রবিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

আবাসন প্লটেই বছরের খাদ্য ও পুষ্টি সমাধান

শাইখ সিরাজ

আবাসন প্লটেই বছরের খাদ্য ও পুষ্টি সমাধান

করোনা ক্রান্তি সময়ে আরও একটি বছর শেষ হলো। শুরু হলো নতুন বছর। সূচনাতেই সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাই। নতুন বছর হোক জরামুক্তির, সুস্থতার ও সমৃদ্ধির। সার্বিক বিবেচনায় বিগত বছরটি তার আগের বছরের চেয়ে ভালো কেটেছে। করোনার টিকা এবং ওষুধ আবিষ্কার জনমানুষের মনে স্বস্তি এনেছে। পৃথিবীতে অনেকটা স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। যদিও করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট আতঙ্কিত করে তুলছে আমাদের। তবে করোনা আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। এ সময়ে নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে অনেকে এগিয়ে এসেছেন, নিয়েছেন অনন্য সব উদ্যোগ। বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্যোগী হয়েছেন অনেকেই। পাঠক! এমন একটি উদ্যোগের কথাই আপনাদের জানতে চাই।

সপ্তাহ দুই আগে সাভারের বিরুলিয়ায় গিয়েছিলাম। ঢাকার আশপাশের এ এলাকাগুলোয় বহু আবাসন প্রকল্পের কর্মকান্ড চলছে। একসময়ের কৃষিজমিতে দেয়াল তুলে বাড়ি তৈরির প্লট করে খালি ফেলে রাখা হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন ব"ক্ষপ্রেমী কিংবা কৃষিপ্রেমী তাদের প্লটটিতে দু-একটি ফলের চারা রোপণ করেছেন অথবা একটি মাচায় তুলে দিয়েছেন লাউয়ের ডগা। এ সংখ্যাটা শতকরা ১ ভাগও নয়। অথচ এ জমিটাতে কয়েক বছর আগেই হয়তো কৃষিকাজ হতো। এখন খালি পড়ে আছে। ৫-১০ বছর পর হয়তো সেখানে বসতি হবে, বাড়ি তৈরি হবে। যা হোক, বিরুলিয়ায় একটি আবাসিক প্লটে গিয়ে দেখতে পেলাম ভিন্ন রকম আয়োজন। ১০ শতাংশের সেই প্লটে ছোট্ট একটি বাড়ি। মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাঠ-টিনের দোতলা বাড়ি। বাড়িটি ঘিরে চারদিকে কৃষি আয়োজন। আয়োজনগুলো সবই মাটিতে নয়। কোনোটি মাটিতে। কোনোটি বিশেষ কাঠামোর ভিতরে ঊর্ধ্বমুখী ফসল বিন্যাস। এটি মূলত একটি কৃষি মডেল। ছোট্ট একটি জায়গায় বৈচিত্র্যময় কৃষি আয়োজন। এ কাজটি কোনো শৌখিনতা থেকে নয়। বরং একটি চার সদস্যের পরিবারের প্রতিদিনের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদার চুলচেরা হিসাব করেই এভাবে কৃষিকাজের ব্যবস্থা করেছেন মিজানুর রহমান বিজয়। তার দাবি ১০ শতাংশের একটি প্লট থেকে চার সদস্যের একটি পরিবারের সারা বছরের পুষ্টি চাহিদার জোগান দেওয়া সম্ভব। এ সময়ের একজন কর্মজীবী ও উচ্চাকাক্সক্ষী তরুণ হিসেবে তার এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সুদীর্ঘ এক স্বপ্ন। রয়েছে আমাদের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে নাগরিক জীবনকে আরও যুক্ত করার গভীর প্রয়াস। সময় যত যান্ত্রিক হয়ে উঠছে আমাদের স্বপ্ন তত ছোট হয়ে যাচ্ছে। জীবন-জীবিকার সঙ্গে সঙ্গে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই আমাদের অনিবার্য এক প্রত্যাশা। যেভাবেই হোক একখন্ড জমিকে নিজের অধিকারভুক্ত করার প্রতিযোগিতা চলছে এখন দেশব্যাপী। জমি ও আবাসনের বহু প্রকল্প দেশে। রাজধানী ঢাকা পূর্ণ হওয়ার পর এখন ঢাকার আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। অবশ্য, প্লট বাণিজ্য ঢাকার আশপাশ থেকে বিভাগীয় শহর হয়ে এখন জেলা ও উপজেলা শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে। একটি পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার আশপাশে বাণিজ্যিক ও পতিত প্লটের সংখ্যা ৭ লাখের মতো। আরেক হিসাবে দেখা যায়, সারা দেশে এমন বিক্রীত বাণিজ্যিক আবাসিক প্লটের সংখ্যা আরও ১০ লাখের ওপর। যেগুলো বিক্রির আগমুহূর্তেও কৃষিজমি ছিল। এখন ছোট খন্ডের প্রাচীরে ঘেরা অকৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে।

আমি কিছুদিন আগে টেলিভিশনে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেছিলাম ঢাকার পূর্বাচল থেকে। একসময়ের কৃষিসমৃদ্ধ গ্রাম থেকে এখন মহানগরীর নতুন বাস্তবতার মধ্যে এসে গেছে হাজার হাজার বিঘা জমি। সেখানে একের পর এক অট্টালিকা উঠছে। ফসলি অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আমরা যারা প্লট কিনছি তারা একমাত্র ভবন নির্মাণ ছাড়া সেই একখন্ড জমিটির আর কোনো মূল্যায়নই করতে পারছি না। কোনো ব্যবহারও হচ্ছে না। ঠিক এ জায়গাতেই এক সমন্বিত কৃষি মডেল নিয়ে এসেছেন মিজানুর রহমান বিজয়। মাত্র ১০ শতাংশের চৌহদ্দির ভিতরে তিনি শুধু ধান, সবজি ও ফল-ফসলই রাখেননি। সেখানে ব্যবস্থা রেখেছেন মাছ চাষেরও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে পড়েছেন বিজয়। এ যুগের বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বেশ ধারণা তার। নিজের রয়েছে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। সেখান থেকে এমন একটি স্বপ্নের যাত্রা। এখানে বিপুল সম্ভাবনা দেখছেন বিজয়। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো কৃষির অনেক হালনাগাদ অনুশীলন ও প্রযুক্তি সম্পর্কে তার বেশ চুলচেরা ধারণা। আজকের নতুন প্রজন্ম লেখাপড়া শেষ করে নতুন ব্যবসায় হাতেখড়িকে ‘স্টার্টআপ’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এ উদ্যোগকে স্টার্টআপ হিসেবে নিয়েছেন মিজানুর রহমান বিজয়। ছোট বাড়িটির বাইরে সম্পূর্ণ জমিতেই তিনি গড়েছেন সমন্বিত এক কৃষি খামার। জমির বাউন্ডারির চার দেয়াল ঘেঁষে লাগিয়েছেন ড্রাগন ফল। যাতে দেয়াল আঁকড়ে ধরে ড্রাগন গাছ বেড়ে উঠতে পারে। পরের স্তরেই রয়েছে পেঁপে গাছ। এরপর ত্বিন, আমসহ অন্যান্য ফলের গাছ লাগিয়েছেন। অ্যাকোয়াপনিক পদ্ধতিতে চাষ করছেন লেটুস, ক্যাপসিকাম, চাইনিজ ক্যাবেজ, সুগন্ধি কালো ধান থেকে শুরু করে দেশি শিং, মাগুর, তেলাপিয়া মাছের উৎপাদন; এমনকি বিভিন্ন মসলাজাতীয় ফসলও।

বিজয় বলছিলেন, অ্যাকোয়াপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় এটি ৯০ শতাংশ পানিসাশ্রয়ী এবং আবহাওয়া ও জলবায়ুর অভিঘাত নিয়ন্ত্রণ উপযোগী। ১ বিঘা জমি থেকে ২৫ বিঘা জমির সমপরিমাণ ফসল উৎপাদন সম্ভব। এ পদ্ধতিতে তিনবার ধান, তিনবার মাছ ও বারোবার সবজি পাওয়া সম্ভব।

বিজয় মূলত ঊর্ধ্বমুখী কৃষি সম্প্রসারণের চার রকমের প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি নিয়ে এখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা, কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজার এমনকি রপ্তানি বাণিজ্যের কথাও ভেবেছেন। সব মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে তার এ আয়োজনটি কৃষির স্বপ্ন রচনায় অসাধারণ এক রসদ জোগাতে পারে।

আগেই বলেছি, সারা দেশে এখন পতিত আবাসিক প্লট রয়েছে প্রায় ১৭ লাখ। আনুমানিক এই ১৭ লাখ প্লটের আয়তন কমপক্ষে ৫ লাখ বিঘা জমি। এ ৫ লাখ বিঘা জমিতে এমন সমন্বিত আয়োজন করা গেলে আমাদের ধানে, মাছ, সবজি ও ফলফসল উৎপাদনে নতুন এক দৃষ্টান্ত গড়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা বিজয় যে হিসাব দেখাচ্ছেন তাতে দেখা যাচ্ছে, এ উৎপাদন মডেল সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে অতিরিক্ত ৫ লাখ মেট্রিক টন রপ্তানিযোগ্য চাল উৎপাদন সম্ভব। এ ছাড়া কমপক্ষে ৫ লাখ মেট্রিক টন মাছ ও ৫ লাখ মেট্রিক টন সবজি, ফল ও মসলা উৎপাদন সম্ভব। এই উদ্যোক্তা বলছেন ১ বিঘা জমিতে ৫০টি ধানের বেড, ৫০টি মাছের হাউস, ৫০টি সবজি বেড ও ১০টি ভার্টিক্যাল গ্রো বেড প্রস্তুত করতে সব মিলিয়ে ব্যয় হতে পারে ২০ লাখ টাকার মতো। তার হিসাবে এ বিনিয়োগ ৮ থেকে ১০ মাসের মধ্যে তুলে আনা সম্ভব।

প্রশ্ন হলো এ কৃষি আয়োজনে অংশ নিয়ে প্রতিটি কাজ দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করার বিষয়ে। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রশিক্ষণ ও সম্যক জ্ঞান। প্রয়োজন মাটি ও কৃষির প্রতি দায়বদ্ধতা। কৃষিবাণিজ্য ও নগরবাসীর মধ্যে সতেজ খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে এ ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়। তবে আমি মনে করি কোনো উদ্যোক্তা কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করার আগে অবশ্যই ঠিক ও সম্যক ধারণা নিয়েই মাঠে নামবেন। একই সঙ্গে সুস্থ ও সঠিক চারা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সচেতন হবেন। বর্তমান সময়ের এ উদ্যোগগুলোর মধ্য দিয়ে নতুন এক ধারায় বিকাশ লাভ করছে কৃষি। এর মধ্যে তাগিদ রয়েছে প্রতিটি মানুষের কৃষিমুখী হওয়ার। যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর