বুধবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বিএনপির শত্রু বৃদ্ধি কর্মসূচি

মহিউদ্দিন খান মোহন

বিএনপির শত্রু বৃদ্ধি কর্মসূচি

২০১৬ সালের ১২ আগস্ট বিএনপির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে পদত্যাগের কয়েকদিন পর মনঃকষ্ট শেয়ার করতে গেলাম আমার এক মুরব্বির কাছে। তিনি উচ্চ পর্যায়ের সাবেক একজন আমলা। বিএনপি ঘরানার লোক হিসেবে পরিচিত। অনেক কথার পরে তিনি বললেন, ‘বুঝছ নাকি! বিএনপি হয়তো অনেক কাজই ঠিকমতো করতে পারে না। তবে একটি কাজ খুব ভালোভাবে করতে পারে। আমার মনে হয় ওই কাজটি বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো রাজনৈতিক দলই অত ভালোভাবে করতে পারে না।’ জিজ্ঞেস করলাম, কোন সে কাজ? বললেন, সেটা হলো ‘বন্ধুকে শত্রু বানানো’। সম্ভবত বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং দলটির কার্যকলাপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেই তিনি ওই সূত্রটি আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে এটা আমি অন্তত নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, তিনি বিএনপি সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়নই করেছিলেন। আমরা যদি দলটির কর্মকান্ড পর্যালোচনা করি তাহলে এটা প্রতিভাত হয়ে উঠবে যে নানা কারণে দলটি ক্রমাগত শত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, দলের বাইরে শুধু নয়, ভিতরেই বাড়ানো হচ্ছে শত্রু। দলের নিবেদিতপ্রাণ ও অভিজ্ঞ নেতাদের দূরে সরিয়ে দেওয়ার এক সর্বনাশা উন্মাদনা যেন দলটিকে পেয়ে বসেছে। অতিসম্প্রতি দলটির কতিপয় সিদ্ধান্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কাছে অশুভ বার্তা সরবরাহ করেছে। তারা বলছেন, দল পুনর্গঠনের নামে বিএনপি সম্ভবত ‘শত্রু বৃদ্ধি কর্মসূচি’ হাতে নিয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আমাকে বলেছেন, দেশব্যাপী সাংগঠনিক পুনর্গঠনের নামে দলটিকে আরও এলোমেলো করে ফেলা হচ্ছে। তারা এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে এভাবে চলতে থাকলে বিএনপিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে, যা দলটির অস্তিত্ব ধরে টান দিতে পারে।

নেতা-কর্মীদর এ অশঙ্কা অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ আছে মনে হয় না। অতিসম্প্রতি এমন কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। এদের মধ্যে বরিশালে বিএনপির স্তম্ভ হিসেবে খ্যাত মজিবর রহমান সরোয়ারকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে মহানগর বিএনপি সভাপতির পদ থেকে। একাধিকবার জাতীয় সংসদ সদস্য ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়ে তিনি শুধু বরিশাল মহানগর নয়, গোটা বরিশাল জেলায় দলকে শক্তিশালী করতে অসামান্য অবদান রেখেছেন। এর পরই ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য হারুন অর রশীদের। তাঁকে জেলা সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিএনপির ছাঁটাই প্রকল্পের শিকার হয়েছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশেনের সাবেক মেয়র ও মহানগরী বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। কয়েক দিন আগে একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো খুলনার কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে পরিচিত মহানগরী বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অসুস্থ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে দেখতে যাওয়ার ‘অপরাধে’ জেলা সভাপতির পদ হারিয়েছেন জি এম সিরাজ এমপি। যে কজন নেতার নাম এখানে উল্লেখ করা হলো তাঁরা সবাই দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এবং দলকে সংগঠিত করতে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। দল এবং নেত্রীর এ চরম দুঃসময়ে তাঁদের প্রতি এ নিষ্ঠুর আচরণ তাই সাধারণ নেতা-কর্মীরা মেনে নিতে পারছেন না। প্রায় সব জায়গাতেই অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, কোথাও কোথাও তা প্রকাশ্য প্রতিবাদের রূপ নিয়েছে।

যেহেতু অমি একসময় এ দলটির কর্মী ছিলাম, তাই এঁদের সবার সঙ্গেই আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। এঁরা সব সময় দলকে সুসংগঠিত করার জন্য চেষ্টা করেছেন, জেল-জুলুম হয়রানির শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে খুলনার নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে একজন অত্যন্ত কুশলী সংগঠক ও কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবেই দেখেছি। খুলনা বিএনপির অতীত পর্যালোচনা করলে সেখানে নেতৃত্বের যে শূন্যতা সৃষ্টির বিষয়টি চোখে পড়ে নজরুল ইসলাম মঞ্জু তা অনেকটাই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একসময় খুলনা বিএনপিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ রাজ্জাক আলী, আশরাফ হোসেন, কাজী সেকান্দর আলী ডালিম, নূরুল ইসলাম দাদু ভাই, সৈয়দ ঈসার মতো জাঁদরেল নেতারা। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিএনপি খুলনায় একটি সংহত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। আজ তাঁরা নেই। নেতৃত্বের এ শূন্যতা পূরণে মঞ্জু অনেকটাই সফল হয়ে উঠেছিলেন। তিনি খুলনা মহানগরী বিএনপি সভাপতির পাশাপাশি দলের কেন্দ্রীয় কমিটিরও খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ২৫ ডিসেম্বর তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সেই পদ থেকেও। একসময়ের ডাকসাইটে নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জু এখন কেবলই বিএনপির একজন প্রাথমিক সদস্য। জানা যায়, খুলনা মহানগরী বিএনপির কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন আহ্বায়ক কমিটি করার প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠা নেতা-কর্মীদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করায় মঞ্জুর গর্দান গেল ‘হাইকমান্ডের গিলোটিনে’। খুলনার বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আমাকে বলেছেন তাঁদের অসন্তোষের কথা। তাঁরা এও বলেছেন, মঞ্জুকে বাদ দিয়ে অনিন্দ্য ইসলাম অমিতকে খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক করাকে কেউই ভালোভাবে নেননি। মরহুম তরিকুল ইসলামের ছেলে অমিত ওই বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে আছেন। কিন্তু খুলনার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্ব তিনি সঠিকভাব পালন করতে পারবেন কি না এ নিয়ে তাঁরা সন্দিহান। তাঁদের মতে বর্তমানে খুলনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অবস্থান অত্যন্ত শক্ত। সেই শক্ত অবস্থানের বিপরীতে বিএনপিকে দাঁড় করানোর যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা দরকার অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের তা নেই।

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দলের সাংগঠনিক পুনর্গঠন ও তরুণ নেতৃত্ব সামনে আনার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এসব রদবদল করা হচ্ছে। আগামী দিনের ‘আন্দোলন-সংগ্রামে’ তরুণ নেতৃত্ব রাজপথ কাঁপাবে- এমন আশাবাদ তাদের। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে এভাবে যদি সিনিয়রদের সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয় তাহলে অচিরেই বিএনপিতে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতৃত্বের আকাল দেখা দিতে পারে। তাঁরা বলছেন, আন্দোলন-সংগ্রামে তরুণরা রাজপথে থাকবে এটা যেমন ঠিক, তেমনি রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির কেন্দ্রীয় একজন নেতা এই নিবন্ধকারকে বলেন, ‘ভাই! বিএনপিতে এখন কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। যেখানে আমাদের নেত্রীর মরণাপন্ন অবস্থা, তাঁর মুক্তি এবং সুচিকিৎসার জন্য তাঁকে দেশের বাইরে পাঠাতে সরকারকে বাধ্য করতে অন্দোলন জোরদার করার পরিকল্পনা দরকার, সেখানে হাইকমান্ড এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছে যা দলকে আরও শক্তিহীন করে দিচ্ছে।’ তিনি এও বলেন, ‘সবকিছুই করা হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নাম ব্যবহার করে। কিন্তু দলের এ সংকটময় সময়ে তিনি এমন অবিবেচকের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এটা আমার বিশ্বাস হতে চায় না।’

তবে ওই নেতার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে তেমন কিছু যায়-আসে বলে মনে হয় না। বিএনপিতে এখন চলছে ‘মাদারির খেল’। পত্রপত্রিকায় দলটি সম্পর্কে যেসব খবরাখবর মাঝেমধ্যেই পাওয়া যায় তাতে এটা স্পষ্ট যে বিএনপিতে এখন বলয়ের রাজনীতি চলছে। কেন্দ্রীয় নেতত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা সৃষ্টি করেছেন এসব বলয়। বরিশালে মজিবর রহমান সরোয়ার বিরোধী গ্রুপটি কেন্দ্রীয় একজন সাংগঠনিক সম্পাদকের নেতৃত্বে বলয় সৃষ্টি করে হাইকমান্ডকে ম্যানেজ করে তাঁদের আরাধ্য সম্পন্ন করেছেন বলে শোনা যায়। খুলনায় সাবেক দুজন কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতাকে লাইমলাইটে আনার জন্য দলের সুপ্রিম কমান্ড মঞ্জুকে অপমানজনকভাবে সরিয়ে দিয়েছেন। দলের সবাই জানেন যে ওই দুই সাবেক ছাত্রদল নেতার লন্ডন কানেকশন অত্যন্ত জোরালো। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঘটনার পেছনে রয়েছে দলের কেন্দ্রীয় দফতরের এক অত্যন্ত মহাপ্রতাপশালী নেতার কুশলী হাতের ছোঁয়া। একদা রাজশাহীতে ছাত্র রাজনীতি করা ওই নেতা নিজের জেলায় কোনো অবস্থান তৈরি করতে না পেরে রাজশাহীতে গদিনশিন হওয়ার জন্য কসরত করে চলেছেন, এমন এমন ধারণা নেতা-কর্মীদের। এভাবে দেশের প্রতিটি এলাকায় দলের নেতারা একে অন্যের বিরুদ্ধে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত। ফলে বিএনপি সবল হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন আরও দুর্বল হচ্ছে- এ অভিমত দলটির সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের।

বিএনপির সাধারণ নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা এই ভেবে বিস্মিত যে যেখানে সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য সবার অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন, সেখানে দলের হাইকমান্ড এমন সব অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যা দলের মধ্যে বিভাজনকে আরও উসকে দিচ্ছে। যদিও বিএনপির শীর্ষ নেতারা এসব পরিবর্তনকে দলের ‘চলমান সাংগঠনিক প্রক্রিয়া’ বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছেন, কিন্তু নেতা-কর্মীরা তা মানতে নারাজ। তাঁদের মতে দলকে সুসংগঠিত ও গতিশীল করার জন্য সাংগঠনিক পরিবর্তন বা পুনর্বিন্যাস হতেই পারে। তবে তা হতে হবে পুরনো নেতৃত্বকে অসন্তুষ্ট না করে। তাঁদের যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় বাদ দেওয়া হচ্ছে তা চরম অবমাননাকর ও অসম্মানজনক। বরং হাইকমান্ডের উচিত ছিল পুরনো নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁদের মতামত নিয়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা। তাহলে দলের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি হতো, অসন্তোষ জন্ম নিত না।

এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সাধারণ মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো বিএনপির সমর্থক। দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা এখনো দল ও তাদের নেত্রীর জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁদের কোনো আশার আলো দেখাতে পারছেন না। বরং ক্রমাগত হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে দলটিকে ঠেলে দিচ্ছেন আরও বিপর্যয়ের দিকে। বন্ধুর সংখ্যা বাড়ানোর প্রতি মনোযোগী না হয়ে তাঁরা এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছেন যা কেবল শত্রুর সংখ্যা বাড়াতেই অবদান রাখছে। এমন ধারা যদি চলতেই থাকে তাহলে একদা বিপুল জনসমর্থনপুষ্ট দল বিএনপির ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল মনে করছে।

                লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।  

সর্বশেষ খবর