বুধবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

স্মার্টফোনে আসক্তি

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

স্মার্টফোনে আসক্তি

শিশু-কিশোরদের মধ্যে বেড়েছে মোবাইল আশক্তি। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় শিশু-কিশোররা ব্যস্ত থাকে ইন্টারনেট ভিত্তিক গেমস ও নানা ভিডিও দেখা নিয়ে। এ ছাড়া গ্রাম পর্যায়ের শিশু-কিশোরদের মধ্যে টিকটক আর লাইকি নিয়ে উন্মাদনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বখাটেপনা ও নানান অনৈতিক কাজও করে বেড়াচ্ছে উঠতি বয়সী কিশোররা। সংঘটিত হচ্ছে কিশোর অপরাধ। বর্তমান সময়ে মাল্টিমিডিয়া মোবাইল সেট অর্থাৎ অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখা যায় শিশু-কিশোরদের। প্রাথমিকের গন্ডি পার না হওয়া একশ্রেণির শিশু থেকে শুরু করে উঠতি বয়সীদের হাতে হাতে এখন অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় ইন্টারনেটভিত্তিক নানা গেমস নিয়ে মেতে থাকে কিশোরের দল। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট হাতের মুঠোয় থাকায় সহজেই পর্নো ভিডিওসহ অশ্লীল ও অনৈতিক ভিডিও দেখার সুযোগ অনায়াসেই পেয়ে যাচ্ছে অপরিণত বয়সীরা। আর এসব শিশু-কিশোরই একটু বড় হলে জড়িয়ে যাচ্ছে নানা অপকর্মে। দলবেঁধে আড্ডা দেওয়া, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে তারা। পরিবারে অসচেতনতার কারণেই কিশোররা বখাটে হয়ে যাচ্ছে। অপরিণত বয়সে মোবাইল ফোন ব্যবহারে বাধা না দেওয়ায় দিন দিন মোবাইল ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। লেখাপড়া থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর বাজারে, রাস্তার মোড়ে আড্ডা দেওয়া এবং গ্রাম-পাড়া-মহল্লায় তৈরি হচ্ছে তাদের একাধিক গ্রুপ। বড়দের সঙ্গে বেয়াদবি, শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করতেও দ্বিধা করে না উঠতি বয়সীদের একটা শ্রেণি। আধিপত্য নিয়েও পরস্পরকে বিরোধে জড়াতে দেখা যায়। মোবাইল ফোনের অপপ্রয়োগে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে এমনকি কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বখাটেপনায় জড়াচ্ছে। মোবাইলে গেম খেলতে গিয়ে তারা সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের কিছু ভাষা মনের অজান্তে মস্তিষ্কে ধারণ করে  বাস্তবে প্রয়োগ করছে। এভাবেই ধীরে ধীরে বখাটেপনা ও অপরাধ জগতে প্রবেশ করছে। মোবাইল আসক্ত উঠতি বয়সীরা আসক্তির চরম পর্যায়ে মোবাইলের এমবি/ টাকা জোগাতে পরিবার ও নিকটজনদের থেকে টাকা বা মূল্যবান জিনিস চুরি করতেও পিছপা হচ্ছে না।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার দমবন্ধ পরিবেশে গত দেড় বছরে দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। এ সময়ে ৭০ শতাংশ শিশুই শারীরিক কোনো কাজ বা খেলাধুলার সুযোগ পায়নি। এতে বেড়েছে মানসিক নানা রোগ। গবেষণায় উঠে আসে ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থীই মোবাইলে আসক্ত। এ ছাড়া দিনের অধিকাংশ সময় ৯ ভাগ শিক্ষার্থী কম্পিউটার স্ক্রিনে আর ৮ ভাগ শিক্ষার্থী ট্যাবে সময় ব্যয় করে।

এ আসক্তির মধ্যে মাত্র ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী তা ব্যবহার করেছে অনলাইন ক্লাসের জন্য। আর ৪০ ভাগ কার্টুন, নাটক ও চলচ্চিত্র দেখে, ২৭ ভাগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার এবং ১৭ ভাগ আসক্ত বিভিন্ন গেমসে। গেল বছর ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীই খেলাধুলার অবকাশ পায়নি। এর মধ্যে ৫০ শতাংশই বের হতে পারেনি বাইরে। স্বাস্থ্যগত ভয়াবহ ক্ষতির দিকটিও উঠে আসে এ গবেষণায়। তাতে দেখা যায় আগে যেখানে জ্বর-সর্দি, ডায়রিয়ার মতো রোগব্যাধিতে বেশি আক্রান্ত হতো শিক্ষার্থীরা, গত দেড় বছরে মাথাব্যথা, দৃষ্টিশক্তি জটিলতা, ঘুমের সমস্যা, বিষণ্ণতা ও খিটখিটে মেজাজের মতো ব্যাধি দেখা যাচ্ছে বেশি।

দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ তরুণ তাদের স্মার্টফোনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে এটি আসক্তির মতো হয়ে গেছে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের এক গবেষণায় সম্প্রতি এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এ আসক্তিমূলক

আচরণের অর্থ তারা যদি মোবাইল ফোন সব সময়ের জন্য হাতে না পায় তাহলে তারা ‘আতঙ্কিত’ বা ‘বিচলিত’ হয়ে পড়ে। এ তরুণরা মোবাইল ফোনের পেছনে যে পরিমাণ সময় ব্যয় করে তারা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এ ধরনের আসক্তিমূলক আচরণ অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে, যেমন স্ট্রেস বা শারীরিক ও মানসিক চাপ, হতাশা, খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের অভাব এবং স্কুলের ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়া।

শিশু ও তরুণদের মধ্যে স্মার্টফোনের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে এবং শিশুরা ফোনে কতটা সময় ব্যয় করছে অভিভাবকদের তা নিয়ে সচেতন হওয়া উচিত। স্মার্টফোনের প্রভাব সব সময় একমুখী হয় না। ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার যেমন মানুষের মেজাজে প্রভাব ফেলতে পারে, তেমনি মানুষের মন-মেজাজ স্মার্টফোন ব্যবহারের পরিমাণকে প্রভাবিত করতে পারে। স্মার্টফোনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি, সেই সঙ্গে শারীরিক কর্মকান্ডের সুযোগ না পাওয়া- এ দুই মিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ সমস্যাটি যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই তা আশঙ্কার একটি কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর