শিরোনাম
সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

একুশের দেখানো পথেই বাংলাদেশকে চলতে হবে

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

একুশের দেখানো পথেই বাংলাদেশকে চলতে হবে

একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর যথাযথ মর্যাদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলও আলাদাভাবে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। তবে জামায়াত ও জামায়াতবদ্ধ দলগুলোর কথা ভিন্ন। পাকিস্তানি পাঞ্জাবিদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে ভাষার দাবি সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে ১৯৫৬ সালে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বহু দেশে দিবসটি মর্যাদাসহকারে পালিত হয়। অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এখন বহু ভাষায় গীত হয়। বাংলা ভাষা রক্ষা পাওয়ায় বাঙালি সংস্কৃতি বেঁচে যায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২, ১৯৫৪ হয়ে ষাট দশকের মধ্যভাগে ছয় দফা, তারপর গণঅভ্যুত্থান এবং চূড়ান্ত পর্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বাঙালি সংস্কৃতির সহজাত শক্তির জাগরণের পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে এবং বাংলাদেশের রক্ষাকবচও এখানেই নিহিত। এটা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীও ভালো করে জানত এবং বুঝত। সে জন্য রবীন্দ্রনাথের ওপর তাদের এত রাগ। বাঙালি সংস্কৃতির ওপর ক্ষুব্ধ পাকিস্তান সেনাবাহিনী একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে আক্রমণের শুরুতেই কামান দেগে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছিল। একই কারণে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে একাত্তরে পাকিস্তানের সহযোগী একজন মন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তি বলেছিলেন, আরেক দেশের এক হিন্দুর গান ধার করে কেন জাতীয় সংগীত করা হবে। বাংলার মাটি ও মানুষের জাগরণের প্রতীক লাল-সবুজের পতাকাকে নির্দেশ করে বলেছিলেন, এটা আমার ভালো লাগে না। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর আমরা ঘটা করে পালন করি, এটা করতে হবে। কিন্তু এটা কি শুধুই পোশাকি আনুষ্ঠানিকতা। প্রশ্নটি উঠেছে। কারণ, একুশ আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতির জন্য যে শিক্ষা দেয় এবং যে পথ দেখায় তার কতটুকু স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি? এর সঠিক হিসাব-কিতাব না থাকলে জাতি হিসেবে পথ হারানোর শঙ্কা থাকে। আমরা সবার মুখে অন্তত স্বীকার করি একুশের পথ ধরেই আমাদের স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু একুশের শেকড় বাঙালি সংস্কৃতির অনিবার্র্যতা অসাম্প্রদায়িক সেকুলার আদর্শ আজ বাংলাদেশের শতকরা কতভাগ মানুষ মনেপ্রাণে ধারণ করছে, সেটাই ভাবনার বিষয়। সবকিছুর মধ্যে আমরা ধর্মকে টেনে আনছি। একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ খারাপ কাজ করলে তার ধর্মকে দোষারোপ করছি। কিন্তু একবারও ভাবছি না সব ধর্মের মধ্যেই খারাপ লোক আছে। এটা ধর্মের দোষ নয়, ওটা ওই ব্যক্তির দোষ। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এসে বাংলাদেশের মানুষ মনমানসিকতা একাত্তর-বাহাত্তরের তুলনায় কি অধিকতর সাম্প্রদায়িক হয়নি? সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে তাহলে দিবস পালন কি শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে? মানুষের মনোজগৎ যদি একুশের পথে না থাকে তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্য একদিন না একদিন মহাবিপদ ডেকে আনবে। বাহাত্তরে সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সব অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে বাংলাদেশকে রক্ষা করা যাবে না। ধর্মের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। ধর্ম সবসময় সব মানুষের জন্য উত্তম কথা বলে। কিন্তু ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে, রুজি-রোজগারের অবলম্বন এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের বাহন যারা মনে করে তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ধর্মের অপব্যবহার করবে সেটাই স্বাভাবিক। পাকিস্তানি শাসনের ২৩ বছর সেটাই আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি। তিক্ত অভিজ্ঞতার সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা। মৌলিক প্রত্যাশা ছিল ধর্মীয় বিদ্বেষমুক্ত রাষ্ট্র হবে বাংলাদেশ। রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্ম, বর্ণ, নারী পুরুষ, জাতি, উপজাতির মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকবে না। এটাই একুশ এবং বাঙালি সংস্কৃতির মৌলিক শিক্ষা। এই লক্ষ্য অর্জনে গত ৫০ বছরে আমরা কি সামনের দিকে এগিয়েছি, নাকি আরও পিছনের দিকে চলে গেছি? আমার মনে হয় এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও নিরাপত্তার জন্য দেশের ভিতর থেকে এখন সবচেয়ে বড় হুমকি ধর্মীয় উগ্রবাদ, যার শিকড়ে রয়েছে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি। বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ক্ষমতায় আসা নতুন শাসকদের হাত ধরে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসে। সেই পথ ধরেই সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সর্বত্র সাম্প্রদায়িক অপআদর্শের বিস্তার ঘটেছে। স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরের মাথায় এসে এখনো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আর কতদিন এই সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে বিপ্লবের প্রতীক মাও সেতুং অনবরত বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন, বিপ্লবের পরে সব সময়ই একটা প্রতিবিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির জন্ম হয়। তাই তাদের অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করার জন্য শুধু মনে মনে আদর্শ ধারণ করলেই চলবে না, আক্ষরিক অর্থে বিপ্লবী কার্যক্রম রাষ্ট্রের সর্বত্র জারি রাখা দরকার। ১৯৬৫ সালে কালচারাল রেভিউলেশনের প্রাক্কালে মাও সেতুংয়ের একটা বিখ্যাত উক্তি হেনরি কিসিঞ্জার তার বিখ্যাত রচনা, হেনরি কিসিঞ্জার অন চায়না গ্রন্থের ৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, যার বাংলা অনুবাদ, মানুষের চিন্তা, সংস্কৃতি ও অভ্যাস সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম হয় এবং পূর্বের বিপজ্জনক সংস্কৃতি ফিরে আসার আশঙ্কা যতদিন থাকবে ততদিন সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। অর্থাৎ, মাও সেতুংয়ের সংগ্রামী দর্শন অনুসারে যেহেতু বাংলাদেশে এখনো পূর্বের পরিত্যক্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের সংস্কৃতি ফিরে আসার শঙ্কা আছে, তাই একুশের দর্শনকে রাষ্ট্র সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, একুশ, অর্থাৎ বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার জায়গা ১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রমশই সংকুচিত করা হয়েছে। সব পর্যায়ের শিক্ষাঙ্গন এবং শহর থেকে গ্রামের সর্বত্রই তার প্রতিফলন এখনো দেখা যায়। পঁচাত্তরের পর এই যে পশ্চাদপসারণ শুরু হয়েছে তার লাগাম এখনো কেউ টেনে ধরতে পারছে না। করোনার মহামারিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে কয়েক দিন আগে একুশের চেতনা বহিঃপ্রকাশের অন্যতম অনুষঙ্গ বইমেলা ঢাকাতে শুরু হয়েছে। বইমেলা এখন আর শুধু বই কেনা-বেচার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উৎসব। খবরে দেখলাম ডিএমপি কর্তৃপক্ষ সব রকমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পুলিশ আছে, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা আছে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আছে। এক বিবেচনায় এটা খুব ভালো যে, যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। পুলিশের দায়িত্ব পুলিশ যত্নসহকারে পালন করছে, সতর্ক ও সচেতন আছে। কিন্তু অন্য বিবেচনায় মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। যে মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করলাম তার উৎসব পালন করার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশি পাহারার প্রয়োজন হবে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানি। তবে আশার কথা এই, বাংলাদেশের বিশাল তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উপলব্ধি তৈরি হচ্ছে এই মর্মে যে, তাদের প্রত্যেকের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত রাখতে হলে উদার গণতান্ত্রিক সেকুলার বাংলাদেশের কোনো বিকল্প নেই। ছোট আয়তনের বাংলাদেশ, যার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। আগামী কয়েক বছরে এই জনসংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। তখন বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম যাতে অবাধে বিচরণ করতে পারে তার জন্য ধর্মান্ধতা, পশ্চাদপদতায়পূর্ণ মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা থেকে সবার মনমানসিকতাকে মুক্ত রাখতে হবে। ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকা, যারাই উন্নতির শেখরে উঠেছে তাদের মূলমন্ত্রই ছিল, যুক্তিই হবে সবকিছুর নির্ধারক, অন্ধ বিশ্বাস নয়। একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং বাঙালি সংস্কৃতির মৌলিক কথাই হচ্ছে বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র হবে যুক্তিনির্ভর এবং বহুত্ববাদের ধারক ও বাহক। এক সময়ে রাষ্ট্রের শাসকরাই বাংলাদেশকে পিছনের দিকে টেনে নিতে থাকায় তখন বিশ্বের বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া হাউস থেকে বলা হচ্ছিল, বাংলাদেশ হবে পরবর্তী আফগানিস্তান। কিন্তু বিগত ১২ বছরের অব্যাহত প্রচেষ্টায় সেই অপবাদ থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হতে পেরেছে। সুতরাং একুশের দেখানো পথে বাংলাদেশের চলমান যাত্রা অব্যাহত থাকলে সব আশঙ্কা আর চ্যালেঞ্জকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশ একদিন আধুনিক সমৃদ্ধশালী দেশ হবে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর