সোমবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু ফিরলেন- পূর্ণতা পেল স্বাধীনতা

মো. সাহাবুদ্দিন চুপপু

বঙ্গবন্ধু ফিরলেন- পূর্ণতা পেল স্বাধীনতা

‘এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশার অভিযাত্রা। আমি ৯ মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এই ৯ মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল; আমাকে যখন বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী।’

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২-এ মুক্ত হয়ে এভাবেই মর্মস্পর্শী কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ ২৯০ দিন কারাভোগের পর এদিন পাকিস্তানে কুখ্যাত মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে বন্দি বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন স্বাধীন-স্বদেশ, মুক্ত বাংলাদেশে। মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আনন্দাশ্রুতে মথিত হয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ, বাংলাদেশের আপামর বাঙালি। স্বাধীনতার ২৪ দিন পর দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। চূড়ান্ত বিজয়ের পর এদিন বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য প্রাণবন্ত অপেক্ষায় ছিল গোটা বাঙালি জাতি। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ তাকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। বিকাল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। এখানেই জনগণ নন্দিত শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ধ্রুপদি ভাষণ দেন। জনগণকে উজ্জীবিত করেন এভাবে, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সরকার। মূলত এরপর থেকেই বঙ্গবন্ধুর অবস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিভিন্ন লেখালেখি চলতে থাকে। বাংলাদেশেও তাঁর মুক্তির জন্য জোরালো দাবি ওঠে জনগণের পক্ষ থেকে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ২৩ ডিসেম্বর দেশে ফিরলে এ দাবি আরও সোচ্চার হয়। এমন পরিস্থিতিতে ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের দায়িত্ব গ্রহণ করে সাংবাদিকদের কাছে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। ২১ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস থেকে জানা যায়, তাঁকে (শেখ মুজিবুর রহমান) অজ্ঞাত স্থানে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। অবশ্য ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার জন্য ২৩ তারিখে তাঁকে পিন্ডি নেওয়া হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভুট্টোর ২৭ ও ২৯ ডিসেম্বর দুটি বৈঠকের কথা জানা যায়। এ আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ পত্রিকাগুলোতে না পাওয়া গেলেও বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার, ভুট্টোর জীবনীকার স্টেনলি উলপার্ট ও সাংবাদিক রবার্ট পেইনের লেখায় অনেক তথ্য জানা যায়। দুটি বৈঠকেই ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে যে কোনো মূল্যে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু কৌশলে দেশে ফিরে জনগণের সঙ্গে কথা না বলে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ভুট্টো পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে ‘কনফেডারেশন’র প্রস্তাব দেন। একই সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণের প্রস্তাবও দেন। উলপার্ট নিজেও স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে ব্ল্যাকমেল করার কাজে এ বৈঠকের আলোচ্যসূচিকে ব্যবহার করেছেন। ভুট্টোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে ৮ জানুয়ারি আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেখানেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠক করে পরদিন দেশের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। ফেরার পথে ভারতে যাত্রাবিরতি দিয়ে অবশেষে জানুয়ারির ১০ তারিখে দেশে পৌঁছেন বাঙালির মহানায়ক।

দুই. বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার এক দিন আগে ৯ জানুয়ারি ১৯৭২ (রবিবার), দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল- ‘তোমরা কি সবাই বেঁচে আছো?’

-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বিস্তারিত সংবাদে পত্রিকাটি লিখেছিল, “সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপারে লন্ডন হইতে গতকাল সন্ধ্যায় স্বীয় পরিবারবর্গের সহিত টেলিফোনে কথা বলার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমেই এই কথা কয়টি উচ্চারণ করেন। শেখ মুজিবের কনিষ্ঠতম পুত্র, সাত বছরের আবেগাপ্লুত ‘রাসেল’ তার বাবাকে প্রশ্ন করে, ‘আব্বা, ওরা কি তোমায় ছেড়ে দিয়েছে? তুমি কবে আসবে? ওরা কিন্তু আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে।’ টেলিফোনে কথা বলার সময় এক অবর্ণনীয় আনন্দাতিশয্যে পরিবারের সদস্যদের চোখ হইতে অশ্রুর মালা ঝরিয়া পড়িতেছিল।”

আর দেশে ফেরার পরদিন মঙ্গলবার পুরো ঘটনাকে ‘এক হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত’ হিসেবে উল্লেখ করে মর্নিং নিউজ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁর পরিবারের সদস্যদের ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ১৮ নম্বর সড়কের যে বাড়িটায় গৃহবন্দি করে রেখেছিল; সেখানের বর্ণনাতেই এভাবে উল্লেখ করে পত্রিকাটি। সময় তখন ৫টা ৩৫ মিনিট। বাড়ির বাইরে তখনো অগণিত মানুষের ভিড়। তারা তাদের নেতাকে ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ স্লোগানে সম্ভাষণ জানাচ্ছিল। উল্লসিত মানুষের ভিড় বাড়ির সবকটি প্রবেশপথ এমনভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিলিত হতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে আসতে হয়েছিল। শেখ মুজিব যখন ভিতরে ঢুকলেন, তখন বড় মেয়ে আজকের জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে বরণ করে নেন। সেটা এমন এক মুহূর্ত ছিল, যা বর্ণনা করার মতো ভাষা নেই। আবেগরুদ্ধ হাসিনার কাছেও কোনো ভাষা ছিল না। যে বাবার বুকে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তিনি নিজেই তখন কান্না সামলাতে যুদ্ধরত। সুখে আর নতুন করে পাওয়া এক নিশ্চয়তাবোধে দুজনেই কাঁদতে শুরু করলেন। যদিও হৃদয়স্পর্শী মুহূর্তটি তখনো বাকি। বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর আশি পেরোনো মায়ের সামনে এগিয়ে গেলেন। মাকে জড়িয়ে ধরে লৌহমানব হিসেবে পরিচিত শেখ মুজিব শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পুরো ঘরের দখল নিয়ে নিল নীরবতা। এই পুনর্মিলন দৃশ্যের সাক্ষীদের অনেকেই কিছুক্ষণের মধ্যে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন বিমানে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হয়েছিলেন ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। সেই সফর ছিল ১৩ ঘণ্টার। বিমানে তাঁরা পাশাপাশি আসনে বসলেন। সামনের টেবিলে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সুগন্ধময় এরিনমোর তামাক, আর সেই বিখ্যাত পাইপ। উৎফুল্ল মুজিবের তখন দেশে ফেরার তর সইছে না। শশাঙ্ক ব্যানার্জির লেখা আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ ‘এ লং জার্নি টুগেদার’ গ্রন্থে অন্তরঙ্গ সেই স্মৃতিচারণা করে শশাঙ্ক এভাবে লিখেছেন, ‘সে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত, চারদিকে মুক্তি আর মহানেতাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। আজও চোখে লেগে আছে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটি।’

যুদ্ধকালীন সময়ে দেশে না থাকলেও কতটা মনোবল ছিল বঙ্গবন্ধুর, তা দেশে ফেরার পর দেওয়া বক্তৃতা থেকেই বোঝা যায়। তিনি অকপটে বলেছিলেন, “আমি ঠিক করেছিলাম, আমিও তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা।”

তিন. ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার মাসখানেক পরেই (ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২) বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয়েছিল আমার। যদিও বঙ্গবন্ধুকে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল। ছয় দফার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারণায় এদিন পাবনা টাউন হলে আয়োজিত একটি জনসভায় যোগ দিতে এসেছিলেন তিনি। সেদিন বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ আদরের ডাক ‘তুই’ সম্বোধন করে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন আমাকে। যাই হোক, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিলাম জাতীয় নেতা হিসেবে, আর ১৯৭২ সালে পেলাম স্বাধীনতার স্থপতি ও বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে। বন্যাকবলিত মানুষকে বাঁচাতে পাবনায় ‘মুজিববাঁধ’ উদ্বোধন করতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমি তখন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। স্বভাবতই জনসভার স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব আমার ওপর পড়ল। বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন- ‘তুই তো ভালো বলিস’। বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপ্টে আছি; কী বলব কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম জাতির পিতার দিকে। পরে দু-একটি কথা বলে স্টেজের পাশে গেলাম। পরে এই ভেবে আনন্দিত হলাম যে, মাত্র ১৮ মিনিট বক্ততৃায় যিনি ৭ কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন; সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে ছোট ব্যাপার নয়।

বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে আমার কাছে জানতে চাইলেন- ঢাকা যাব কি-না? আগে-পাছে চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার ভ্রমণের সুযোগ হলো, তা-ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। ঢাকায় হেলিকপ্টার থামল পুরাতন বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন- ‘ওকে (আমাকে) বাসায় নিয়ে খেতে দাও, তারপর খরচ দিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দিও।’ ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনা আসেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হলো। বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিক পূর্বের ন্যায় আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, আমি যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করি।

আজ ভাবী, ১০ জানুয়ারি যদি বঙ্গবন্ধু প্রত্যাবর্তন না করতেন, তবে কী অবস্থা দাঁড়াত? এর সদুত্তর হয়তো আমাদের কারও কাছেই নেই। কথাটির স্বরূপ এবিএম মূসা তার ‘মুজিব ভাই’ বইয়ে দুভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এক. বঙ্গবন্ধু যদি ফিরে না আসতেন। দুই. বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বলে অনেক কিছুই সম্ভব হয়েছে, আবার অনেক ঘটনা ঘটতে পারেনি। প্রথম বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্ত আলোচনা হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, লিখেছেন এবং বিশ্বাসও করেন যে বঙ্গবন্ধু ফিরে না এলে প্রথমত বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এত তাড়াতাড়ি যেত না। অবস্থাদৃষ্টে কথিত ভারতীয় কর্তৃত্ববাদী মনোভাবকে মেনে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হতো। যদিও ইহা স্বীকৃত সত্য যে, তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার ও ভারতীয় জনগণের সক্রিয় সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি ঘটেছিল এবং বঙ্গবন্ধুও মুক্তি লাভ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলেই বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সোনার বাংলা গড়ার কাজে এগিয়ে গেছে জ্যামিতিক হারে। দীর্ঘ ২৪ বছরের শোষণ, বৈষম্যের অবসান হয়ে লাল সবুজের পতাকা পেয়েছে বাঙালি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ফিরে বাঙালি জাতির উদ্দেশ প্রাথমিকভাবে যে পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তার মধ্যে উন্নত জীবনব্যবস্থা ছিল সর্বাগ্রে। রেসকোর্সে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ না থেকেও যদি সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান মতো শুধু মানবসম্পদ সৃষ্টি করে উন্নত হতে পারে, তবে বাংলাদেশও এক দিন সবক্ষেত্রে উন্নত হবে। জাতির জনক মনে করতেন, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অর্থনৈতিক মুক্তি, সংকীর্ণতা থেকে আলোর পথে যাত্রা। আর এ কারণেই তিনি ‘বৈষম্যহীন উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠায় দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর সুযোগ্য জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে আজ উন্নতির শিখরে নিয়ে বিশ্বসভায় অনন্য সম্মান অর্জন করেছেন।

‘বঙ্গবন্ধু-স্বাধীনতা-বাংলাদেশ’ বাঙালির অভিধানে এ তিনটি শব্দই সমার্থক। বঙ্গবন্ধু মানেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলধারা। কোথায় নেই তিনি! ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পাতার পরতে পরতে রয়েছে এই নাম। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ- প্রতিটি অর্জনের সংগ্রাম-লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন তিনি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন যে কারণে সদ্য স্বাধীন বাঙালি জাতির কাছে বড় প্রেরণা ছিল; ঠিক একই কারণে এই প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের কাছে ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা হিসেবে’ আখ্যায়িত হবে যুগ যুগ ধরে। ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের মর্মার্থ এখানেই।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

সর্বশেষ খবর