মঙ্গলবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ

অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার

জাতির পিতা বারবার যে কথাটি বলে গেছেন তা হলো, মানসস্মত শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। তাই তিনি শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শিক্ষার দ্বার সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ংংবৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কেউ লেখাপড়া করে কাজ করবে, আবার কেউ লেখাপড়া না করেই কাজে যোগ দেবে- এ ধরনের নীতিতে জাতির পিতা বিশ্বাসী ছিলেন না। যেন ধনী-গরিবের সন্তানের জন্য আলাদা পাঠ্যক্রম বা আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না হয় সে ব্যাপারে তিনি সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে ৯৩ হাজার পাক হানাদারের আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের এ-দেশি কিছু কুলাঙ্গার (রাজাকার, আলবদর, আলশামস) বাংলার অধিকাংশ ব্রিজ-কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছিল, অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ধ্বংস করেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে এসব পুনর্নির্মাণে ব্যাপক টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন। সদ্যস্বাধীন দেশে মানুষের পকেটে টাকা নেই, রাজস্ব নেই, কৃষি খাতে উন্নয়ন দরকার, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি। কিন্তু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, শিক্ষাই হচ্ছে জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের মূল শক্তি। তাই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটেই শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়েছিলেন। কারণ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাঙালিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদার আসনে দাঁড় করানো। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাংলায় দেওয়া ভাষণে দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি তৃতীয় বিশ্বের শোষিত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কিছু কথা বলতে চাই।’ তাঁর এ বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় কতটা নেতৃত্বগুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। শিক্ষা খাতে বঙ্গবন্ধুর সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল মানসম্মত শিক্ষায় রুচিশীল জাতি হিসেবে বাঙালিকে প্রতিষ্ঠিত করা। জাতির পিতা তাৎক্ষণিক লাভের চিন্তা করতেন না। তিনি সুদূরপ্রসারী সুফল লাভের জন্য বিনিয়োগে বিশ্বাসী ছিলেন। আর তাই শিক্ষা খাত ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। রক্ত কথা বলে। জাতির পিতার রক্তের সুযোগ্য উত্তরাধিকার, টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। পিছিয়ে পড়া নারীসমাজকে শিক্ষার মূলধারায় যুক্ত করতে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। ১ জানুয়ারি বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দিয়ে তিনি যে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তা বিশ্বের অনেক দেশের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। একসময় এ দেশে শিক্ষার্থীদের টাকা দিয়ে বাজার থেকে বই কিনতে হতো। সেটা আবার জানুয়ারি নয়, বই পাওয়ার জন্য জুন-জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিয়েছেন, বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের বই তুলে দিয়ে উৎসব করা যায়, জাতির নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে নতুন বইয়ের গন্ধের স্বাদ দিয়ে তাদের টেবিলমুখী করা যায়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায়ও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার বড় সাফল্য তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা। ভাবলে হৃদয় জুড়িয়ে যায়, আমাদের দেশ থেকে ডাক্তারি পাস করা একজন প্রবাসী ছাত্র আজ ভুটানের সরকারপ্রধান।

চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৫ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ বরাদ্দ ৭১ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। দুই মন্ত্রণালয় মিলে ৫ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ বেড়েছে। আগের বছরের তুলনায় শতাংশের হিসাবে শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে দশমিক ৫ শতাংশ। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে (২০২০-২১) ছিল ৩৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষার জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০২০-২১) এ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা আজ ডিজিটাল হয়ে গেছে বহুলাংশে। এটা আমাদের বড় অর্জন। করোনার সময় দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকেনি। ভার্চুয়ালি জুমের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্লাস করেছে, পরীক্ষা দিয়েছে। ভাবলে মনটা বড় হয়ে যায়। সরকার সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি দেশে অনেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে। দেশে একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। চিকিৎসা শিক্ষাকে আরও সহজ করতে বিভাগীয় পর্যায়ে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করতে যাচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার। আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাঁর কন্যার এ সাফল্য দেখে বিস্মিত হতেন। এত ভালো অর্জনের পরও মাঝেমধ্যে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কারণ কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করেছেন। বিভিন্ন নামে ভুঁইফোড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করে শিক্ষা নামের খাতটি ধ্বংসের অপচেষ্টা করছেন। এত কিছুর পরও আমি আশাবাদী এসব অন্ধকার দূর হয়ে আলো আসবেই। কারণ নকল সিমেন্ট দিয়ে ভবন নির্মাণ করলে যেমন যে কোনো সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে, তেমনি এসব ভুঁইফোড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাগাম টেনে ধরা না গেলে মেরুদন্ডহীন জাতি তৈরি হবে। আর এটা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। সুতরাং গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষাই আজ সমৃদ্ধ জাতি তৈরির জন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত। যা সবাই মিলে অবশ্যই অর্জন করতে হবে।

লেখক : সাবেক প্রো-ভিসি বিএসএমএমইউ।

সর্বশেষ খবর