শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ভার্চুয়াল ভুবনের ভয়ংকর ভাষা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ভার্চুয়াল ভুবনের ভয়ংকর ভাষা

ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি স্বর্গ মর্ত্য পাতাল- স্রষ্টার এ তিন সৃষ্টিকে একত্রে ত্রিভুবন বলা হয়। তবে আজ উপলব্ধি করছি সভ্য দেশের সভ্য মানুষের কাছে আবির্ভূত হয়েছে ভার্চুয়াল ভুবন নামে আরেকটি বাস্তবতা। মনে পড়ে ২০১১ সালে ভারতে শাহরুখ খান তাঁর নিজস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থেকে সে আমলেই ১৩২ কোটি রুপি ব্যয় করে ‘রা ওয়ান’ নামে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিনির্ভর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে ভার্চুয়াল ভুবনের নতুন গেমের পরিচিতির জন্য আয়োজিত বরেণ্য ব্যক্তিদের এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার কাছে থাকা স্মার্টফোন, ট্যাব ও ল্যাপটপ কম্পিউটারে প্রতি সেকেন্ডে অদৃশ্য কত শত সহস্র বার্তা বা তথ্য আসে তা লেজার রশ্মির মধ্যমে উপস্থাপন করেন। একটি কক্ষে একই সময়ে এত শত লেজার রশ্মির উপস্থিতি পর্দার মানুষকে উল্লসিত করলেও ভাবিয়ে তুলেছিল হলভর্তি মানুষকে। দিল্লির একটি অত্যাধুনিক সিনেপ্লেক্সে বসে ২০১১ সালে ছবিটি দেখার সময় এ দৃশ্য চলাকালে অন্যদের মতো আমিও নিজের অজান্তে পকেটে হাত দিয়ে নিশ্চিত হয়েছি আমার মোবাইল ফোনটি আছে কি না। কারণ মোবাইল ছাড়া চলা অসম্ভব, এমন আতঙ্ক ক্রমে গ্রাস করছে আমাদের সবাইকে। পশ্চিমা বিশ্বে এ আতঙ্ককে একটি মানসিক রোগের সঙ্গে তুলনা করা হয় এবং এ-সংক্রান্ত নতুন রোগের নাম ‘নো মোবাইল ফোবিয়া’ সংক্ষেপে নোমোফোবিয়া রাখার প্রস্তাব করা হয়। ইন্টারনেটে নোমোফোবিয়া লিখে সার্চ দিলেই এ-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়।

তবে আজ আমার ভয় নোমোফোবিয়া নিয়ে নয়, বরং মোবাইল ফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপ কম্পিউটারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল ভুবনের সঙ্গে ভাব জমানো আগামী প্রজন্ম নিয়ে। কারণ এ ভার্চুয়াল ভুবনেই ভেসে বেড়াচ্ছে ভয়ংকর সব ভাষা, যা নিয়ে ভাষাভাষী ভাবনার সুযোগ নেই বরং ভাবতে হবে অনেক গভীরে। এমনি এক ভয়ংকর ভাষা দীর্ঘ দুই বছরের ভবনিদ্রা শেষে হঠাৎ করেই এ ভবজগতে উদয় হলো বছর শেষে। বর্তমান সরকারের একজন ভবতী (সম্মানিত) ভূতপূর্ব মন্ত্রী মহোদয় দীর্ঘ দুই বছর আগে চলচ্চিত্রের রঙিন ভুবনের একজন নায়ক ও আরেক নায়িকার সঙ্গে টেলিফোনে যে অতি ভয়ংকর অশ্লীল ভাষায় ভাববিনিময় করেছেন, তা ভাবিয়ে তুলেছে ভার্চুয়াল ও বাস্তব ভুবনের ভদ্রসমাজকে। একই সঙ্গে ভাবনায় ভর করেছে ভারী ভারী সব প্রশ্ন। এ কলরেকর্ড প্রমাণ করল রাষ্ট্রের একজন মন্ত্রীর কথাও ভার্চুয়াল জগৎ থেকে এ ভুবনের নির্দিষ্ট ভান্ডারে ভিড়তে থাকে এবং সময়মতো ভয় দেখানোর জন্য কিংবা আপৎ বিদায়ের জন্য তার রেকর্ডকৃত ভয়েস ভেসে বেড়াতে পারে ভবের হাটবাজারে। সুতরাং রাষ্ট্রের বাকিদের এখন যা ভাবা উচিত তা-ই ভাববেন, এটাই স্বাভাবিক। একই কলরেকর্ড প্রমাণ করছে একজন পাপিয়া ওয়েস্ট ইনের মতো অভিজাত ভোজনালয়ে ভিড়তে না পারলেও রাজধানীতে ভবলীলা চালিয়ে যেতে রয়ে গেছে আরও অনেক রঙিন ভুবন, যেখানে ভজন-সাধন সবই সম্ভব। যে বাহিনীকে সাধারণ মানুষ ভয় কিংবা সমীহ করে চলে সে বাহিনীকে তিনি একজন নায়িকাকে তুলে আনার কাজে লাগাতে চেয়েছেন সকল প্রকার ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকেই। একদা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান মান নিয়ে অনেকে অনেক কথা বললেও এই মন্ত্রীর একটি উক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সব ভক্তি বিনষ্টে যথেষ্ট। তবে বিরোধীদলীয় নেতার পরিবারের এক কন্যাকে নিয়ে তার রগরগে ভাষা একজন শিক্ষিত চিকিৎসকের মুখ থেকে কীভাবে প্রকাশ পায় তা ভেবে অনেকেই ভড়কে গেছেন। তবে এ কথাও সত্য, ভিন্ন দলের একজন নারী বা নেত্রীকে নিয়ে মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে যে ভাষায় অন্য নারী সংসদ সদস্যরা অতীতে বিষোদগার করেছেন, তা বোধকরি কেবল এ দেশেই সম্ভব। ভয়ংকর সেসব ভাষা আজও ভেসে বেড়াচ্ছে ভার্চুয়াল ভুবনে। ভবলীলা সাঙ্গ করে আমরা কিংবা এই ভবতী মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যরা হয়তো এ ভুবন ছেড়ে অদূর ভবিষ্যতেই পাড়ি জমাবেন চিরস্থায়ী আরেক ভুবনে। কিন্তু ভার্চুয়াল ভুবনের এ অশ্লীল ভাষাগুলো ঠিক ভেসে বেড়াবে বাতাসে বাতাসে। আর তা শুনে ভবিষ্যতের কোনো প্রজন্ম হয়তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রশ্ন’ কবিতায় কবির উচ্চারিত সেই প্রশ্নই বারবার করবেন-

‘যাহারা তোমার বিষাইয়াছে বায়ু,

নিভাইয়াছে তব আলো,

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ,

তুমি কি বেসেছো ভালো।’

ভার্চুয়াল ভুবনের এ ভাবনায় আমাদের ভুলভ্রান্তি থাকলেও পশ্চিমা বিশ্বের একটি দেশ নিয়ে কতটা ভাবাবিষ্ট তারও প্রমাণ মিলেছে। ভয়ে কিংবা ভাগ্যান্বেষণে সেই মন্ত্রী বিমানে ভর করে পাড়ি জমালেন জলে ভরা দুই মহাসাগরের মাঝের এক দেশে। এ দেশে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া অনেকেই ভিড় করেছেন। কিন্তু ভিড়তে পারলেন না ভূতপূর্ব এই মন্ত্রী। সে দেশের বিমানবন্দরের ভ্রাতাগণ তাঁকে ভদ্রোচিতভাবেই আরেকটি বিমানে তুলে দিলেন অন্য কোনো দেশে ভ্রমণের জন্য। পরে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ ছুঁয়ে চলে আসেন নিজ ভুবনে। শোনা যায় মধ্যপ্রাচ্যেও তার ঠাঁই হয়নি। তবে কোনো ভগিনী, ভামিনী (নারী) কিংবা ভট্টিনীকে (মহীয়সী) নিয়ে ভড় ভড় করে ভয়ংকর ভাষা প্রয়োগের কারণেই তাঁকে ভবঘুরের মতো ভোগান্তি পোহাতে হলো কি না, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তবে বর্তমান বলছে, পুলিশের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র অভিযোগ দায়েরের পরও তিনি রাষ্ট্রের সব কর্তাব্যক্তির সামনে দিয়েই বিমানে ভর করে বিদেশে গেছেন এবং বিমানেই ফেরত এসে নিজ গন্তব্যে প্রবেশ করেছেন। ভার্চুয়াল ভুবনে তাঁকে বিমানবন্দরে কালো শার্ট পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। দেশের ইমেজে এ ঘটনা কতটা কালো দাগ লেপন করল তা নিয়ে কেউ ভাবেন কি?

ভার্চুয়াল জগতে অনেকেরই ভয়ংকর ভাষা সংরক্ষিত আছে, তা নিশ্চিত। তবে তা প্রকাশ করা কতটা শোভনীয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কল্যাণকর, তা নিয়েও ভাবতে হবে। কেবল সরকারি দলের মন্ত্রীই নয়, বিরোধী দলের একজন সিনিয়র নেতাও যে একজন শীর্ষ ক্ষমতাসীন নারী নেত্রীর সঙ্গে পাশের একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন, তা প্রমাণের জন্য দেশের একটি সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেল সেই অশ্লীল কথাবার্তা ভার্চুয়াল জগতে ছেড়ে দেয় বা প্রচার করে। সুতরাং এ টিভিতে এভাবে প্রচারের আগে যতজন বিষয়টি শুনেছেন বা জেনেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এখন তা জানল ও শুনল। আর ভার্চুয়াল ভুবনেও তা স্থায়ীভাবে রয়ে গেল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা দেশের প্রচলিত আইনের ঊর্ধ্বে উঠে একজন অভিভাবক হিসেবে মনে করি মূলধারার গণমাধ্যমে এমন প্রচার বিবেকপ্রসূত বিবেচনায় বন্ধ করা হোক। ভার্চুয়াল ভুবন নয়, লেখাটা শেষ করতে চাই ১৪ ডিসেম্বর, ১৬৬১ সাল অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক ৩৬০ বছর আগের একটি বাস্তব ঘটনা স্মরণ করে। ১৬২৮ থেকে ১৬৫৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছর মুঘল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন জগৎখ্যাত সম্রাট শাহজাহান। তাঁর ছিল চার পুত্র, যথাক্রমে দারাশিকো, শাহ সুজা, আওরঙ্গজেব ও মুরাদ বখশ। মুরাদ মুলতানের সুবেদার নিযুক্ত হন। পর্যায়ক্রমে তিনি কাশ্মীর, কাবুল, গুজরাটসহ বহু প্রদেশ শাসন করেন। ১৬৫৭ সালে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে কথা ওঠে। এ সময় মুরাদ নিজেকে আহমদাবাদের শাসক ঘোষণা করেন। এরপর আরও ক্ষমতার লালসায় ভাই আওরঙ্গজেবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আপন বড় ভাই দারাশিকোর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন। কারণ প্রথা মোতাবেক বড় ভাই দারাশিকোর পরবর্তী মুঘল সম্রাট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে পথ পাল্টে দেন আওরঙ্গজেব ও মুরাদ। ১৬৫৮ সালে সামুগড়ের যুদ্ধে দারাশিকো পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান। ফলে আওরঙ্গজেব মুরাদের সমর্থন নিয়ে নতুন মুঘল সম্রাট হন। একই বছর অর্থাৎ ১৬৫৮ সালের ৭ জুলাই একটি তাঁবুতে বিশ্রাম করছিলেন দুই ভাই আওরঙ্গজেব ও মুরাদ। এ সময় মুরাদকে গোপনে মদপান করিয়ে অপ্রকৃতিস্থ ও বন্দী করা হয়। এরপর তাঁর ঠাঁই হয় গোয়ালিয়র দুর্গের একটি কারাগারে। তিন বছর বন্দী থাকার পর একজন রাজকর্মচারীকে হত্যার দায়ে গোয়ালিয়র দুর্গেই ১৬৬১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আওরঙ্গজেব সিংহাসন নিষ্কণ্টক করতে মুরাদকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। ১৪ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে যখন এই ৩৬০ বছর আগের মুঘল ইতিহাস পড়ছিলাম, তখন একটি প্রশ্নই বারবার মনে উঁকি দিচ্ছিল। মুরাদরা ইতিহাস থেকে কেন শিক্ষা নেয় না?

                লেখক : কলামিস্ট, গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর