ট্রি হতে হবে এবং তিনি দলিলে যে পরিমাণ সম্পত্তি পেয়েছেন শুধু সেটুকুই বিক্রি করতে পারবেন। পাশাপশি আপনাকে দেখে নিতে হবে যৌথ ইজমেন্ট সুবিধা আছে কি না। অর্থাৎ পথের অধিকার, চলার অধিকার, আলো-বাতাস ও পানির অধিকার। সেই সঙ্গে দেখতে হবে ওই জমি কেনার পর প্রিয়েমশান বা অগ্রক্রয় বা শুফা অধিকার প্রয়োগের মামলার সম্ভাবনা আছে কি না। সে কারণ এরূপ এজমালি সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে বায়নানামা দলিল কিংবা সাফকবলা দলিলে যদ্দুর সম্ভব অন্য ওয়ারিশানদের সাক্ষী ও শনাক্তকারী হিসেবে রাখা উচিত। তাহলে অন্যান্য শরিক বা সহশরিকরা এ সুযোগ আর গ্রহণ করতে পারবে না। পাশাপাশি এ-জাতীয় এজমালি সম্পত্তির বিক্রয় চুক্তি হওয়ার পর সম্পত্তির ওপর নোটিস টাঙানো ও পত্রিকায় আইনগত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারেন। সংশ্লিষ্ট জমি সরকার বা কোনো সংস্থাকে ঋণ গ্রহণের মর্টগেজ দেওয়া আছে কি না, বিক্রি প্রস্তাবিত জমিতে কোনো বিরোধ বা মামলা-মোকদ্দমা আছে কি না এগুলো ভালো করে যাচাই করে নিন। এজমালি সম্পত্তি বাদে অন্যান্য জমি কেনার আগে দেখে নিন যে ১. জমি বিক্রেতার প্রকৃত মালিকানাস্বত্ব আছে কি না ২. মালিকানার প্রমাণ হিসেবে বিক্রেতার নামে সর্বশেষ জরিপের এস এ রেকর্ড অথবা আর এস রেকর্ড আছে কি না ৩. বিক্রেতা যদি কেনাসূত্রে জমির মালিক হন তাহলে তার নামে মিউটেশন বা নামজারি করা হয়েছে কি না ৪. বিক্রি প্রস্তাবিত জমির দখল যাচাই করা ৫. জমির হালনাগাদ খাজনা পরিশোধ আছে কি না ৬. জমির দাগ ও খতিয়ান নম্বর জেলা রেকর্ডরুম থেকে তুলে জমির মালিকানাসূত্র নিশ্চিত হতে পারেন ৭. জমি রেজিস্ট্রি করার আগে রেকর্ড, নকশায় ও সরেজমিন জমির দাগ নম্বর শনাক্ত করে নিন ৮. কৃষিজমি কেনার ক্ষেত্রে রেকর্ডীয় মালিকানায় অংশীদাররা অগ্রক্রয়াধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। সে কারণে অংশীদারদের সম্মতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিন ৯. স্ট্যাম্প ফিস ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে জমির বাজারমূল্য অপেক্ষা কম মূল্য নির্ধারণ করে দলিল রেজিস্ট্রি করা থেকে বিরত থাকুন। এতে স্ট্যাম্প আইনের ৬৪ ধারা মোতাবেক ক্রেতা/বিক্রেতা উভয়েরই শাস্তি হতে পারে ১০। বিক্রির জন্য প্রস্তাবিত জমি সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বে অধিগ্রহণ হয়েছে কি না অথবা অধিগ্রহণের প্রস্তাবাধীন কি না তা সংশ্লিষ্ট অফিস হতে যাচাই করে দেখে নিন ১১. একই জমি একাধিকবার বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তরিত হয়েছে কি না ১২. জমির খাজনা/ভূমিকর অনাদায়ে নিলাম হয়েছে কি না ১৩. জমি শিকস্তি হওয়ায় মালিকানা বিলুপ্ত হয়েছে কি না ১৪. সংশ্লিষ্ট জমি সরকার বা কোনো সংস্থাকে ঋণ গ্রহণের মর্টগেজ দেওয়া আছে কি না ১৫. বিক্রি প্রস্তাবিত জমিতে কোনো বিরোধ বা মামলা-মোকদ্দমা আছে কি না এগুলো ভালো করে যাচাই করে নিন। নতুবা সারা জীবনের অর্জন দিয়ে এক টুকরো জমি কিনে বাকি জীবন ঝামেলার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হবে।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

                   Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর