রবিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

রাশিয়ার সেই লোভী কৃষকের গল্পটা মনে পড়ে বারবার

তপন কুমার ঘোষ

রাশিয়ার সেই লোভী কৃষকের গল্পটা মনে পড়ে বারবার

৭ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেওয়া টিভি ও বেতার ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্নীতিবাজ যে দলের আর যত শক্তিশালীই হোক কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না এবং হবে না। এ সামাজিক ব্যাধি দূর করতে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির ওপর তিনি জোর দেন। দুর্নীতি একটি বা দুটি দেশের সমস্যা নয়। কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সব দেশেই দুর্নীতির রেকর্ড আছে। তবে মাত্রার রকমফের আছে এই যা। দুর্নীতি উন্নয়নের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করে।

দুর্নীতির প্রধান কারণ অতিলোভ। এ প্রসঙ্গে রাশিয়ার সেই লোভী কৃষকের গল্পটা মনে পড়ে যায়। কালজয়ী রুশ লেখক লিও তলস্তয়ের অমর সৃষ্টি ‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ এ ম্যান নিড’। বাংলায় গল্পটির নামকরণ হতে পারে ‘একজন মানুষের কতটুকু ভূমি প্রয়োজন’। গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে রাশিয়ার এক লোভী কৃষক। ‘পাহম’ নামে সে পরিচিত। তার ছিল ভূসম্পত্তির প্রতি অতিলোভ। একদিন সে খবর পায় ভলগা নদীর ওপারে একটি নতুন পত্তনি হয়েছে যেখানে নামমাত্র মূল্যে উর্বর জমি কেনা যাচ্ছে। পাহম খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে খবরটি সঠিক। এক বসন্তে পরিবার-পরিজন নিয়ে নতুন রাজ্যে পাড়ি জমায় সে। সেখানে দিনকাল ভালোই কাটছিল তার। একদিন কেউ একজন এসে তাকে খবর দেয়, দূরের এক রাজ্যে পানির দামে আরও উর্বর জমি কেনাবেচা হচ্ছে। প্রলোভনে পড়ে পাহম। ফের নতুন এক রাজ্যে পাড়ি জমায়। সঙ্গে তার একজন চাকর। পাহম জমি কিনতে চায় জেনে সেখানকার বাসিন্দারা খুবই খুশি হয়। তাদের সর্দার এসে সবকিছু শুনে জানায়, এক দিনে পাহম যত দূর জমি ঘুরে আসতে পারবে তত দূর জমির মালিক হবে সে। তবে শর্ত একটাই। সূর্যোদয়ের সময় যাত্রা করে সূর্যাস্তের মধ্যে ফিরে আসতে হবে তাকে। পাহম রাজি হয়ে যায়। এ সুবর্ণ সুযোগ কে হাতছাড়া করে! কথামতো একদিন সূর্যোদয়ের সময় জমি দখলের দৌড় শুরু করে পাহম। সে বেছে বেছে একটার পর একটা উর্বর জমি চিহ্নিত করে। এসব জমিতে সোনা ফলে। দুপুর গড়িয়ে যায়। সেদিকে তার খেয়াল নেই। একসময় তার হুঁশ হয়। তাকে যে সূর্যাস্তের মধ্যেই ফিরতে হবে। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় শুরু করে পাহম। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। দূরে অস্পষ্ট দেখা যায় গোল পাহাড়। কিন্তু পথ যে এখনো অনেকটা বাকি। দ্রুতবেগে ছুটতে থাকে পাহম। তার হৃৎপিন্ডের ভিতরে কে যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। উর্বর জমির চিন্তা সে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। আগে তো প্রাণে বাঁচা। তারপর তো জমির হিসাব। সৃষ্টিকর্তা তার সহায় হন। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত পাহম সূর্য ডোবার আগমুহূর্তে সেই গোল পাহাড় স্পর্শ করে। এখান থেকেই সে যাত্রা করেছিল। গোল পাহাড়ে সমবেত জনতা হর্ষধ্বনি করে পাহমকে স্বাগত জানায়। পাহম এক দিনের ব্যবধানে অনেক ভূসম্পত্তির মালিক বনে যায়। কিন্তু পাহমের জন্য যে চরম পরিণতি অপেক্ষা করছিল তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কে জানত! কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত-অবসন্ন পাহম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সাব্যস্ত হলো, পাহমকে সমাহিত করা হবে তার নিজের জমিতেই। যে জমির মালিক সে কিছুক্ষণ আগে হয়েছে। এক কোণে তার জন্য কবর খোঁড়া হলো। তাকে সমাহিত করতে প্রয়োজন হলো মাত্র সাড়ে তিন হাত জমি। পড়ে রইল পাহমের সাম্রাজ্য। পাহমের কপাল মন্দ বলতে হবে। অতিলোভের পরিণতি কী মর্মান্তিক হয় পাহম নিজের জীবন দিয়ে তা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রায় দেড় শ বছর আগে লেখা এ গল্পটি আজও কত প্রাসঙ্গিক! এ গল্পের মর্মার্থ আমরা কতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছি, এটাই প্রশ্ন। অর্থবিত্ত সুখ দিতে পারে না। ধনসম্পদের প্রাচুর্য ও ভোগবিলাসে সুখী হওয়া যায় না। বিষয়টা আপেক্ষিক। তবু এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, লোভী মানুষ কখনো সুখী হতে পারে না। সে যত পায় তত চায়। যে শুধু নিজের লাভের কথা ভাবে সে কখনো সুখী হতে পারে না। যার যতটুকু আছে সে যদি ততটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে তবেই সে অনেকটা সুখী।

অভাবে স্বভাব নষ্ট বলে একটা কথা চালু আছে। বলা হয়, প্রয়োজন কোনো বাধা মানে না। কথাটি পুরোপুরি মানা যায় না। দেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে যারা তীব্র অভাব-অনটনের মধ্যেও এক চুল বিচ্যুত হননি নীতি-আদর্শ থেকে। কোনো লোভ-লালসা বা প্রলোভন তাঁদের নিয়ে যেতে পারেনি বিপথে। সৎ জীবনযাপনের মধ্যেই তাঁরা সুখ খুঁজে পেয়েছেন।

মূল্যবোধ আজ ধুলায় লুটাচ্ছে। ‘বিবেকের দংশন’ কথাটি মুছে গেছে অভিধানের পাতা থেকে! অর্থই অনর্থের মূল। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। অতিলোভে তাঁতি নষ্ট। এ প্রবাদগুলো মিথ্যা নয়। সন্তানদের বাল্যকাল থেকেই মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। শিশু ন্যায়-অন্যায় বোঝে না। তাকে ভালো-মন্দ বোঝাতে হয়। মন-মানসিকতার পরিবর্তন রাতারাতি হয় না। এটা চর্চার বিষয়। কথায় বলে, আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও। দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাক দেশ, এটাই সবার কাম্য।

লেখক : পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন।

সর্বশেষ খবর