বুধবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

দুধ উৎপাদনে আমাদের অভিযাত্রা

ড. মো. গোলাম রব্বানী

দুধ একটি আদর্শ খাবার। আমরা যতগুলো পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাই তার মধ্যে দুধের উপকারিতা সবচেয়ে বেশি। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও আমিষের চাহিদা পূরণে এর বিকল্প নেই। আবার দামেও সস্তা, পাওয়াও যায় সহজে। করোনাভাইরাস মহামারি-কালে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে দুধ ও দুধজাতীয় খাবারের সমতুল্য আর কী হতে পারে! আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে দুধের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা ও সহজলভ্যতার বিষয়টি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা ভারতীয় এক যুবক। তিনি ড. ভার্গিস কুরিয়েন। তাঁর নিষ্ঠা, গবেষণা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশটি পৃথিবীর মধ্যে এক নম্বর দুধ উৎপাদনকারী দেশের মর্যাদা লাভ করে। ভারতের ‘মিল্কম্যান’-খ্যাত ড. ভার্গিস কুরিয়েন ১৯২১ সালের ২৬ নভেম্বর কোজিকোডের একটি সমৃদ্ধ খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা পুতেনপাড়কল কুরিয়েন ছিলেন ব্রিটিশ কোচিনের সিভিল সার্জন। ভার্গিস কুরিয়েন মাদ্রাজের লয়োলা কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিস্টিংশনসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

পড়াশোনা শেষে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং সরকারি চাকরি নিয়ে ১৯৪৯ সালের ১৩ মে গুজরাটের কয়রা জেলার আনন্দ অঞ্চলে চলে যান। সেখানে তিনি দেখতে পান ‘পেস্টনজি এডুলজি’ নামে পরিচিত চতুর ব্যবসায়ীদের দ্বারা দুধ উৎপাদনকারী কৃষক ভীষণভাবে শোষিত হচ্ছে। এ ‘পেস্টনজি এডুলজি’ নামক প্রতিষ্ঠানটি সে সময় পোলসন মাখন বাজারজাত করত। কৃষকের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে তাদের নেতা ত্রিভুবন দাস প্যাটেল তখন কৃষককে ঐক্যবদ্ধ করে পেস্টনজির শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। ত্রিভুবন দাস প্যাটেলের ব্যক্তিত্ব দ্বারা ড. কুরিয়েন বিমোহিত হন এবং সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্যাটেলের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা যৌথভাবে কয়রা জেলা সমবায় দুধ উৎপাদনকারী ইউনিয়ন লিমিটেড (কেডিসিএমপিইউএল) নামে নিবন্ধন নিয়ে ডেইরি খামারিদের ভাগ্যোন্নয়নের আন্দোলন শুরু করেন, যা পরবর্তীকালে ‘আমূল’ নামে সারা বিশে^ পরিচিতি পায়। আর এভাবেই ভারত বিশ্বসেরা দুধ উৎপাদনকারী দেশের মর্যাদা লাভের অভিযাত্রা শুরু করে। ড. কুরিয়েন মি. প্যাটেলকে সঙ্গে নিয়ে যে সমবায় আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সেখানে সমবায়ীদের ভূমিকা ছিল খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ ও দুধের গুণমান অনুযায়ী তাদের যথাযথ মূল্য প্রদান করা। ১৯৬৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল আমূলের আওতায় দুগ্ধবতী গাভির ফিডিং পদ্ধতির নতুন প্রযুক্তি উদ্বোধনের জন্য। দিন শেষে তাঁর ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আনন্দে পৌঁছে সমবায়ী খামারিদের সাফল্যের চিত্র দেখে বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য থেকে গিয়েছিলেন। আমূলের খামারিদের সঙ্গে দুধের আদ্যোপান্ত নিয়ে করা শুটিং দেখে এবং খামারিদের সঙ্গে মতবিনিময় করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিতে ড. কুরিয়েনের ভূমিকা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। দিল্লিতে ফিরে শাস্ত্রী ড. কুরিয়েনকে তাঁর ডেইরি মডেল বা আনন্দ প্যাটার্নটি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে অনুরোধ করেন।

ড. কুরিয়েন শুরু করেন ‘অপারেশন ফ্লাড’ বা শে^তবিপ্লব। সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে ১৯৬৫ সালে গুজরাটে ভারতের জাতীয় দুধ উন্নয়ন বোর্ড (এনডিডিবি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ড. কুরিয়েন এনডিডিবির দায়িত্ব নেন এবং আনন্দ প্যাটার্ন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে দেন। এ সম্প্রসারণের ফলে সারা দেশে দুধের সরবরাহ দ্রুত বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে গুঁড়া দুধ তৈরি, দুগ্ধপণ্য বহুমুখীকরণ, পশুপুষ্টি, পশুস্বাস্থ্য ও রোগপ্রতিরোধে ভ্যাকসিন ব্যবস্থার উন্নয়নেও হাত দেওয়া হয়। ভারতের পাশাপাশি বিদেশেও আমূল পণ্য ব্র্যান্ড হিসেবে বিক্রির জন্য আমূলের অধীন একটি পৃথক বিপণন ইউনিট সৃষ্টি করা হয়। সাফল্যের দীর্ঘ্য পথ পরিক্রমায় আমূল বর্তমানে দেড় কোটি ডেইরি খামারিকে নিয়ে সারা দেশে ১ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬টি দুগ্ধ সমবায় সমিতি পরিচালনা করছে এবং ভারত আজ বিশ্বে বৃহত্তম দুধ উৎপাদনকারী দেশের মর্যাদায় আসীন।

কৃষিপ্রধান জনবহুল বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা, সুষম পুষ্টি, বেকার সমস্যা সমাধান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কৃষিজমির উর্বরতা ধরে রাখা, নারীর ক্ষমতায়ন ও স্মৃতিশক্তি বিকশিত একটি মেধাবী জাতি গঠনের জন্য অনন্য সম্ভাবনার ক্ষেত্র হলো প্রাণিসম্পদ খাত। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ছিল ১.৪৪ শতাংশ ও প্রবৃদ্ধির হার ৩.৮০ শতাংশ। মোট কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান প্রায় ১৩.১০ ভাগ। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ খাতে জিডিপির আকার ছিল ৫০ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। (সূত্র : বিবিএস ২০২০-২১)।

বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে। অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের জন্য এটি একটি ফ্লাগশিপ প্রজেক্ট, যেখানে মোট বিনিয়োগ প্রায় ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এজন্য সরকার বিশ্বব্যাংক থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা গ্রহণ করেছে, যা দেশের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়নে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ। প্রাণিসম্পদ খাতে যুগোপযোগী পরিবর্তন আনয়নের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে খামার ও পশু নিবন্ধন, সব খামার, খামারি ও পশুর ডাটাবেজ তৈরি ও তার আইনি ভিত্তি রচনা, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও খামার যান্ত্রিকীকরণ, বিশেষ করে উৎপাদন খরচ কমাতে পশুখাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনয়ন, পশুরোগ প্রতিরোধী গুরুত্বপূর্ণ সব টিকা উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন ও টিকা প্রদান কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ খাত প্রাইভেট সেক্টর পরিবেষ্টিত একটি খাত, তাই পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে এ খাতের দ্রুত উন্নতি সম্ভব।

লেখক : প্রধান কারিগরি সমন্বয়ক প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর