শনিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই নিয়ে বহুমুখী গবেষণা

শাইখ সিরাজ

ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই নিয়ে বহুমুখী গবেষণা

প্রাণিসম্পদ খাতের নতুন আশার নাম ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই। সারা পৃথিবীতেই মাছ ও মুরগির খামারের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে প্রাণিখাদ্যের প্রোটিনের উৎস হিসেবে এ মাছি রীতিমতো চাষ করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন অঞ্চলে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই উৎপাদন শুরু করেছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। বহুদিন ধরেই খামারিদের অভিযোগ বাজারের খাবার নিয়ে। বাজারের খাবারে যে পরিমাণ প্রোটিন সরবরাহ করা প্রয়োজন তা তো থাকেই না, দামও বেশি। ঠিক এ জায়গায় বহুরকম ইতিবাচক সম্ভাবনা জানান দিচ্ছে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই। এ মাছি কিংবা লার্ভা নিয়ে জানা-অজানা নানা তথ্য রয়েছে। মাস দু-এক আগে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে গড়ে ওঠা ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইর খামার নিয়ে লিখেছিলাম। ২ হাজার ৭০০ সৈনিক মাছির মধ্যে একটি জাত হচ্ছে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই। মাছি প্রজাতির ৯৯ ভাগের বেশি জীবনকালের সিংহভাগ কাটায় পানিতে। কিন্তু এ মাছির জীবন কাটে ডাঙায়। মূলত স্থলভাগই এদের বিচরণ ক্ষেত্র। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই ‘কফি’ ও ‘বিয়ার’ পছন্দ করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০১৪ সালে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই নিয়ে গবেষণা করে। তারা জানায়, এটি অসাধারণ এক স্বাস্থ্যকর প্রোটিনের উৎস। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই থেকে উৎপাদিত তেল হতে পারে বায়োডিজেল। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই হয়ে উঠতে পারে প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিকের উৎস। গবেষণাগারে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই জিন বিন্যাসের কাজে অনন্য সহায়ক। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই সব মিলিয়ে বাঁচে ৪৫ দিন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর এর জীবনকাল মাত্র নয় দিন। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই প্রতিদিন তার শরীরের ওজনের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি মানুষের খাদ্যোপযোগী। কিন্তু পৃথিবীতে এ লার্ভা মানুষের খাদ্য হিসেবে গ্রহণের চিত্র তেমন দেখা যায় না। এফএওর এক রিপোর্টে দেখা যায়, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ের বাজার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে। শুধু তাই নয়, এফএও ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত এর প্রবৃদ্ধি হিসাব করে জানিয়েছে, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইর বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (সিএজিআর) ৩৪.৭ ভাগ।

দেশের অনেক স্থান থেকে খবর আসছে ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ উৎপাদন বিষয়ে। কিন্তু এমন এক তরুণের দেখা পেলাম যে কি না ইতালির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে এসে এখন রাজধানীর নিজ বাসভবনের ছাদে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করছেন। তরুণের নাম ইমরান কবির। শাহবাগে অবস্থিত বাসভবনের ছাদের ওপর মাত্র ৮ ফুট বাই ১২ ফুট আকারের একটি ছোট্ট কক্ষে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই নিয়ে তার বহুমুখী কর্মযজ্ঞ। এক সকালে উপস্থিত হই ইমরানের গবেষণা দেখতে। উচ্ছল এক তরুণ, বয়স ত্রিশের কোঠা এখনো ছাড়ায়নি।

‘২০১৫ সাল থেকে করপোরেট পৃথিবীর সঙ্গেই পথ চলছিলাম। কিন্তু ২০১৭ সালে মনে হলো আত্মার তুষ্টির জন্য কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। তখন মডার্ন ফিশ ফার্মিং নিয়ে মার্কেট সার্ভে গিয়ে দেখি আমাদের প্রোটিনের প্রধান সোর্স  মাছ আর মুরগি। এ মাছ আর মুরগি যেখান থেকে প্রোটিন পায় তার একটাও সাসটেইনেবল সোর্স নয়। একটা সাসটেইনেবল প্রোটিন সোর্স খুঁজতে গিয়ে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই নিয়ে কাজ শুরু করি।’ নিজের কর্মকান্ডের সূচনার কথা বলছিলেন ইমরান কবির।

ইমরান পরীক্ষামূলক কার্যক্রমটি শুরু করেন ২০১৮ সালে। সূচনার পরই আরও একটি বিষয় মাথায় খেলে যায় তার। তিনি লক্ষ্য করলেন ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইর মূল খাদ্য জৈববর্জ্য। আর আমাদের দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই হতে পারে এর একটি অনন্য সমাধান। এরই মধ্যে ইমরান পুরোপুরি রপ্ত করে ফেলেছেন গৃহস্থালি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঘিরে ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’-এর জীবনচক্র সাজানোর বিষয়টি। এরই সঙ্গে নাগরিক বর্জ্যরে ব্যবহার ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লার্ভা উৎপাদনের একটি বড় স্বপ্নের কাছেও পৌঁছে গেছেন তিনি।

ইমরান বললেন, ‘২০১৮ সালের এক হিসাবমতে আটটি বিভাগীয় শহরে প্রতিদিন ৩০ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য ভাগাড়ে ফেলা হয়। ওই বর্জ্যকে আমরা বিদ্যুৎ ও সারে রূপান্তর করতে পারি। ভেবে দেখলাম আমরা চাইলে এ বর্জ্য প্রোটিনেও রূপান্তর করতে পারি। যা আমাদের মাছ ও মুরগির খাবারের প্রোটিন চাহিদা মেটাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।’

বাজারে মুরগির বা মাছের রেডি ফিড পাওয়া যায়, তাতে প্রোটিনের পরিমাণ কতখানি? এ বিষয়ে আপনার কাছে কোনো তথ্য-উপাত্ত আছে?- জানতে চাই আমি।

ইমরান বলেন, বাজারের দামি খাবারে ১৬-৩২% পর্যন্ত প্রোটিন থাকে। সস্তা খাবারে প্রোটিনের পরিমাণ আরও কম থাকে। অথচ ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইর লার্ভায় ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৬৮% প্রোটিন পাওয়া যায়। তার গবেষণা বলছে, বাদামি সোনা খ্যাত এ লার্ভা শুধু প্রোটিনের গুণেই সমৃদ্ধ নয়। এর মধ্যে রয়েছে আরও বহুগুণ। এর জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন বর্জ্যরে উৎস সম্পর্কে জানা ও সেগুলোর ব্যবস্থাপনাকে এর সঙ্গে যুক্ত করা। গৃহস্থালির জৈব বর্জ্য ও অজৈব বর্জ্য আলাদা করে রাখা। যা আমরা উন্নত দেশগুলোয় দেখি। প্রতিটি ঘরে জৈব ও অজৈব বর্জ্য পৃথক কনটেইনারে রাখে বা পলিব্যাগে ময়লার গাড়িতে তুলে দেয়। এরই মধ্যে ইমরান জানার চেষ্টা করেছেন শহরের কী কী বর্জ্যকে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই উৎপাদনের মাধ্যমে জৈব সারে রূপান্তর করা যায়, কোন কোন বর্জ্যে উপকারী পুষ্টি উপাদান বেশি থাকে আর কোন উপায়ে বর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। গৃহস্থালির আবর্জনা যেমন শাকসবজি, ফলমূলের খোসা, মাছ-মুরগির অবশিষ্টাংশ থেকে শুরু করে কাঁচাবাজারের বর্জ্য, মাছবাজার, মিউনিসিপ্যালের বর্জ্য, ঘাস-পাতা, কমিউনিটি সেন্টারের খাবারের উচ্ছিষ্ট এসব বর্জ্যওে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইর বৃদ্ধি, উৎপাদন নিরীক্ষা করে দেখছেন ইমরান।

আগেই বলেছি ইমরানের গবেষণাগার তথা ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই উৎপাদন কেন্দ্র খুব বড় নয়। অল্প জায়গায় ঊর্ধ্বমুখী কাঠামো ব্যবহার করছেন তিনি। তাক করে বড় বড় প্লাস্টিকের গামলায় একেক বয়সের ভিন্ন ভিন্ন খাদ্য ক্যাটাগরিতে ভাগ করে রাখা হয়েছে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই।

৪৫ দিনের চার স্তরে ডিম থেকে লার্ভা আর লার্ভা থেকে মাছি পর্যন্ত জীবনচক্রের পুরোটাই দেখালেন ইমরান। প্রথমে বর্জ্যকে প্রসেস করে পানির পরিমাণ কমিয়ে নিয়ে তাতে ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’র ডিম ছেড়ে দেওয়া হয়। খাবার পেয়ে ডিম থেকে লার্ভা স্তরে আসে।

‘বর্জ্যকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে লার্ভা হয়ে উঠছে প্রোটিনের আধার আর উচ্ছিষ্ট হয়ে উঠছে উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার’ বলছিলেন ইমরান। ১ কেজি বর্জ্য থেকে ৭০০ গ্রাম জৈব সার আর ৩০০ গ্রাম ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইর পরিপূর্ণ লার্ভা পাওয়া যায় বলে জানালেন ইমরান। যেহেতু এদের রিপ্রোডাকশন রেট ২ হাজার গুণ। কিছু লার্ভা রাখা হয় মাছিতে রূপান্তর হওয়ার জন্য। বাকিটা মুরগি বা মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আবার লার্ভা থেকে পাউডার তৈরি করে সংরক্ষণ করা যায়।

ইমরান বলছিলেন, ‘এ মাছির কোনো কিছুই উচ্ছিষ্ট নয়। মাছি বা লার্ভা বের হচ্ছে যে সেল বা খোলস থেকে তা-ও অতিমূল্যবান। জৈব প্লাস্টিক হিসেবে ব্যবহার হয় এ সেল। বিশেষ করে ফার্মাসিউটিক্যাল বা প্রসাধন শিল্পে এর ব্যাপক চাহিদা আছে।’

ইমরান খাতা-কলমে হিসাব করে দেখালেন তার এ অল্প পরিসরেই বছরে বর্জ্য রূপান্তর করা হচ্ছে ২ টন। অর্থাৎ তার হিসাব বলছে, বছরে এখান থেকে মোট জৈব বর্জ্য (বায়োওয়েস্ট) রিডিউস হচ্ছে ৬৬০ থেকে ৭০০ কেজি। এনপিকে সার তৈরি হচ্ছে ৮৫০ থেকে ১ হাজার কেজি। আর অ্যানিমল প্রোটিন তৈরি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি।

‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’র এমন একটি আদর্শ খামার বিভিন্ন প্রাণিসম্পদের খামারের ভিতরেও নির্মাণ করা যেতে পারে। ইমরান বলছেন, সে ক্ষেত্রেও এটি হতে পারে দারুণ লাভজনক।

বিষয়টির একরকম হাতে-কলমেও প্রমাণ দেখলাম। ছাদের এক কোণে রাখা একই বয়সী দুটি মুরগির একটিকে খাওয়ানো হয়েছে বাজারের খাবার, অন্যটিকে দেওয়া হয়েছে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই। হিসাব করে দেখা গেল ৩০ ভাগ ওজন বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই প্রোটিন খেয়ে।

‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’র মাধ্যমে বর্জ্য বা ময়লা জৈব সারে রূপান্তর করা গেলে একদিকে ভ্যালু অ্যাড করবে অন্যদিকে বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনাও সম্ভব হবে। এটি শহরের আবর্জনা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও হতে পারে কার্যকর এক ব্যবস্থা। এতে কার্বণ নিঃসরণেরও ন্যূনতম সুযোগ নেই।

মাছ ও পোলট্রি খাতের জন্য ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই হতে পারে এক আশীর্বাদ। আমাদের দেশে পোলট্রি ও মাছ, প্রাণিজ প্রোটিনের এ দুটি খাতই বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ এক সাফল্যের জায়গায় এসেছে। যদিও পোলট্রি খাতে এখনো রয়েছে গেছে নানামুখী সংকট। এ দুটি খাতের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড় সংকটের জায়গাটি হচ্ছে মানসম্মত খাদ্য। বিশেষ করে প্রোটিন। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রাণিসম্পদের প্রোটিনের উৎস হিসেবে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইর খামার বাড়ছে। তারাও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কিংবা সার্কুলার ইকোনমির প্রশ্নে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইকে নিয়ে ভাবছে। তরুণ উদ্যোক্তা ইমরান কবির যেভাবে বড় আঙ্গিকে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই উৎপাদন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা ভাবছেন, এ সম্ভাবনা সামনে নিয়ে অনেক দূর কাজ করতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। আশা করি এমন সমন্বিত উৎপাদনব্যবস্থার মধ্য দিয়েই আমাদের প্রাণিসম্পদ খাতে নতুন গতি সঞ্চার হবে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর