শনিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

দুর্নীতি বনাম সুনীতি

আবুল কালাম আজাদ

দুর্নীতির বিপরীত সুনীতি। দুর্নীতি রোধ যেমন কাম্য, আরও বেশি কাম্য সুনীতি প্রতিষ্ঠা। সুনীতির বিকাশ আমাদের মননে মগজে স্থিতিলাভ করলে দুর্নীতির কালো ছায়া বিস্তারের সুযোগ পাবে না। সুনীতির প্রতি পক্ষপাতিত্ব দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। সুনীতির জন্য চাই নৈতিক শিক্ষা। দুর্ভাগ্য, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নৈতিক শিক্ষা লোপ পাচ্ছে। শিক্ষার লক্ষ্য একসময় ছিল নৈতিক মান অর্জন। আজ তা বৈষয়িক লক্ষ্য সামনে রেখে এগোচ্ছে। শিক্ষার মাধ্যমে অর্থ অর্জনের বিষয়টি ক্রমে গুরুত্ব পাচ্ছে। জীবনযাপনের বাস্তবতায় অর্থ অর্জন অবশ্যই উপেক্ষণীয় নয়। যে শিক্ষা কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়তা করে তার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও নৈতিক শিক্ষার অভাব নানা সংকট সৃষ্টি করছে। ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্ণয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে উপলব্ধি সৃষ্টির অভাব থেকেই যাচ্ছে। সত্য, সুন্দর, কল্যাণের বিপরীতে থাকে অসত্য, অসুন্দর, অকল্যাণ। সত্য, সুন্দর, কল্যাণের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হলে অসত্য, অসুন্দর, অকল্যাণ থাবা বিস্তারে সক্ষম হবে এ-ই স্বাভাবিক। ফলে ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায় এবং মাদকাসক্তির বিস্তার ঘটানোর পেছনে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্য ও সীমাবদ্ধতা যে কমবেশি দায়ী তা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনে যা শিখছে তার মধ্যে নৈতিক শিক্ষার কমতি থাকায় বিশ্বজুড়েই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। আগে শিক্ষার্থীরা পাঠশালা, স্কুল-কলেজে যেমন নৈতিক শিক্ষা পেত, তেমনি তারা বাবা-মার কাছ থেকেও পেত সুনীতির শিক্ষা। যান্ত্রিক সভ্যতা মানুষকে এতটাই ব্যস্ত করে তুলছে যে ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় বাবা-মা বা অভিভাবকের পক্ষে সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাদের মধ্যে সুকুমার বৃত্তির বিকাশ কাক্সিক্ষতভাবে ঘটছে না।

নীতিবিদ্যার প্রয়োজনীয়তা : নীতিবিদ্যাকে বলা হয় ‘সব বিদ্যার আধার’। এ বিদ্যা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে ক্ষেত্রেই আমাদের পদচারণ হোক না কেন সমাজ, দেশ, জাতি তথা বৃহত্তর মানবসমাজের জন্য কতটা কল্যাণ বয়ে আনবে তা প্রশ্নাতীত নয়। আগেই বলেছি, একসময় আমাদের শিশুদের পাঠ আরম্ভ হতো নীতিবাক্য অনুশীলনের মাধ্যমে। তারা পড়ত ‘সদা সত্য কথা বলিবে, কখনো মিথ্যা বলিবে না, গুরুজনকে শ্রদ্ধা করিবে’ ইত্যাদি। সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য তাদের মনে গেঁথে দেওয়া হতো। সদ্ভাবে জীবনযাপন যে একান্তই কাম্য এ বিষয়টি তারা আত্মস্থ করত অর্জিত শিক্ষার গুণে। ফলে সত্য, সুন্দর, কল্যাণের প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্ব গড়ে উঠত সহজাতভাবে। যা কিছু অসত্য, অসুন্দর, অকল্যাণকর তা থেকে দূরে থাকার মানসিকতা রপ্ত হতো। কালের বিবর্তনে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বমানের শিক্ষা প্রাপ্তির সুযোগ স্বদেশেই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। তার পরও এ শিক্ষা দেশ, জাতি ও সমাজের প্রতি দায়বোধ সৃষ্টি করতে পারছে না। জননী ও জন্মভূমি যে স্বর্গের চেয়ে সেরা এ উপলব্ধি আমাদের উদ্দীপ্ত করছে না। জন্মভূমিকে ভালোবাসা যে ইমানের অংশ এ মহতী শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হচ্ছে না আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। শিক্ষার এ সীমাবদ্ধতা আমাদের সমাজ, দেশ, জাতির কল্যাণ নিশ্চিত করতে কতটা ভূমিকা রাখছে? আমাদের চারদিকের বাস্তবতা প্রমাণ করছে নীতিবিদ্যাবর্জিত শিক্ষা যত আধুনিক হোক না কেন, সুস্থ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে না। সুনীতির অভাব অনুভূত হচ্ছে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে। আমাদের দেশ দুর্নীতিতে অতীতে বারবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এ অপমানজনক অবস্থার জন্য সুনীতির অভাব অনেকাংশে দায়ী। আমাদের যুবসমাজের একাংশের সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তের দিকে ঝুঁকে পড়ার পেছনেও নীতিবোধের ঘাটতি যে জড়িত তা সহজে অনুমেয়।

সন্দেহ নেই, এ সংকট আজ বিশ্বজনীন এক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আর এ কারণেই ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম স্কুলপর্যায়ে নীতিবিজ্ঞান পাঠ্যসূচি করার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যুবসমাজের মানসিক বিকাশ ও তাদের মধ্যে প্রেম ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণে নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তাঁর অভিমত, মূল্যবোধের শিক্ষা থেকেই কেবল একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব। যে কারণে নৈতিক শিক্ষা বিশ্বব্যাপী অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির বক্তব্য বিশ্বসমাজের চাহিদাই তুলে ধরেছে। এ আহ্বানের পর ১৬ বছর কেটে গেলেও আমাদের দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোয় নৈতিক শিক্ষার শূন্যতা রয়েই গেছে। বিশ্বে আজ যে অশান্তি ও আস্থার সংকট দানা বেঁধে উঠেছে তার পেছনেও নৈতিক শিক্ষার অভাব কাজ করছে। এ শিক্ষার অভাবে বিশ্বব্যবস্থায় নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। বড় দেশগুলো ছোট দেশগুলোকে গিলে খাওয়ার মনোভাব দেখাচ্ছে। ছোট দেশগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণে বড় দেশগুলোর যে অনুদার মনোভাব রয়েছে তার পেছনেও নৈতিক শিক্ষার ঘাটতি কাজ করছে ভাবলে ভুল হবে না। বিশ্বসমাজকে আজ অস্তিত্বের স্বার্থেই নৈতিক শিক্ষায় বলীয়ান হতে হবে। একটি আলোকিত ও সৃষ্টিশীল বিশ্বসমাজ গড়ার স্বার্থে ফিরে যেতে হবে নীতিবোধের কাছে। এ আজ সময়েরই দাবি।

                লেখক : প্রাবন্ধিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর