বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

লর্ড হো হো-কেও যিনি হার মানালেন

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

লর্ড হো হো-কেও যিনি হার মানালেন

নাৎসি নেতা গোয়েবলসের কথা জানেন না এমন পড়ালেখা করা লোকের সংখ্যা নিশ্চয়ই বিরল। কিন্তু লর্ড হো হোর কথা এ দেশের খুব কম লোকই জানেন। গোয়েবলস এবং উইলিয়াম ব্রুক জয়েস, যাকে উপহাস করে লর্ড হো হো নামে ডাকা হতো, তারা একই কাজে লিপ্ত ছিল, যথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানির বার্লিন বেতার থেকে হিটলার তথা নাৎসিবাদের পক্ষে প্রচারণার। তবে জার্মান নাগরিক গোয়েবলস এবং লর্ড হো হোর মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে গোয়েবলস মনে করতেন একটি মিথ্যাকে একশতবার উচ্চারণ করা হলে মানুষ অবশেষে তা সত্য বলেই ধরে নেয়, অন্যদিকে আমেরিকায় জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ নাগরিক উইলিয়াম জয়েস বা লর্ড হো হো বিশ্বাস করতেন কেতাদুরস্ত ভাষায় সম্মোহনী শক্তি ব্যবহার করে বলতে পারলে মিথ্যা কথাকেও সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করা যায়। অসওয়াল্ড মসলে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ ফ্যাসিস্ট দলের শীর্ষ এই নেতা অত্যন্ত চোস্ত, কেতাদুরস্ত ইংরেজি বলে বার্লিন বেতারে অনর্গল মিথ্যা, উদ্ভট প্রচারণা দ্বারা নাৎসিবাদকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করতেন। প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ সাহেব সম্ভবত লর্ড হো হোর অনুসরণেই চোস্ত বাংলায় মিথ্যা প্রচার করতেন। তবে ইদানীং যিনি লর্ড হো হোকেও হার মানালেন তার নাম মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির মহাসচিব। সম্প্রতি এক উদ্ভট, দৃশ্যত অবান্তর কথা বলে তিনি জনগণের হাসির খোরাক জুগিয়েছেন। তিনি বলেছেন তার নেতা খালেদা জিয়া নাকি প্রথম মহিলা মুক্তিযোদ্ধা। এমন এক উদ্ভট, যাকে পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছু বলা যায় না, সে কথা বলে একটি সর্বজনবিদিত মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে তিনি বাঙালি লর্ড হো হোতে পরিণত হয়েছেন। তার এই অবান্তর দাবিটি এতই হাস্যকর যে, এর অর্থ অনেকটা মীরজাফরকে দেশপ্রেমিক বলা। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট এবং ব্যতিক্রমধর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম যথার্থই লিখেছেন (২৮ ডিসেম্বর, ২০২১ বাংলাদেশ প্রতিদিন) ‘খালেদা জিয়া যদি মুক্তিযোদ্ধা হন তাহলে আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি অথবা রাও ফরমান আলি কিংবা মেজর জেনারেল জামসেদ বলবেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা।’ বাঘা সিদ্দিকী আরও লিখেছেন, ‘তাই আর যা কিছুই হোক দু-চার জন মেয়েকে পুরুষ, কিছু পুরুষকে মহিলা বানানো যেতে পারে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকার কোনোটাই বানানো যাবে না। কোন চিন্তা থেকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর খালেদা জিয়াকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টা হচ্ছে তা যারা বানানোর চেষ্টা করছেন তারাই জানেন, অন্য কারও জানার কথা নয়। ২০১৪ সালে লাগাতার হরতাল, অবরোধ দিয়ে বিএনপি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিরোধী রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, খালেদা জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টা তাঁকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। খালেদা জিয়াকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বানানোর এ অপকৌশল কেন- আমরা বুঝতে পারি না বা পারছি না।’

বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা অন্ধ আবেগে ভারাক্রান্ত নন এমন সবাই জানেন যে খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাসই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর, বিশেষ করে সে সময়ের কর্নেল জানজুয়ার অতিথি হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কাটিয়েছিলেন। তাকে তার স্বামী নিজের কাছে নেওয়ার জন্য তিন দফা চেষ্টা করলেও খালেদা স্বামীর ডাকে সায় না দিয়ে কর্নেল জানজুয়ার অতিথি হিসেবে বসবাসের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। এ ব্যাপারে বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন আহমেদের দেওয়া তথ্যটি ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, একসময় জিয়াউর রহমান কয়েক যুবককে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন খালেদা জিয়াকে কলকাতা নেওয়ার জন্য। যুবকত্রয় বহু খোঁজাখুঁজির পর খালেদা জিয়াকে পেলেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সাঁতার কাটার জায়গায়। তারা খালেদা জিয়াকে তার স্বামীর দাবির কথা জানালে খালেদা জিয়া তাদের ধমক দিয়ে বললেন, যুবকত্রয় একথা আবার বললে তিনি তাদের পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেবেন। এতে যুবকত্রয় ভয় পেয়ে চলে যান। খালেদা জিয়া কর্নেল জানজুয়া প্রদত্ত আতিথেয়তার কথা ভুলে যাননি। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে জানজুয়া, যখন সে মেজর জেনারেল পদে ছিল, যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল, মৃত্যু হলে খালেদা জিয়া প্রটোকলের সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করে জেনারেল জানজুয়ার মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠিয়ে এমনকি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকেও অবাক করেছিলেন। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান ভ্রমণকালে খালেদা জিয়া জেনারেল জানজুয়ার কবরও জিয়ারত করেছিলেন।

লর্ড হো হোর শেষ পরিণতি ভালো হয়নি। যুদ্ধ সমাপ্তির পর তার ফাঁসি হয়েছিল ব্রিটিশ আদালতের রায়ে। আদালতে তিনি বলেছিলেন, তিনি মার্কিন নাগরিক, ব্রিটিশ নন, তাই তাকে যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা যায় না।

কথায় বলে না রতনে রতন চেনে। যে মহিলা মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বিশেষ অতিথি হিসেবে ঢাকা সেনানিবাসে ভিআইপি মর্যাদায় কাটিয়েছেন, তাকে মুক্তিযোদ্ধা সে-ই বলতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পরিবারের সন্তান হিসেবে যার খ্যাতি সুপরিচিত। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান ২০০৮ সালে ‘ট্রুথ কমিশন ফর জেনোসাইড’ নাম দিয়ে সারা দেশের কয়েক হাজার রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে যা লিপিবদ্ধ করেছিলেন, বস্তুনিষ্ঠতার জন্য সেটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। উইকিপিডিয়াতে দেওয়া তথ্যমতে, এ তালিকা সরকারি অনুমোদনও পেয়েছিল। তালিকায় দিনাজপুর জেলায় যেসব রাজাকারের নাম রয়েছে তার প্রথমটিই হলো মির্জা রুহুল আমিনের, যিনি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পিতা বটে। তবে স্থানীয়ভাবে তাকে চোখা মিঞা রাজাকার হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। চোখা মিঞা ছিল তার ডাক নাম। মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেশে ঢুকে পড়ে এই চোখা মিঞা তখন প্রাণের ভয়ে তার পুত্র মির্জা ফখরুলকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আত্মীয়ের কাছে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিল। তার পুরো পরিবারটিই ছিল মুসলিম লীগপন্থি যারা দ্বি-জাতিতত্ত্বকে দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করার কারণে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টির বাস্তবতা মানতে পারেনি। পিতাসহ তার পূর্বপুরুষদের ইচ্ছা ব্যর্থ হলেও বর্তমান প্রজন্মে ফখরুল সাহেবের মন থেকে পাকিস্তান প্রেম মুছে যায়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ায় মর্মাহত হয়েছিল, যথা মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, উগ্র চীনপন্থি তারা সবাই জিয়াউর রহমানকে ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়ে তার ছত্রচ্ছায়ায় একত্রিত হয়েছিল দেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে। এর মধ্যে মির্জা ফখরুলের পরিবার ছিল অন্যতম। সে কারণেই তারা সেই জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলতে মুখে ফেনা তোলেন, যে জিয়া ক্ষমতা জবরদখলের পর পরই মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা স্লোগান দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে পাকিস্তানি জিন্দাবাদ শব্দ আমদানি করেছিলেন, শাহ আজিজের মতো কুখ্যাত রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী পদ দিয়েছিলেন, যাদু মিয়া, কর্নেল মোস্তাফিজ, সোলেমান, বিচারপতি সাত্তার, আবদুর রহমান বিশ্বাসসহ বেশ কয়েকজন কুখ্যাত রাজাকারকে তার মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে, রাজাকার শর্ষিনার পীরকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে, গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্ব প্রদানের সুযোগ করে দিয়ে, দেশে ধর্মীয় রাজনীতির পথ খুলে দিয়ে, জামায়াত নেতা, সাকা পরিবারসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অন্যদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করে এবং সম্পদের পর্বত তৈরি করতে সাহায্য করে এবং সবশেষে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল ভূমিকা রেখে, জেলহত্যার কারিগরের ভূমিকায় থেকে, ’৭৭-এর অক্টোবরে বিচারের প্রহসনের নামে শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দিয়ে তাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দেওয়া এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম এবং বৈশিষ্ট্য শেষ করে দিয়ে ইন্দিরা মঞ্চ চুরমার করে দিয়ে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে প্রমাণ করেছিল, পাকিস্তানে বেড়ে ওঠা, যার পিতামাতার কবরও পাকিস্তানে, সে ব্যক্তি আসলেই পাকিস্তানের বিভক্তি মেনে নিতে পারেনি এবং ’৭৫ সালে ক্ষমতা জবরদখলে নেওয়ার পর তার সুপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছিল। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত করে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার পরিকল্পনাও হয়তো তার ছিল, কিন্তু অতটা যেতে সাহস পায়নি। জিয়ার মৃত্যুর পর এখন মির্জা ফখরুলসহ অন্যরা সেই খালেদা জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টায় রত যে মহিলা মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা, তথা বাংলাদেশে গণহত্যার নায়কদের অতিথি হিসেবে বসবাস করে, তাদের মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন দিয়ে নিজেও বিতর্কিত ভূমিকায়ই ছিলেন। খালেদা জিয়াকে যে লোক মুক্তিযোদ্ধা বলতে পারে সে যদি কোনো দিন তার রাজাকার পিতা চোখা মিঞাকেও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে কেতারদুরস্ত ব্যক্তি লর্ড হো হো কিন্তু শেষ অবধি সফল হয়নি। মুক্তিযুদ্ধকালে খালেদা জিয়া কোথায় ছিলেন, কাদের অতিথি ছিলেন, কী করেছেন তা বাংলাদেশের কারও অজানা নয়। সুতরাং ফখরুল সাহেবের এ অপচেষ্টা তাকেই উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছে, বাঘা সিদ্দিকীর লেখায় যার ইঙ্গিত রয়েছে। লর্ড হো হোর সঙ্গে ফখরুল সাহেবের পার্থক্য এই যে, লর্ড হো হো মিথ্যার সাগরে গা ভাসিয়ে দিলেও এমন কিছু বলতেন না যা উন্মাদের পর্যায়ে পড়ে। যেহেতু ফখরুল সাহেব এ ধরনের অবান্তর, উদ্ভট কথা আগেও বলেছেন তাই তার সর্বশেষ উক্তিকে অনেকেই ফখরুল সাহেবের স্বভাবজাত প্রয়াস বলেই ধরে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে ইতিহাস বিকৃতির যে প্রবাহ বিএনপি-জামায়াত নেতৃবৃন্দ চালিয়ে যাচ্ছে ফখরুল সাহেবের শেষ বক্তব্য নিশ্চয়ই তারই অংশ। তার পরও বলতে হয় ফখরুল সাহেবের এহেন উদ্ভট এবং ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনো ক্ষমার চোখে দেখবে না, বরং পাগলের প্রলাপ হিসেবেই বিবেচনা করবে। তাই সাধু সাবধান!

 

                লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর