বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই

তসলিমা নাসরিন

যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই

রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ অনেকটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো। একাত্তরে বাঙালির ওপর শত্রুসেনার হামলা শুরু হলে নারী আর শিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল শহর থেকে দূরে, গ্রামেগঞ্জে, প্রচুর পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল পাশের দেশে। পুরুষদের অনেকে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল যুদ্ধ করবে বলে। শেখ মুজিব যার যা কিছু আছে, সব নিয়ে সংগ্রাম করার আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। ইউক্রেনের অনেক পুরুষই অস্ত্র হাতে নিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী জেলেন্সকি অস্ত্র হাতে নিয়ে শত্রুসেনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলেছেন। ইউক্রেন থেকেও মানুষ দলে দলে পাশের দেশ পোল্যান্ড আর মলদোভায় আশ্রয় নিচ্ছে। রাশিয়া আর ইউক্রেন এক কালে একই দেশ ছিল। পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানও ছিল একই দেশ। ধর্ম অধিকাংশের একই, ভাষাও কাছাকাছি। রাশিয়ার আর ইউক্রেনের বেলায়ও তাই। তবে পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগোলিক দূরত্ব বেশি ছিল, রাশিয়া আর ইউক্রেন একই ভূমির ওপর দাঁড়ানো। একাত্তরে পাকিস্তানকে নয়, বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল রাশিয়া, আর আজ এই রাশিয়াই করছে অন্য দেশের ওপর পাকিস্তানের মতো একই রকম অতর্কিতে আক্রমণ। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন না হয়ে অন্য কেউ হলে হয়তো এভাবে যুদ্ধ বাধাতেন না। পুতিন পাগল। কিন্তু কে পাগল নয়? আমরা তো শান্তির কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা গণতন্ত্রের দাবিদার দেশগুলোকেও যুদ্ধের দামামা বাজাতে দেখেছি।

আজ সারা পৃথিবীতে যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষ মিছিল করছে। ইউরোপের দেশগুলোতে তো বটেই, এমনকী রাশিয়ার শহরগুলোতেও, মস্কোতে, সেন্ট পিটার্সবুর্গে। রাশিয়ার লোকদের আত্মীয়স্বজন ইউক্রেনে বাস করেন। দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বও বেশ। কিন্তু রাশিয়াতে কোনও শান্তিমিছিল হতে দিচ্ছে না পুতিনের পুলিশ। না দিলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ যুদ্ধবিরোধী কথা বলছেই। এক প্রেমিক ইউক্রেনের পতাকা গায়ে জড়িয়ে, এক প্রেমিকা রাশিয়ার পতাকা গায়ে জড়িয়ে চুমু খাচ্ছে পরস্পরকে। দুই দেশে জন্ম তাদের, কিন্তু তারা পরস্পরকে ভালোবাসে। আরেক দম্পতি বিছানায় শুয়ে চুমু খাচ্ছে, এক হাতে ধরে আছে একজন রাশিয়ার, আরেকজন ইউক্রেনের পাসপোর্ট। অন্য হাতে দু’জনই যুদ্ধের দিকে মধ্যম আঙুল দেখাচ্ছে। দুজনের মাঝখানে বসে আছে তাদের শিশু সন্তান। যুদ্ধবিরোধী বার্তা এর চেয়ে শক্তিশালী আর কী হতে পারে!

ইরাকে ভয়াবহ হামলা দেখেছি। কত যে বিলিয়ন ডলার খরচ করে সাদ্দাম হোসেনকে গদি থেকে নামাতে গিয়েছিল আমেরিকা! কাকে গদিতে বসাবে, কাকে গদি থেকে নামাবে, এ নিয়ে আমেরিকা চিরকালই মাথা ঘামিয়েছে। ইরাকে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেল। জন্ম নিল আইসিস নামের সন্ত্রাসী সংগঠন। ওদিকে কয়েক বছর আফগানিস্তানের মাটিতে বসে আমেরিকার যুদ্ধের ফল কী হলো, তালিবান এলো ক্ষমতায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে ইউরোপ এটুকু বুঝেছে তারা আর যাই চাক, যুদ্ধ চায় না। যে নাৎসি কর্মকাণ্ডের জন্য ইউরোপ ভুগেছে, সেই নাৎসি কর্মকাণ্ড তো বটেই, নাৎসি মতবাদও চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে, চিরকালীন শান্তির বার্তা ঘোষণা করে দিয়েছে ইউরোপ। ধনী-গরিবের মধ্যে সমতা আনার সবরকম উদ্যোগ নিয়েছে, জনকল্যাণ রাষ্ট্র তৈরি করেছে, ইউরোপকে এক করে দিয়েছে, পরস্পরকে সাহায্য করার ব্রত গ্রহণ করেছে। এই ইউরোপের খানিকটা অংশজুড়ে রয়েছে রাশিয়া। রাশিয়ার চেয়ে আর বেশি কে দেখেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা! সে আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল যুদ্ধে। তারপরও যুদ্ধবাজ হিটলারের মতো কাউকে গ্রাহ্য না করে আগ্রাসনে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন পুতিন। চারদিকের দেশগুলো শাস্তি হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিচ্ছে। তারপরও পুতিনের টনক নড়ছে না। এক আমেরিকার এমবার্গোতেই কিউবা এবং আরও কত দেশ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতে বাধ্য হয়েছে!

আমাদের তো একটিই ভয়। মাথা-পাগল লোকেরা কবে না জানি পারমাণবিক বোমার ট্রিগার টিপে দেয়। পাকিস্তানকে নিয়ে তো ভয় আছেই। এখন রাশিয়ার আস্ফালন দেখে তো আরেকটি আশঙ্কা যোগ হলো। পৃথিবী গড়ে তুলতে মানুষ যেমন পারে, পৃথিবী ধ্বংস করতেও মানুষ তেমন পারে।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয় হিংসে, ঘৃণা, বর্বরতা, নৃশংসতা, প্রতিশোধপরায়ণতা বোধহয় মানুষের রক্তে আছে। মানুষ সভ্যতা, মানবতার কথা শেখে বটে, উদারতার চর্চা করে বটে, তবে মাঝে মাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তার রক্তের সেইসব ঘৃণ্য চরিত্র । এ কারণেই যুদ্ধ কখনও থামে না। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ছোট আকারের হলেও মানুষে মানুষে ঝগড়া লড়াই অসন্তোষ অশান্তি চলছেই। পরিবারে, সমাজে, দলে, রাজ্যে, রাষ্ট্রে কোথাও একশ ভাগ শান্তি স্বস্তির দেখা মেলে না। এ কারণেই ইউটোপিয়া শুধু স্বপ্নই থেকে গেল। কোনও দিন হয়তো এটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে না।

এতকাল ইউরোপের এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে শত্রুতা করেছে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছে। অথচ দিন যত যাচ্ছে, তারা পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠছে, পরস্পরের বিপদে আপদে সাহায্য করছে। বর্ডার বলতে কিছু নেই, কারেন্সিও সব এক করে ফেলেছে। ইউরোপের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সার্ক এবং আসিয়ান নামের সংগঠন গড়ে উঠেছে, অথচ আজ অবধি বর্ডারে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া, শক্ত দেয়াল, রাইফেল হাতের সীমানা পুলিশ। আজ অবধি কারেন্সি এক হয়নি। ইউরোপ যা পেরেছে, তা হাজার বছরেও এশিয়াতে সম্ভব কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ হয়। ভারত আর পাকিস্তানের বিরোধ, চীন এবং ভারতের বিরোধ কবে ঘুচবে, আদৌ ঘুচবে কিনা তা আমরা অনুমান করতেও পারি না।

বাইডেন বলে দিয়েছেন, পুতিনকে তাঁর আগ্রাসনের খেসারত দিতে হবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল না বলে কীভাবে যুগের পর যুগ দারিদ্র্যে ভুগেছে দেশগুলো, শেষ পর্যন্ত বার্লিন দেওয়াল ভাঙার পর তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে পূর্ব ইউরোপ-এ তো আমাদের জীবদ্দশায় দেখা। তাহলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে পুতিনের রাশিয়াকে একই রকম একঘরে করে দিতে পারে ইউরোপ এবং আমেরিকা। ভুগবে কারা? সাধারণ মানুষ। দেশের সব সম্পদ তো কিছু দুর্নীতিবাজ ধনীর হাতেই। ব্যক্তি পুতিনকে ভুগতে হবে না। পুতিন তো এক নব্য জারের মতো। রাশিয়ার জাররা নিজেরা অঢেল সম্পদ নিয়ে আমোদ স্ফূর্তিতে ব্যস্ত থাকতেন, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের দিকে মোটেও তাঁদের নজর যেত না। পারমাণবিক বোমা আর অস্ত্রশস্ত্র বানিয়ে দেশের সবার অভাব দূর করা যায় না, দুর্নীতির পাঁকে পা দিলে দারিদ্র্যও দূর করা যায় না।

রাশিয়ার গল্প উপন্যাস পড়ে কেটেছে আমার ছোটবেলা। সাধারণ মানুষের জীবনের কথা কত পড়েছি। প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে, শুধু পরিজ খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। সেই সব দরিদ্র মানুষের জন্য কত কত রাত কেঁদেছি। আজকের আধুনিক পৃথিবী মনে হচ্ছে আমাদের আবার কাঁদাবে। অনাহারে অনিদ্রায় অভাবে মানুষ নুয়ে থাকবে। আর আমাদের শুনতে হবে তাদের কান্না আর হাহাকারের শব্দ। পুঁজিবাদীরা অভিযোগ করতো, সমাজতন্ত্র মানুষকে অভাবে ডুবিয়ে রাখে। সমাজতন্ত্র ভেঙে দিয়ে যে পুঁজিবাদ আনা হলো রাশিয়াতে, সেই পুঁজিবাদও তো কিছু মানুষকে ধনী বানিয়ে বাকি মানুষকে অভাবে ডুবিয়ে রেখেছে। এইসব পুরোনো বাদ বা তন্ত্র মানুষের মধ্যে সমতা আর শান্তি আনে না। আধুনিক রীতি নীতি আদর্শই সকলের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান, এবং শিক্ষা স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দিতে পারে, সমতা এবং সমানাধিকারের ভিত্তিতে গড়ে তোলা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাই ধনী এবং দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে পারে, আধুনিক গণতান্ত্রিক কাঠামোই বাক-স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে। উত্তর ইউরোপের সভ্যতা আমাদের সে বিশ্বাস দিয়েছে।

রাশিয়ার নতুন যুদ্ধ কৌশল নিয়ে মানুষের আগ্রহের সীমা নেই। ইউক্রেনের কিছু কিছু বাড়ির ছাদে নাকি লাল ক্রুশ চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ সন্দেহ করছে ওই রহস্যজনক ক্রুশ চিহ্নের বাড়িগুলোকে হয়তো বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে রাশিয়া। ইউক্রেনের লোকেরা রাশিয়ার ট্যাংকের গতি শ্লথ করে দিয়েছে, ভুল রাস্তায় রাশিয়ার সৈন্যদের যেতে বাধ্য করছে। জার্মানি কথা দিয়েছে ইউক্রেনকে অস্ত্র পাঠাবে। এইসব খবর আমার শুনতে ভালো লাগে না। আমি যুদ্ধ চাই না। আমি চাই রাশিয়া আর ইউক্রেন কথা বলুক, যুদ্ধ থামিয়ে দিক, পরস্পরের বন্ধু হয়ে যাক তারা। সারা পৃথিবী বসে বসে যুদ্ধ না দেখে দুই শত্রুর মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে সাহায্য করুক। একে ওকে অস্ত্র পাঠিয়ে, এমবারগো দিয়ে, বাণিজ্য বন্ধ করে শান্তি আনা যায় না। চিরকালের শত্রু জার্মানি আর ফ্রান্স যদি বন্ধু হতে পারে, ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড যদি বন্ধু হতে পারে, সাতশ’ বছর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আয়ারল্যান্ড আর ইংল্যান্ড যদি বন্ধু হতে পারে, রাশিয়া আর ইউক্রেন পারবে না কেন? আলবৎ পারবে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর