বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
স্মরণ

শহীদ আসাদ দিবস

বিমল সরকার

শহীদ আসাদ দিবস

আজ ২০ জনুয়ারি শহীদ আসাদ দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উত্থানপর্বে আইয়ুবশাহির লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে শহীদ হন প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আসাদ (আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান)। দেশব্যাপী ছাত্র ও গণজাগরণ, শহীদ আসাদ (২০ জানুয়ারি), শহীদ মতিউর রহমান  (২৪ জানুয়ারি) ও শহীদ ড. শামসুজ্জোহা (১৮ ফেব্রুয়ারি), এভাবেই আইয়ুবের পতন আর গর্বের গণঅভ্যুত্থান; মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ও অনুপ্রেরণা।

নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার বর্ধিষ্ণু ধানুয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪২ সালে আসাদের জন্ম। আসাদ ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত। স্কুলজীবনেই আসাদুজ্জামান ও মনিরুজ্জামান দুই ভাই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। নিজ উপজেলা শিবপুর ও নরসিংদীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এলাকায় সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালিয়ে যান আসাদ। অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ, শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ এবং মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। আসাদের বাবা এম এ তাহের ছিলেন শিবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ; অসাধারণ মেধাবী এবং অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। আর মা মতিজাহান খাদিজা খাতুন নারায়ণগঞ্জ শহরের খ্যাতনামা আই টি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষিকা।

বাবার শিবপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন আসাদ। ১৯৬৩ সালে সিলেটের এম সি কলেজ থেকে (ছাত্র রাজনীতিতে অধিক মনোযোগী হয়ে এক বছর পিছিয়ে) আইএ পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। ছাত্র রাজনীতিতে একই আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় এম সি কলেজে নুরুল ইসলাম নাহিদ (সাবেক শিক্ষামন্ত্রী) ও আসাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উভয়ে ছিলেন হরিহর আত্মা। আসাদ ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে অনার্স পাস করেন। ১৯৬৭ সালে এমএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি না পাওয়ায় ফলাফল বাতিল করে ১৯৬৮ সালে তিনি পুনরায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। একই সঙ্গে এবং একই বিষয়ে (ইতিহাস) সেবার আসাদের পাশাপাশি বসে এমএ পরীক্ষা দেন তাঁর অনুজ এইচ এম মনিরুজ্জামানও। গণঅভ্যুত্থানের এক মাস পর (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা যায় উভয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করেছেন। আসাদ ছিলেন ঢাকা হলের (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) ৩০২ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র।

কোনো ব্যক্তি বা ঘটনা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হলে ওই সময়টি সম্পর্কেও সম্যক ধারণা থাকতে হবে। দেশের বেশির ভাগ উপজেলা বা থানা সদরেই এমনকি আমাদের স্বাধীনতা লাভের পরও দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অনগ্রসর বা উপেক্ষিত। নারী শিক্ষায় ছিল আরও পিছিয়ে। এমনই প্রেক্ষাপটে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে সন্তানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন এই শিক্ষকদম্পতি। তাঁরা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বীরসেনানী শহীদ আসাদের গর্বিত মা-বাবা এম এ তাহের ও মতিজাহান খাদিজা খাতুন।

ধানুয়া গ্রামের বাড়িটি ‘মিয়াজীবাড়ি’ আর আসাদদের বাবা ‘তাহের মওলানা সাহেব’ নামে সমধিক পরিচিত। ‘মস্টারবাড়ি’ বলেও ডাকে অনেকে। বাড়ির আঙিনায় বেশ প্রাচীন মসজিদ। প্রখর মেধার অধিকারী, সৎ ও সজ্জন; ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষার বিরল সমন্বয় ঘটেছিল এম এ তাহেরের মধ্যে। এ দম্পতি তাদের আট সন্তানের নাম রাখেন : কে এম খুরশীদুজ্জামান (খলিলুল্লাহ মোহাম্মদ খুরশীদুজ্জামান), এন এম মুরশীদুজ্জামান (নাসরুল্লাহ মোহাম্মদ মুরশীদুজ্জামান), এফ এম রশীদুজ্জামান (ফয়জুল্লাহ মোহাম্মদ রশীদুজ্জামান), এ এম আসাদুজ্জামান (আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান; গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদ), এইচ এম মনিরুজ্জামান (হাবিবুল্লাহ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান), আনোয়ারা ফেরদৌসী, এ এম নূরুজ্জামান

(আজিজুল্লাহ মোহাম্মদ নূরুজ্জামান) ও দেলোয়ারা ফেরদৌসী।

শহীদ আসাদের বাবা মারা যান ১৯৯৬ সালে আর রত্নগর্ভা মা আগের বছর ১৯৯৫ সালে। একমাত্র আসাদ ছাড়া সব সন্তানেরই লেখাপড়া, বেড়ে ওঠা, কর্মোদ্যম সবকিছু সচক্ষে দেখে যান তাঁরা। আরও গর্বের কথা, তাঁদের একটি সন্তানের আত্মবলিদানের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থান সফল পরিণতির দিকে এগোয়। আইয়ুবের পতন, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- এ সবকিছুর মূল প্রেরণা আসাদসহ শহীদদের আত্মত্যাগ। ছেলে শহীদ হওয়া তথা গণঅভ্যুত্থানের পর পুত্রশোকের দুঃসহ স্মৃতি বহন করে স্বাধীন দেশে আরও অন্তত ২৭ বছর বেঁচে ছিলেন আসাদের শোকবিহ্বল বাবা-মা। আট ভাই-বোনের মধ্যে আসাদসহ বড় চারজন আজ লোকান্তরিত। বেঁচে রয়েছেন চরজন- এইচ এম মনিরুজ্জামান, এন এম নূরুজ্জামান,  আনোয়ারা ফেরদৌসী ও দেলোয়ারা ফেরদৌসী।

শহীদ আসাদ জীবনের বিনিময়ে আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রইলেন। বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান রচিত ‘আসাদের শার্ট’, আহা! সে কি কথামালা! আসাদের নামে ঢাকার আসাদ গেটের নামকরণ। নরসিংদীর শিবপুরে সরকারি শহীদ আসাদ কলেজ, শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস হাইস্কুল, শহীদ আসাদ সরণিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান-স্থাপনা আসাদের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। সরকার ২০১৮ সালে আসাদকে স্বাধীনতা পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করেছে। দীর্ঘদিনের দাবি স্কুলের পাঠ্যসূচিতে শহীদ আসাদের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা। এতে নতুন প্রজন্ম ভালো করে গণঅভ্যুত্থান, শহীদ আসাদ ও তাদের আলোকিত পরিবারের কথা জেনে অনুপ্রেরণা পেতে পারে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর