শনিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

নারিকেল শিল্পে আশঙ্কা না সম্ভাবনা

শাইখ সিরাজ

নারিকেল শিল্পে আশঙ্কা না সম্ভাবনা

নারিকেল গাছের প্রাচুর্যের কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপের আরেক নাম ‘নারকেল জিঞ্জিরা’। সাম্প্রতিক সময়ে নারকেল জিঞ্জিরায় নারিকেলের উচ্চ দাম নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ‘নারকেল জিঞ্জিরায় কেন ডাবের দাম বেশি হবে?’ ক্রেতাদের অভিযোগ, ৩০ থেকে ৫০ টাকার ডাবের দাম গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। চ্যানেল আইয়ের কক্সবাজার প্রতিনিধি সরওয়ার আজম মানিকের কাছে জানতে পারলাম সেন্টমার্টিনে নারিকেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ। সেখানে নারিকেল গাছের সংখ্যা আর আগের মতো নেই। ‘পাঁচ বছর আগেও পুরো দ্বীপে নারিকেল গাছ ছিল প্রায় ৮ হাজার ৭০০টি। আর এখন ৬ হাজার হবে কি না সন্দেহ!’ বলছিলেন মানিক। আরও জানালেন, সেন্টমার্টিনে এখন যে ডাব পাওয়া যাচ্ছে সেসব সেন্টমার্টিনের নয়। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে সেখানে ডাব যাচ্ছে। এসব ডাবের আকার ছোট, পানির পরিমাণও কম। যেহেতু ওখানে ডাবের চাহিদা আছে, তাই বিক্রেতারা বাইরে থেকে ডাব এনে বেশি দামে বিক্রি করছেন। সেন্টমার্টিনের ডাব মানেই পানি বেশি, মিষ্টতা বেশি। এক ডাবে কম করে হলেও তিন গ্লাস পানি হয়। অনেকেই বলেন, সেন্টমার্টিনে গিয়ে সেখানকার ডাব না খেয়ে ফেরার কোনো অর্থ নেই। ধীরে ধীরে কমে আসছে সেখানকার নারিকেল গাছের সংখ্যা। অথচ বিষয়টা উল্টো হওয়ারই কথা ছিল। যেহেতু সেন্টমার্টিনের ডাবের গুণগত মান ভালো, চাহিদাও বেশি। সেখানে নারিকেল গাছের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হতে পারত। কিন্তু হয়নি। কারণ, আমরা ভবিষ্যতের কথা ভাবছি না, বর্তমানের লাভ নিয়েই মেতে থাকতে গিয়ে লোকসানে পড়ে যাচ্ছি।

এই শীতেও ঢাকায় একটা ডাব কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। শীতে সাধারণত ডাবের চাহিদা কম থাকে। দামও কমে। কিন্তু এবার দাম কমতে দেখছি না। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, বাংলাদেশের নারিকেলের রাজধানী-খ্যাত বাগেরহাটে নারিকেল বা ডাবের ফলন কমে গেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে জেলায় ৩ হাজার ৬১৯ হেক্টর জমিতে নারিকেল গাছের আবাদ হয়েছে। এ অর্থবছরে জেলায় নারিকেলের উৎপাদন হয়েছে ৩০ হাজার ৯৩৬ মেট্রিক টন। কৃষি বিভাগ বলছে, নারিকেলের উৎপাদন কমেছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ।

মাস তিনেক আগে বাগেরহাট থেকে এক কৃষক ফোন করে জানিয়েছিলেন, তার পুকুরপাড়ে লাগানো সারি সারি নারিকেল গাছের পাতায় হোয়াইটফ্লাই ও শূতিমূলের আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ওষুধ প্রয়োগেও এ রোগ কমছে না। শুধু ওই কৃষকের নারিকেল গাছেই নয়, বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকায় নারিকেল গাছে এমন রোগ দেখা গেছে। ফলে নারিকেলের উৎপাদন কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। এর প্রভাব পড়েছে বাগেরহাটে নারিকেল তেলের কারখানাগুলোতেও। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি- আগে বাগেরহাটে ৪০টির মতো তেলের মিল থাকলেও নারিকেলের ফলন কমে যাওয়াসহ নানা কারণে এখন পাঁচটির মতো কারখানা টিকে আছে। পোকার আক্রমণে নারিকেলের ফলন কমে যাওয়ায় দাম বৃদ্ধি ও আকারে অনেক ছোট হওয়ার কারণে মালিকদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব হচ্ছে না।

নারিকেলের জন্য বিখ্যাত এশিয়ার বিভিন্ন দেশ : ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস, শ্রীলঙ্কা, ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড; সেসব দেশে নারিকেলের জাত উন্নয়নের পাশাপাশি নারিকেলের উৎপাদন বাড়ছে। বাড়ছে নারিকেল দিয়ে উৎপাদিত বিভিন্ন খাদ্য উপকরণও। নারিকেল শিল্পের প্রভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে তাদের অর্থনীতি। অথচ আমাদের বিশাল এক উপকূলীয় অঞ্চল থাকা সত্ত্বেও আমরা আমাদের নারিকেল শিল্পে এগোতে পারছি না। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা নারিকেল নিয়ে কী ভাবছি? আমাদের গবেষণা কতদূর? মনে আছে বছর দশ-বারো আগে বরিশালের রহমতপুরে নারিকেল গবেষণা কেন্দ্রের কার্যক্রম দেখতে গিয়েছিলাম। ১২৯ একর জায়গায় নারিকেল গাছ পরিবেষ্টিত অপরূপ ছায়াঘেরা এক স্থান। তখনকার কর্মরত প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও প্রকল্প না থাকায় গবেষণার কাজ অগ্রসর হচ্ছে না। পরবর্তীতে অগ্রসর দূরে থাক নারিকেল গবেষণা কেন্দ্রটিই বিলুপ্ত হয়ে যায়। এখন সেটি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র। সেখানে নানান ফল-ফসল নিয়ে গবেষণা চলছে। এত বছর পরও আমরা উচ্চ ফলনশীল নিজস্ব কোনো জাত উন্নয়ন করতে পারিনি। উচ্চ ফলনশীল জাত হিসেবে নির্বাচন করতে হয়েছে ভিয়েতনাম থেকে আনা একটি জাতকে। অথচ আমাদের পার্শ¦বর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা কিংবা মিয়ানমার স্ব স্ব নারিকেল গবেষণা কেন্দ্রে বিস্তর গবেষণা করছে। পরিবর্তিত জলবায়ু ও আবহাওয়া সহনশীল উচ্চ ফলনশীল নারিকেলের জাত উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বছর কয়েক আগে দেশে ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেল নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে কৃষি বিভাগের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প। আমাদের দেশে নারিকেলের যেসব জাতের প্রচলন আছে সেগুলো হচ্ছে লম্বা জাতের। বছরে ৫০-৬০টি ফল পাওয়া যায় এবং ফলন পেতে স্বাভাবিকভাবে সাত থেকে আট বছর সময় লেগে যায়। কৃষি বিভাগ বলছে, ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেল তিন বছরের মাথায় নারিকেলের গাছের উচ্চতা হবে দুই থেকে আড়াই ফুট। যথাযথ পরিচর্যা করলে ২.৫ থেকে তিন বছরের মধ্যে ফুল আসা শুরু হবে। বছরে তিন থেকে চারবার গাছে ফুল আসবে। ফলনের পরিমাণ আমাদের দেশীয় জাতের থেকে প্রায় তিন গুণ। প্রতি বছর প্রায় ২০০টি নারিকেল পাওয়া যাবে। একটি গাছ বাঁচবে ২০ থেকে ২৫ বছর। দুই জাতের নারিকেল গাছ লাগানো হয়েছে। একটি হচ্ছে সিয়াম গ্রিন কোকোনাট। এ জাতের ডাবের রং কিছুটা সবুজ, আকারে ছোট, প্রতিটির ওজন ১.২-১.৫ কেজি। এ জাতের ডাবে ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিলিটার পানীয় পাওয়া যাবে। বছরে প্রতি গাছে ফল ধরবে ১৫০-২০০টি। অন্য জাতটি হচ্ছে সিয়াম ব্লু কোকোনাট। এ জাতের ফলের রং হলুদ, প্রতিটির ওজন হবে ১.২-১.৫ কেজি, ডাবে পানির পরিমাণ হবে ২৫০-৩০০ মিলি। ডাবের পানি হবে খুব মিষ্টি এবং শেলফ লাইফ বেশি হওয়ায় এ জাতের ডাব বিদেশে রপ্তানি করা সহজ হবে। বছরে প্রতি গাছে ফল ধরবে ১৫০-২০০টি। কিন্তু বছর তিনেক পর এসে ভিয়েতনামি নারিকেল নিয়ে কৃষকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখেছি। কেউ কেউ হতাশ হয়েছেন। তাদের অভিযোগ- তিন বছরেও ফুল আসেনি। পাতায় অজানা রোগের আক্রমণে গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। আবার তিন বছরেই ফলন এসেছে এবং এ নারিকেল নিয়ে আশাবাদী এমন কৃষকও পেয়েছি। এ ব্যাপারে কথা বলি প্রকল্প পরিচালক মেহেদী মাসুদ সাহেবের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনামি নারিকেল বিশেষ পরিচর্যার দাবি করে। আমাদের দেশি জাতের নারিকেল গাছ লাগিয়ে তেমন পরিচর্যা না করলেও হয়। কিন্তু উচ্চ ফলনশীল জাতের ফল-ফসল চাষে যেমন যত্ন নিতে হয়, ঠিক তেমনি ভালো ফলন পেতে যত্ন নিতে হবে ভিয়েতনামি নারিকেল গাছেরও।’ তিনি জাতীয় সংসদ এলাকায় রোপণ করা ভিয়েতনামি নারিকেল গাছের কাছে আমাকে নিয়ে যান। দেখলাম ছোট্ট গাছগুলোতে ভালোই ফলন এসেছে। মিষ্টতা ও পানির পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখালেন। যেমনটি বলেছিলেন তেমনটিই পাওয়া গেল। কিন্তু গাছের পাতার ওপর দিকটায় কালো দাগ ও নিচের দিকে সাদাটে পোকার আক্রমণ লক্ষ্য করলাম। মেহেদী মাসুদ জানালেন, ‘এগুলো এক ধরনের হোয়াইটফ্লাই এর আক্রমণ। একটু যত্নবান ও সতর্ক হলে এ রোগ থেকে নারিকেল গাছকে রক্ষা করা কঠিন কিছু নয়।’

ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেল আমাদের জন্য কতটুকু ভালো হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে নিজস্ব জাত উন্নয়নে আমাদের উদাসীনতার চরম মূল্য দিতে হতে পারে। করোনার এই সময়ে নারিকেলের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হওয়ায় গত দুই বছর ব্যাপক ডাব বিক্রি হয়েছে, দামও ভালো পাওয়া গেছে। দাম বেশি পাওয়ার আশায় অপরিণত ডাব বিক্রি হয়েছে। এ কারণে বীজ তৈরি করা হয়নি। নার্সারিগুলোতে নারিকেল গাছের চারা উৎপাদন হয়েছে কম। তার মানে গত দুই বছর নতুন গাছ রোপণ হয়েছে আশঙ্কাজনক হারে কম। এটি আমাদের নারিকেল শিল্পের জন্য ভালো কথা নয়। নারিকেল নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। সম্ভাবনার সুপরিকল্পিত বীজ বুনতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলো যদি নারিকেলকে ঘিরে শক্তিশালী বলয় গড়তে পারে, আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নারিকেলকে ঘিরে গাঁথা হোক অর্থনীতির নতুন মালা। নারিকেল গাছের কোনো অংশই ফেলনা নয়। সবকিছুকেই রূপান্তর করা যায় শিল্পপণ্যে। সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে পারলে এটিই হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অনন্য খাত।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর