শনিবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

তামাক নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে

অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী

ধূমপান একদিকে মাদকাসক্তির দিকে ধাবিত করে আরেকদিকে তামাক এক প্রাণঘাতী ও সর্বগ্রাসী মারাত্মক ক্ষতিকর পণ্য। তামাকের চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ (চুল্লিতে তামাকপাতা শুকানো, কারখানায় তামাকপণ্য উৎপাদন) এবং সেবন (ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন) সব প্রক্রিয়াতেই জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

দেশে ‘মাদক’ নিষিদ্ধ হলেও ‘তামাকজাত দ্রব্য’ এখনো অবৈধ বা নিষিদ্ধ নয়। সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। কারণ নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি একশ্রেণির মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে। ফলে এসব নেশাজাত দ্রব্যের চোরাচালান, অবৈধ ব্যবসা বেড়ে যায়। অবৈধ ব্যবসা করে হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ছে কতিপয় অসাধু চক্র। অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানিতে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এতে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

দেশি ও বিদেশি বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো আমাদের তরুণদের বিপথগামী হওয়ার পেছনে অন্যতম মূল হোতা। এসব কোম্পানি বেপরোয়া গতিতে তাদের ব্যবসা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফলে দেশে তামাকজনিক রোগবালাই ও মৃত্যুহার বাড়ছে। ২০১৩ সালে সংশোধিত ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ অনুসারে তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করে অধিকাংশ তামাক কোম্পানি প্রকাশ্যে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচির আড়ালে তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা চালিয়ে আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজকে টার্গেট করছে দীর্ঘমেয়াদে তাদের পণ্যের ভোক্তা তৈরির জন্য। যা এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ না থাকায় সুযোগ নিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল চেষ্টা করছে তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করার, কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনের পথে তা যথেষ্ট নয়। বরং দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কিছু ধারা সংশোধনের মাধ্যমে অধিক শক্তিশালী করতে হবে। তামাক কোম্পানি থেকে সরকারের শেয়ার ও সরকারের প্রতিনিধি প্রত্যাহার করতে হবে; যাতে তামাক কোম্পানিগুলোর লাগাম টেনে ধরা যায়। এ ক্ষেত্রে সবার আগে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলটি অধিকতর শক্তিশালী করাও বর্তমান সময়ের দাবি।

বিড়ি-সিগারেট ও সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য মারাত্মক ক্ষতিকর। করোনাভাইরাসের ঝুঁকি কমাতে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ জরুরি। বিশেষত ধূমপায়ী বা তামাক সেবনকারীদের করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি ১৪ গুণ বেশি! বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে জানিয়েছে, ধূমপানের সময় হাতের আঙুলগুলো ঠোঁটের সংস্পর্শে আসে এবং এর ফলে হাতে (সিগারেটের ফিল্টারে) লেগে থাকা ভাইরাস মুখে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তা ছাড়া ধূমপায়ীর ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যায় ও ফুসফুস দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি; যা তাদের কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপানে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পায় বিধায় সহজেই ক্ষতিকর ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এমনকি অকালমৃত্যু হয়ে থাকে।

ধূমপান ছাড়া তামাকের আরও দুটি মারাত্মক ক্ষতিকর দিক রয়েছে যার একটি হলো পরোক্ষ ধূমপান বা Secondhand Smoking. যিনি ধূমপান করেন না তিনি ধূমপায়ীর পাশে বসে থেকেও ধূমপানের ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ফুসফুসের ক্যান্সার, হার্ট, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বছরে ১২ লক্ষাধিক অধূমপায়ী পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, যার অধিকাংশই শিশু ও নারী।

আরেকটি দিক হলো ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার। আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে জর্দা, গুল, শাদাপাতা, খইনি ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। এর ফলে মুখের ক্যান্সার হচ্ছে অনেক। ধূমপানের কারণে যে ক্ষতি হয় তা বড় করে দেখা হয় কিন্তু তামাকের আরও যে বহুবিধ ক্ষয়ক্ষতি আছে তা বড় করে দেখা হচ্ছে না। পরোক্ষ ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারে বিশ্বে বছরে ৮০ লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে (WHO-2019)।

বাংলাদেশ থেকে মাদক সম্পূর্ণ নির্মূল করতে হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘সাউথ এশিয়ান স্পিকার সামিট’-এ ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার থেকে বিরত রাখা অত্যন্ত জরুরি। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে ও স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য তরুণদের ধূমপান, মাদকসহ সব নেশা থেকে দূরে থাকা জরুরি। এ কিশোর-তরুণদের নেশা থেকে দূরে রাখতে পারলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত হবে। সুতরাং আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষার জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সক্রিয় হতে হবে। শিশু-কিশোর-তরুণ যারা দেশের ভবিষ্যৎ, তারা ধূমপানের মাধ্যমে নেশার জগতে প্রবেশ করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াক তা কারও কাম্য হতে পারে না।

 

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)।

সর্বশেষ খবর