সোমবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

নিরপেক্ষ সরকার না হলে যে কোনো নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হতে বাধ্য

খায়রুল কবীর খোকন

নিরপেক্ষ সরকার না হলে যে কোনো নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হতে বাধ্য

নূরুল হুদা কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে ফেব্রুয়ারিতে। তাই যথারীতি আরেকটি নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আনুষ্ঠানিকতা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি দলের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে, এটি এখন এক চলমান প্রক্রিয়া। পাশাপাশি ৩৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক এ সংলাপকে সফল করার জন্য বিশেষ কিছু প্রস্তাবনা পেশ করে গত ২২ ডিসেম্বর বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলামসহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী রয়েছেন। অন্যরা বেশির ভাগই এনজিও পরিচালনাকারী ব্যক্তি-“বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বিদেশি তহবিল ‘শিকার’ করার মতো বেশ চতুর লোকজন আছেন। তারা হঠাৎ এ সংলাপের মধ্যে ‘বিশাল সম্ভাবনা’ দেখতে পেয়েছেন। সদিচ্ছা না থাকলে সংলাপ কি অশ্বডিম্ব প্রসব করে তা তো কারও অজানা নয়। এ দেশের কোনো ফাইভ পাস কিশোরেরও যা বোঝার কথা তা তারা বুঝতে চাচ্ছেন না। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি-সিক স্যারকে (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) এবং ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলামকে অনুনয়-বিনয় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিভ্রান্ত করে বিবৃতি আনা হয়েছে।

এ সংলাপ আদৌ কি সুফল আনতে সক্ষম হবে? গতবারের অভিজ্ঞতা কী বলে? কেন এ রাষ্ট্রীয় অপচয়, রাষ্ট্রপতির সময়ের অপচয়? একটা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া এদেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন কি সম্ভব? নির্বাচন কমিশনে যদি কয়েকজন ‘ফেরশতা-মানব’ এনে বসিয়ে দেন তাতেও না। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কি আদৌ একটা ‘সৎ ও দক্ষ নির্বাচন কমিশন’ গঠনের সুযোগ দেবে যে কমিশন যথার্থ নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হতে পারে? এসব সংলাপের দ্বারা তা সম্ভবই নয়। গত ১৩ বছরের অভিজ্ঞতা তো তা-ই বলে। আগে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কায়েমের ব্যাপারে একমত হতে হবে সরকারদলীয় নেতাদের, তারপরে অন্য সিদ্ধান্ত।

‘বাঘের পিঠে চড়ে বসা’ এ কর্তৃত্ববাদী সরকার নির্বাচনে হেরে গিয়ে ক্ষমতা হারিয়ে বিরোধী দলে যাওয়ার কথা কল্পনা করতেও ভয় পায়। ১৩ বছর ক্ষমতায় থেকে যে দুর্নীতি, প্রশাসনিক অনাচার, ভিন্নমতের লোকজনের ওপর নির্যাতন চলেছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন করার সাহস ক্ষমতাসীন দল হারিয়ে ফেলেছে। ক্রসফায়ারে হত্যাকান্ড, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপরে একের পর এক মামলাসহ শত প্রকার অত্যাচার-নির্যাতন, টাকা লুট করে বিদেশে পাচার, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাইকারি লুণ্ঠনবাজি, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, অপরিসীম নারী নির্যাতন, শিশু পীড়ন, সব ক্ষেত্রে অনিয়ম দুঃশাসন, বাকস্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হরণ- এসবের পরেও জনগণের ভোট অসম্ভব ব্যাপার।  আসল সংকটটি হলো- পাকিস্তান আমলের ষাট দশকের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ও আশির দশকের স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতো একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার রাষ্ট্রের ঘাড়ে চেপে বসেছে। আইনি পদ্ধতিতে অথবা গণআন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারকে নামানোর প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হবে। প্রবল গণআন্দোলন সম্ভব হয়নি বলেই এ সরকার টিকে আছে আমলাতন্ত্র আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর শক্তিতে ‘গায়ের জোরে’। প্রচন্ড আক্রোশে ভিন্নমত দমনের প্রচেষ্টায় বিরোধী দলকে রাস্তায় নামতে না দিয়ে এক প্রকার ‘কারফিউ’ ব্যবস্থা চালু রেখেছে তারা।

পাঠক, যাদের বয়স ৭০ বা কাছাকাছি, তারা স্মরণ করতে পারবেন-১৯৭৩ সালের মার্চের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা। সবাই জানত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ সহজেই দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়ে যাবে, সেটা শতভাগ নিশ্চিত আর বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি আসন লাভ করবে। এটি ছিল রাজনৈতিক মাঠের প্রকৃত চিত্র। কিন্তু আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসন নিজেরা নিয়ে মাত্র সাতটি আসন ছেড়েছিল বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দলের সৎ ও দক্ষ নেতা তাজউদ্দীন আহমদকে দল থেকে সরিয়ে দিয়েছে, সবচেয়ে সফল অর্থমন্ত্রীকে পদ থেকে বের করে দিয়েছে। পেছনে ষড়যন্ত্র ছিল দুই ব্যক্তির সেটাও ‘ওপেন সিক্রেট’। একজন খন্দকার মোশতাক আহমেদ (পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবার হত্যাকান্ডের জন্য ‘প্রধান দায়ী’ বলে অভিযোগ), আরেকজন প্রভাবশালী এক যুবনেতার। মোশতাক ছিলেন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট জাতীয় রাজনীতিক সেটা সবারই জানা। আর তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সাচ্চা বাঙালি জাতীয়তাবাদী (খানিকটা সমাজতন্ত্রবাদী রাজনীতির অনুসারী) অপরিসীম ত্যাগী নেতা। প্রভাবশালী ওই যুবনেতা সোভিয়েত সমর্থন জোগাড় করে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষে উঠতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণদের একজন। মুক্তিযুদ্ধকালে খন্দকার মোশতাক আহমেদ তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল। একই সময় ওই যুবনেতার ভূমিকাও ছিল বিভীষণের মতো। স্বাধীনতার পর অনেক অপকর্মের তিনি ছিলেন হোতা। অনেক অপকর্ম সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আইনের ঊর্ধ্বে। বেদনাদায়ক বিষয় হলো-বাংলাদেশ বিমান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেনকে দিনেদুপুরে আবদুল গনি রোডে ওই যুবনেতার ‘নিবেদিতপ্রাণ’ কর্মীরা গুলি করে খুন করেছিল এটা জানাজানির পরেও কোনো বিচার হয়নি। একদলীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বহুল আলোচিত ওই যুবনেতার বিশাল অবদান ছিল বলে জানা যায়। যে কারণে তাজউদ্দীন আহমদকে বাকশাল বা সরকারে যোগদানের জন্য একবারও প্রস্তাব যায়নি বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে। কারণটা সবারই জানা- প্রভাবশালী ওই যুবনেতা সেটা হতে দেননি।

আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল। গর্ব করার মতো রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অধিকারীও তারা। কিন্তু এ দলটি জ্ঞাতসারে হোক কিংবা বিভ্রান্তে পড়ে হোক এখন দেশ থেকে রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠাতে চাচ্ছে। দেশবাসীর রাজনীতি করার অধিকার তারা কেড়ে নিচ্ছে এমন অভিযোগও প্রবল। আওয়ামী লীগের বন্ধুরা কথায় কথায় মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বলেন। কিন্তু তাদের আমলে একমাত্র মৌলবাদীরা তৎপরতা চালাতে পারছে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির কণ্ঠরোধ করতে ক্ষমতাসীনরা এমনই বদ্ধপরিকর যে তাদের মামলা ও হামলার শিকার করা হচ্ছে। ফলে মাঠপর্যায়ে তাদের তৎপরতা অনেক ক্ষেত্রে আটকে রাখা গেলেও মৌলবাদী দলগুলো ঠিকই তৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের দিক থেকে অপ্রত্যাশিত বিপদ এড়াতে চাইলে বিএনপির মতো নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক দলগুলোকে তৎপরতা চালানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা বিরোধী দলের মধ্যে তাদের বিপদ খুঁজত। এ বিপদ খুঁজতে গিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্কের এমন অবনতিই হয় যে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক নিঃশেষ হয়ে যায়। অথচ সংসদীয় বা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সরকার ও বিরোধী দল হলো মুদ্রার দুই পিঠ। যাদের একটিকে ছাড়া অন্যটির অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ।

আওয়ামী বন্ধুরা বিরোধী দলের মধ্যে বিপদ খুঁজলেও ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকান্ডে কোনো বিরোধী দলের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ঘরের শত্রু বিভীষণরাই বঙ্গবন্ধু এমনকি তার পরিবারের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। বিরোধী দলের ভূমিকা ওয়াচডগের মতো। শক্তিশালী বিরোধী দল সরকারি দলকে পরিচ্ছন্নভাবে দেশ চালাতে উদ্বুদ্ধ করে। সরকারের ভুলত্রুটি তারা ধরিয়ে দেয় এবং সংশোধিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। যে কারণে দেশে যাতে সত্যিকারের বিরোধী দল কাজ চালাতে পারে সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। চালবাজি বন্ধ রেখে নিজেদের জনপ্রিয়তার ওপরে নির্ভর করে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সুষ্ঠু নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়ে সৎ সাহস দেখাতে (এ ব্যাপারে আইন নতুনভাবে পাস করতে সময় লাগবে না, লাগবে শুধু একজন নেতার ইচ্ছাশক্তি-তিনিই এখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী)।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর