মঙ্গলবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

হার মানে না যে জাতি

আবুল কালাম আজাদ

ইতিহাস বলে, ২০০০ বছর আগেও এ ভূখন্ডের সুনাম ছিল জগজ্জুড়ে। রোমান কবি ভার্জিল পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-বুড়িগঙ্গা পাড়ের অধিবাসীদের বীরত্ব নিয়ে কবিতা লিখেছেন সেই প্রাচীনকালে। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারও সমীহ করতেন বাঙালি জাতিকে। ভারতবর্ষ দখলে অভিযান চালান এই মহাবীর। আলেকজান্ডারের সময় বাঙালি পরিচিত ছিল গঙ্গারিড জাতি হিসেবে। আলেকজান্ডারের সভাসদরা লিখেছেন গঙ্গারিড জাতির বীরত্বের কথা জেনে গ্রিক বীর তাঁর ভারত অভিযান মাঝপথে খান্ত দেন। সেই প্রাচীনকালে রাশিয়া ও সংলগ্ন এলাকা থেকে ভারতবর্ষে হানা দেয় যাযাবর জাতি আর্যরা। ভারতবর্ষের প্রায় সব জাতি হার মানলেও হার মানেনি পদ্মা-মেঘনা -যমুনা পাড়ের মানুষ।

সেই প্রাচীনকালে বাঙালি তাদের বিজয় পতাকা উড়িয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। বাঙালি যুবরাজ বিজয় সিংহ জয় করেছিলেন দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কা। তাঁর নামেই সে দেশের নামকরণ হয় সিংহল। পাল যুগে বাঙালির অধিকারে আসে ভারতবর্ষের এক বড় অংশ। পাল সম্রাটদের সুদিনের অবসান ঘটে অন্তঃকোন্দলে। সে কোন্দলের সুযোগ নেয় একাদশ শতকে কর্ণাটক থেকে আসা সেনরা। পালদের হটিয়ে বাংলার সিংহাসনে বসে তারা। বাংলায় সেনরা ছিল সম্ভবত প্রথম বিদেশি শাসক। তবে দক্ষিণ ভারত থেকে এসে বাংলার মসনদে বসলেও এ দেশকে নিজেদের দেশ হিসেবেই নেয় তারা। সেনদের হটিয়ে ক্ষমতায় আসে তুর্কি বংশোদ্ভূত ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খলজি। তারপর কিছু ব্যতিক্রম বাদে ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজদের কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় পর্যন্ত বাংলায় কায়েম ছিল মুসলিম শাসন। বাংলা কখনো স্বাধীন ভূখন্ড হিসেবে, কখনো দিল্লির শাসনাধীন রাজ্য হিসেবে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। ভারতবর্ষ শুধু নয়, বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ এলাকা ছিল মধ্যযুগের বাংলাদেশ। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ২০১২ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঙালি সম্মেলনে বক্তব্য দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তাঁর লেখায় সে সময়কার বাংলাদেশকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে ধরেছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে উৎপাদন ও বাণিজিক যোগাযোগ রাখতে খুবই উদ্গ্রীব ছিল সে সময়কার পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, ইংরেজ, ড্যানিশ তথা ইউরোপীয় দেশগুলো। ১৭০৩ সালে প্রসিদ্ধ মানচিত্র শিল্পী থর্নটন খুব জোর দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন সে সময়ের বাংলাদেশের মানচিত্র, সেটিকে বলেছিলেন ‘দ্য রিচ কিংডম অব বেঙ্গল’। ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা এ দেশ দখল করে। তাদের শোষণে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়। অনাহারে মারা যায় এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। এ দেশের বস্ত্রশিল্প ধ্বংস করতে তন্তুবায়দের হাতের আঙুল কেটে নেওয়া হয়। তাদের দুঃশাসনে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ পরিণত হয় অভাবী দেশে। আর এ দেশ থেকে লুটে নেওয়া অর্থে নিশ্চিত হয় লন্ডনের সমৃদ্ধি। এমনকি আজ বিশ্বের সেরা সমৃদ্ধ যে দেশ আমেরিকা তার রাজধানী ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিল গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের টাকায়। এ দেশে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। গভর্নর জেনারেল পদে লর্ড কর্নওয়ালিস। তিনি ছিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রূপকার। এ জংলিব্যবস্থা প্রণয়নে তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন টমাস ল নামে এক ইংরেজ সিভিলিয়ান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের আত্মীয়। টমাস ল এ দেশে দায়িত্ব পালনকালে সীমাহীন লুটপাটের আশ্রয় নেন। দেশি রাজা-মহারাজা, জমিদার এমনকি সাধারণ প্রজাদের বিপদে ফেলে উৎকোচ আদায় করতেন তিনি। এভাবেই সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে সমর্থ হন টমাস ল। দেশে ফেরার সময় তিনি বিপুল পরিমাণ সোনা-হীরা ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে যান। পথে এডেন বন্দরে ভেড়ে তাদের জাহাজ। সেখানে টমাস ল শুনতে পান বাংলাদেশে কর্মরত ইংরেজ অফিসারদের অর্জিত অবৈধ অর্থ সম্পর্কে বিলেতে তদন্ত শুরু হয়েছে। কাউকে কাউকে শাস্তিও পেতে হয়েছে। টমাস ল প্রমাদ গোনেন। তিনি দেশে ফেরার বদলে নেমে যান এডেন বন্দরে। ওঠেন আমেরিকাগামী এক জাহাজে। আজ যেখানে ক্যাপিটল হিল সে জায়গাটি তার পছন্দ হয়। সেখানেই বসতি গড়ে তোলেন টমাস ল। একটি চিনিকলও তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে ক্যাপিটল হিলের বিশাল ভূসম্পত্তি তিনি মার্কিন সরকারের কাছে বিক্রি করেন। সেখানেই স্থাপিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। বাংলাদেশ পরিণত হয় পাকিস্তানের একটি প্রদেশে। পাকিস্তানে বাঙালি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তার পরও দেশ শাসনে তাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না। সীমাহীন শোষণ আর দুঃশাসনের শিকার হয় বাংলাদেশ। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান বাঙালি জাতির সাহসী নেতা শেখ মুজিব। শুরু হয় বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ব্যঙ্গ করে বলা হতো ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সঠিক পথেই এগোচ্ছিলেন। রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো বাংলাদেশ ভস্ম থেকে উড়াল দেওয়ার জন্য পাখা মেলেছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড সে যাত্রা থেমে যায়। তারপর শুরু হয় পেছনে চলা। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নসাধ সোনার বাংলা গড়ার প্রক্রিয়া। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সে কার্যক্রম স্তব্ধ হয়ে পড়ে অশুভ শক্তির ক্ষমতাচর্চায়। ২০০৮ সালে আবারও দেশ পরিচালনার ভার যায় বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন উন্নত বিশ্বের কাতারে যাওয়া। যে দেশের বাজেট প্রণীত হতো বিদেশি ঋণ ও দানের টাকায় সে জাতি ইতোমধ্যে দাতা জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের মতে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইউরোপের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নসাধ ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবে রূপ নেবে। বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার করোনাকালের বিশ্বমন্দার দুঃসময়েও সামনের কাতারে। প্রতি পাঁচ বছরে বাংলাদেশের সম্পদ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। ৫০ বছর আগে এ দেশে আলপিনও তৈরি হতো না। আজ বাংলাদেশের তৈরি জাহাজ ইউরোপের জার্মানিসহ অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ফ্রিজ, মোটরসাইকেল রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। ইউরোপ-আমেরিকায় যাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। তৈরি পোশাকে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে।

যে দেশের লোকজন একসময় বিদেশ থেকে আনা পুরান কাপড় পরে লজ্জা ঢাকত সে দেশের পোশাক এখন বিশ্বজুড়ে রাজত্ব করছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অচিরেই উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাবে বাংলাদেশ।

                লেখক : প্রাবন্ধিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর