বুধবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

তালাক প্রদানের আইনি প্রক্রিয়া

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

তালাক প্রদানের আইনি প্রক্রিয়া

তালাকের কয়টি নোটিস পাঠাতে হয়- একটি, দুটি না তিনটি তা নিয়ে আমাদের সমাজে বেশ ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। অনেকে বলেন তিন মাসে তিনটি নোটিস পাঠাতে হয়। প্রকৃতপক্ষে তালাকের একটি নোটিস একবারই পাঠাতে হয়। আর এ নোটিস কীভাবে পাঠাবেন, পাঠানোর নিয়মাবলি কী, যথাযথ নিয়ম মেনে না পাঠালে আইনে কী শাস্তির বিধান রয়েছে এসব বিষয়ে আইনি আলোচনা জানুন।

যে কোনো যুক্তিসংগত কারণে মুসলিম স্বামী বা স্ত্রী একে অন্যকে তালাক প্রদান করতে পারেন। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭(১) ধারা অনুযায়ী আপনি তালাক দিতে চাইলে তালাকের নোটিস নিজেই তৈরি করে কিংবা কারও মাধ্যমে তৈরি করিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাকে তালাক দিচ্ছেন, তিনি যদি ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় বসবাস করেন তাহলে সেই ইউপি চেয়ারম্যানকে ওই তালাকের নোটিস দিতে হবে। আর তিনি যদি পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাস করেন তাহলে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে লিখিত নোটিস পাঠাতে হবে। ওই একই নোটিসের একটি কপি যাকে তালাক দিচ্ছেন অর্থাৎ তালাকগ্রহীতাকে পাঠাতে হবে। আর মনে রাখবেন তালাকের নোটিসে দুজন উপযুক্ত সাক্ষীর কলাম রাখবেন এবং তাদের স্বাক্ষর নেবেন। অনেকেই মনে করেন তালাকের নোটিস কাজির মাধ্যমে না পাঠালে তা কার্যকর হয় না। এ ভুল ধারণা। তালাকের নোটিস স্বামী বা স্ত্রী যিনি তালাক দেবেন তিনি নিজে নিজেই কিংবা কারও মাধ্যমে লিখিত আকারে পাঠিয়ে দিলেই হবে।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে তালাকের নোটিস পাঠাতে কাজির কাছে যেতে হবে এমন কোনো কথা লেখা নেই। এখন জানার দরকার আপনি নোটিসটি কীভাবে চেয়ারম্যান মহোদয় ও তালাকগ্রহীতার কাছে পাঠাবেন। আপনি দুটি উপায়ে স্ব-স্ব ব্যক্তির কাছে তালাকের নোটিস পাঠাতে পারেন। ১. সরাসরি তালাকের নোটিস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিয়ে রিসিভ কপিতে স্বাক্ষর করিয়ে নিতে পারেন। ২. সরকারি ডাকযোগে অর্থাৎ পোস্ট অফিসের মাধ্যমে প্রাপ্তিস্বীকারসহ রেজিস্ট্রি করে চিঠি সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় পাঠাতে পারেন। এতে সুবিধা বেশি এবং আইনি জটিলতা কম। কারণ সংশ্লিষ্ট ঠিকানার ব্যক্তিদ্বয় চিঠি গ্রহণের পর প্রাপ্তিস্বীকার ডকুমেন্টস আপনার কাছে ফিরে আসে। অনেকে প্রশ্ন করেন তালাকের নোটিস গ্রহণ না করলে তালাক কার্যকর হবে কি না। আপনি এ নিয়মে তালাকের নোটিস পাঠালে তালাক গ্রহীতা নোটিস গ্রহণ না করলে কেন গ্রহণ করেননি তা পোস্ট অফিসের মন্তব্যসংবলিত নোটিসটি আপনার কাছে ফেরত আসবে। চিঠির খামের ওপর লেখা থাকে ‘প্রাপক চিঠি গ্রহণ না করায় ফেরত’ অথবা ‘গ্রহণে অস্বীকৃতি’ অথবা ‘খুঁজে পাওয়া গেল না’ ইত্যাদি। যেদিন চিঠিখানা আপনার কাছে ফিরে আসবে সেদিন থেকে ৯০ দিন পার হয়ে গেলে তালাক আপনা-আপনিই কার্যকর হয়ে যাবে। অনেকে নোটিস গ্রহণ না করে মিথ্যা বলেন যে তালাকের নোটিস পাননি। তারা নিছক বোকার মতো কাজ করেন। যে পক্ষ থেকেই তালাকের নোটিস দেওয়া হোক, সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান বা মেয়র নোটিস পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষের মনোনীত প্রতিনিধি নিয়ে সালিশি পরিষদ গঠনের জন্য প্রতিনিধির নাম চেয়ে উভয়ের কাছে লিখিত চিঠি পাঠান। প্রথম নোটিসে কোনো পক্ষ হাজির না হলে পরবর্তী দুই মাসে আরও দুটি নোটিস পাঠান। সমঝোতার চেষ্টা সফলও হতে পারে, ব্যর্থও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সালিশি পরিষদের কাজ হলো আপসের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে না সফল তা তাদের রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা। তবে চেয়ারম্যান বা মেয়র মহোদয় আপনাদের কাছে চিঠি পাঠাতে কিংবা সালিশি পরিষদ গঠনে বাধ্য নন। কারণ আইনে তাদের এ বিষয়ে বাধ্য করা হয়নি। সে কারণে দেখা যায় চেয়ারম্যান বা মেয়র মহোদয় তালাকের নোটিস প্রাপ্তির পর কোনো সালিশি পরিষদ গঠন কিংবা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। ফলে নোটিস প্রাপ্তির ৯০ দিন পার হলেই তালাক আপনা-আপনিই কার্যকর হয়ে যায়। তবে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে গর্ভকাল শেষ হওয়ার পর তালাক কার্যকর হবে। এরপর রয়েছে তালাক রেজিস্ট্রি বিষয়। যিনি তালাক দিয়েছেন তিনি ৯০ দিন পর তালাকের নোটিস, নোটিস পাঠানোর ডাকরসিদ, প্রাপ্তিস্বীকারপত্র, আর যদি নোটিস গ্রহণ না করেন সে ক্ষেত্রে ফেরতসংবলিত নোটিস- এগুলো সংগ্রহ করে আপনার এলাকার কাজি অফিসে যাবেন তালাকটি নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন করতে। মুসলিম বিবাহ ও তালাক বিধিমালা, ২০০৯-এর ২১ বিধি অনুযায়ী তালাক নিবন্ধনের জন্য ৫০০ টাকা ফি গ্রহণ করতে পারবেন তালাক রেজিস্ট্রার। নকল প্রাপ্তি ফি বাবদ নেবেন মাত্র ৫০ টাকা। বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার কাজি যদি আপনার বাড়িতে গিয়ে তালাক রেজিস্ট্রি করেন তাহলে যাতায়াত বাবদ প্রতি কিলোমিটার ফি নেবেন ১০ টাকা আর পরবর্তীতে তালাক রেজিস্ট্রি-সংক্রান্ত সার্টিফাই কপি নিতে গেলে তল্লাশি ফি বাবদ নেবেন মাত্র ১০ টাকা। কোনো কারণে কাজি মহোদয় তালাক নিবন্ধন অস্বীকার করলে অস্বীকারের তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে জেলা রেজিস্ট্রার অফিসারের কাছে আপিলের বিধান আছে। তবে আনন্দের সংবাদ এই যে, বিয়ে রেজিস্ট্রি না করলে যেমন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, এ ক্ষেত্রে তালাক রেজিস্ট্রি বাধ্যতামূলক কিংবা শাস্তির কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কাজেই নিয়ম মেনে তালাকের নোটিস পাঠানো ও ওই ডকুমেন্টগুলো সংগ্রহে রাখলেই তালাক কার্যকরে আইনত কোনো বাধা নেই। আবার ১৯৬১-এর ৭(১) নম্বর ধারার বিধান অনুযায়ী তালাকদাতা যদি চেয়ারম্যান ও তালাকগ্রহীতাকে তালাকের নোটিস প্রদান না করেন তাহলে ৭(২) ধারা অনুযায়ী তালাকদাতা শাস্তি পাবেন ঠিকই, কিন্তু তালাক বাতিল হবে না। ওই তালাক কার্যকর হবে।

আরেকটি বিষয় আপনাদের জানিয়ে রাখি। নোটিস পাঠালেই কিন্তু তালাক কার্যকর হয়ে যায় না। নোটিস পাঠানোর ৯০ দিন পার হওয়ার আগেই যদি আপনাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয় তাহলে আপনি একই নিয়ম অনুসরণ করে তালাক প্রত্যাহার করে নিতে পারেন এবং একই স্ত্রীর সঙ্গে হিল্লা বিয়ে বাদেই ঘরসংসার করতে পারেন এতে আইন ও ধর্মের কোথাও বাধা নেই। আর যদি ৯০ দিন অতিক্রান্ত এমনকি কয়েক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও আপস হয়ে যায়, তাতেও একই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঘরসংসারে আইন ও ধর্মের কোথাও বাধা নেই।

                লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।।

সর্বশেষ খবর