বৃহস্পতিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বিজেপি নির্বাচনে হারতে চলেছে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বিজেপি নির্বাচনে হারতে চলেছে

ভারতের যে পাঁচটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচন পর্ব শুরু হয়েছে তার গতি-প্রকৃতি দেখে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এটি হচ্ছে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের সেমিফাইনাল। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করছেন পাঁচ রাজ্যের মধ্যে উত্তর প্রদেশে যদি বিজেপি হেরে যায় (যার সম্ভাবনা খুব বেশি), তাহলে ২০২৪ সালে তাদের পক্ষে দিল্লি দখল আর সম্ভব হবে না। এ আশঙ্কায় মোদি এবং তাঁর দোসর অমিত শাহ, সঙ্গে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বিভিন্ন জনসভায় তাঁদের বক্তব্যে তুলে ধরছেন হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের কথা। সাত বছর ধরে মোদি সরকার গো-মাংস থেকে শুরু করে নানা কৌশলে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের রাজনীতিতে জোর দিচ্ছে। সারা দেশের মোট ৫৪২ লোকসভা আসনের মধ্যে উত্তর প্রদেশে সবচেয়ে বেশি, ৮০টি। করোনা আবহে ভারতের নির্বাচন কমিশন ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকাশ্য প্রচার বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করে। পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হবে ১০ মার্চ। সেদিনই বোঝা যাবে যোগীরাজ বহাল থাকবে নাকি সমাজবাদী পার্টি ও লোকজনশক্তি পার্টির জোট ক্ষমতাসীন হবে লখনৌর তখতে। উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে কংগ্রেসও পিছিয়ে নেই। কংগ্রেসের উত্তর প্রদেশের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, ইন্দিরা গান্ধীর নাতনি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ইতোমধ্যে ঘোষণা করে মনোনয়নপত্র দেওয়ার কাজও শুরু করেছেন। কংগ্রেস সে রাজ্যের ৪০৩ আসনের মধ্যে ৪০ শতাংশ মহিলা প্রার্থী দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে প্রতিটি বাড়ি থেকে একজন করে বেকার যুবক-যুবতীকে সরকারি চাকরি দেবে বলে ঘোষণা করেছেন প্রিয়াঙ্কা। সোনিয়া-তনয়া আরও ঘোষণা করেছেন, উত্তর প্রদেশে যে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে, ক্ষমতায় এলে তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রত্যেককে ল্যাপটপ দেওয়া হবে। এ প্রক্রিয়া ভবিষ্যতেও চলবে। এ ছাড়া দেড়-দুই বছর ধরে কৃষক যেসব দাবিতে আন্দোলন করে আসছে তাদের সেসব দাবি পূরণ করা হবে ক্ষমতায় আসার তিন সপ্তাহের মধ্যে। বাড়ির মহিলাদের জন্য প্রতি দুই মাস অন্তর একটি করে ১৪ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে প্রতি বাড়িতে সেলাই মেশিন দেওয়া হবে। চালু হবে সেলাইয়ের স্কুল।

উত্তর প্রদেশ ছাড়া বাকি চার রাজ্যের মধ্যে একটি হলো উত্তরাখণ্ড। সেখানে বিধানসভা আসন ৮০টির মতো। তার পরে পাঞ্জাব। কংগ্রেস-শাসিত এ রাজ্যের আসন সংখ্যা ১১৭। মণিপুরেও আছে প্রায় ৭০টি আসন। আর রয়েছে ৪০ আসন-বিশিষ্ট অঙ্গরাজ্য গোয়া। পাঁচ বছর আগে এ চার রাজ্যের চারটিতেই ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই কংগ্রেসের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কিনে নিয়ে তিনটি রাজ্য- উত্তরাখণ্ড, মণিপুর ও গোয়ায় সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে ক্ষমতা দখল করে বিজেপি। শুধু পাঞ্জাবে বিজেপি এ কাজ করতে সফল হয়নি। সেখানে এখনো ক্ষমতাসীন কংগ্রেস। মজার কথা হলো, যে গোয়ায় কংগ্রেস থেকে অন্যায়ভাবে লোক কিনে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি, সেই গোয়ায় এবার একই কাজ শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। মমতা ব্যানার্জির নির্বাচন কুশলী প্রশান্ত কিশোর সম্প্রতি এক টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মমতার অনুরোধেই তিনি গোয়া, মেঘালয় ও মণিপুরে অন্যান্য দল থেকে লোক ভাগিয়ে তৃণমূলে আনার কাজ করেছেন। গোয়ায় কংগ্রেসের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফেলেইরোকেও দলে টেনেছে তৃণমূল। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজনকে ভাগিয়ে নিয়েছে। অবশ্য এর মধ্যে পাঁচজন আবার তৃণমূল ছেড়ে পুরনো দলে ফিরেছেন। টিভি সাক্ষাৎকারে প্রশান্ত কিশোর আরও জানিয়েছেন, তিনি নিজে তৃণমূল-সঙ্গ ত্যাগ করে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, আগামী লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস-জোট ক্ষমতায় এলে তাঁকে উপপ্রধানমন্ত্রী করতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে স্বরাষ্ট্র বা অর্থের মতো মন্ত্রক। শুধু তাই নয়, তিনি কংগ্রেসের সিনিয়র মোস্ট ভাইস প্রেসিডেন্টের পদও দাবি করেছিলেন। তাঁর সে দাবি কংগ্রেস মানেনি বলেই তিনি কংগ্রেসে যাননি বলে জানিয়েছেন প্রশান্ত। টিভি সঞ্চালক তাঁকে প্রশ্ন করেন, মমতার তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর ২০২৪ সাল পর্যন্ত চুক্তি, তাহলে তিনি তার আগে কংগ্রেসে যেতে চাইলেন কী করে? উত্তরে প্রশান্তর যুক্তি হলো- তাঁর কোম্পানি আইপ্যাকের সঙ্গে তৃণমূলের চুক্তি হয়েছিল। সে কোম্পানি আর নেই, তাই তাঁরও কোনো দায় নেই। প্রসঙ্গত, এই প্রশান্ত কিশোর বরাবরই সুবিধাবাদী। ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার পর ২০০৪-এর গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে মোদির হয়ে কাজ করেন তিনি এবং সেই ভয়ংকর দাঙ্গার পরও বিজেপিকে সে রাজ্যে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। সে সময় মোদির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা সারা দেশই জানত।

উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে জাতপাতের খেলা এক বড় রাজনৈতিক কৌশল। সে রাজ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, দলিত ইত্যাদি ১৬-১৭ রকমের সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। কিন্তু সেখানে সবচেয়ে বড় ‘ফ্যাক্টর’ হলেন জাঠেরা। গত দেড় বছরের কৃষক আন্দোলনে জাঠেরা এক বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। এখন মোদি এবং তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি অমিত শাহের প্রধান লক্ষ্য হলো এ জাঠ ভোট ধরে রাখা। এজন্য অমিত শাহ এতটাই মরিয়া যে লোকজনশক্তি পার্টিকে এমন কথাও বলেছেন, নির্বাচনের পর তারা বিজেপির সঙ্গে আসুক। এ কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, যদি কোনো কারণে জাঠ ভোট বিজেপি না পায় তাহলে যাতে সে ভোটের সুফল বিজেপি পেতে পারে। অর্থাৎ বিজেপি হয়তো বুঝতে পেরেছে, আসন্ন নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে বিজেপির অবস্থা খুব ভালো নয়।

অবশ্য জাঠ ভোট পাওয়ার আশা এখনই ছাড়ছে না পদ্ম-শিবির। এ ভোট ফেরাতে হিন্দু মেরুকরণের তাস খেলতে শুরু করেছে তারা। ২৯ জানুয়ারি পশ্চিম উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগরে গিয়ে অমিত শাহ সমাজবাদী পার্টির মুসলিম ও রাষ্ট্রীয় লোকদলের জাঠ ভোটের মধ্যে বিভাজনের কৌশল নেন। ২০১৩ সালে সমাজবাদী পার্টির শাসনের সময় হওয়া জাঠ মুসলিম সংঘর্ষের কথা মনে করিয়ে দেন তিনি। বলেন, একটি ভুল আবার সেই দাঙ্গাকারীদের ফিরিয়ে আনতে পারে। অমিত শাহের পরে মোদি নামছেন আসরে। জাঠ তথা কৃষক সমাজের মন জয় করতে পশ্চিম উত্তর প্রদেশে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে প্রচার করবেন তিনি। অবশ্য এসব সত্ত্বেও যোগী আদিত্যনাথের সরকার উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় ফিরবে কি না বলা কঠিন। তাঁর আমলে হাথরস, উন্নাও দেখেছে গোটা দেশ তথা বিশ্ব। করোনার সময় রোগীদের মেরে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে ছবিও দেখেছে গোটা বিশ্ব। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে তাই লিখতে শুরু করেছেন আসন্ন নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে বিজেপির চিন্তা ও উদ্বেগের কথা নিয়ে। সব মিলিয়ে যা পরিস্থিতি তাতে ২০২৪ সামনে রেখে দেশের মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে- ২০২২-এর বিধানসভা নির্বাচনই বিজেপির শেষের শুরু নয় তো?

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক [ভারত]।

সর্বশেষ খবর