বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : সারা বিশ্ব বিপদে

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : সারা বিশ্ব বিপদে

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘দি ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস’ এক গবেষণায় দেখেছে একটি যুদ্ধাক্রান্ত দেশের জিডিপি গড়ে ৪১ শতাংশ যুদ্ধের কারণে হ্রাস পায়। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে বেশি মাত্রায় যুদ্ধাক্রান্ত ১০টি দেশের ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছে, একটি দেশের জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশ যুদ্ধের কারণে হ্রাস পেতে পারে। ২০২১ সালে এ প্রতিষ্ঠান ‘ইকোনমিক ভ্যালু অব পিস-২০২১’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় ওই বছর যুদ্ধ-সংঘাতে বিশ্বে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু এবং এর চেয়ে প্রায় ৪০ গুণ বেশি মানুষ আহত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, নিরস্ত্রীকরণ, সংঘাত ও শান্তি প্রক্রিয়ার ওপর লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ডিফেন্স অ্যান্ড পিস ইকোনমিকস’ গত বছর ‘দি ইকোনমিকস কস্ট অব হাইব্রিড ওয়ারস : দ্য কেস অব ইউক্রেন’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায় রাশিয়ার উসকানিতে ইউক্রেনের ডোনবাস অঞ্চলে বিদ্রোহী বা ইনসারজেন্টদের সঙ্গে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চলমান যুদ্ধে দেশটির জিডিপি ১৫ শতাংশের বেশি হ্রাস পায়। অন্যদিকে রাশিয়া সমর্থিত দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের সংঘাতে এসব অঞ্চলের জিডিপি ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। এবারের রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত যেহেতু সমগ্র ইউক্রেনের স্থলভাগ, আকাশপথ ও কৃষ্ণ সাগরে ছড়িয়ে পড়েছে, সে কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশ্ব মিডিয়া।

ব্লুমবার্গ-যুক্তরাষ্ট্র : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক সংবাদ ও অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সকালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ইউক্রেন যুদ্ধের হুমকি বিষয়ে পাঁচজন গবেষকের লেখা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের শুরুতেই সাম্প্রতিক করোনা মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষত শুকানোর আগেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ বা আগ্রাসনকে ব্যাপক হুমকি বলে আশঙ্কা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বুকে এটাই ভয়াবহ যুদ্ধ হতে চলেছে বলে মন্তব্য করা হয়। যুদ্ধের উত্তেজনায় জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার অতিক্রম করেছে, যা ২০১৪ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড। ইউরোপজুড়ে জ্বালানি গ্যাসের দামও বেড়েছে ৬২ শতাংশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন এক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, যা মূলত রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে মার্কিন ডলারে ব্যবসা করা থেকে বাধাগ্রস্ত করতেই আরোপ করা হয়। করোনা মহামারির কারণে এমনিতেই বিশ্ব অর্থনীতি মূল্যস্ফীতি ও অস্থিতিশীল অর্থনীতির মতো জটিল দুটি সমস্যায় জর্জরিত। ইউক্রেন যুদ্ধ এ সমস্যার মাত্রা ক্রমেই বাড়িয়ে তুলবে।

ইউরোপের মানুষ বরফের কারণে বাড়িঘরে উত্তাপ বা হিটিং সিস্টেম চালু রাখতে বাধ্য হয়। তবে এ ক্ষেত্রে এবং গাড়ির জ্বালানির ক্ষেত্রে তাদের ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। ফলে ঘরের অন্যান্য খরচ কমানো ছাড়া কোনো গতি থাকবে না তাদের। শেয়ার ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রটি করোনার কারণে প্রায় নিমজ্জিতই ছিল। যুদ্ধের কারণে তা আরও তলিয়ে যাবে। এতে মানুষের সম্পদ ও আত্মবিশ্বাস দুটিতেই ঘাটতি দেখা দেবে। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগের জন্য অর্থ জোগাড় করতে রীতিমতো হিমশিম খাবে। বিভিন্ন দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। তবে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করছে তার মেয়াদ, পরিধি বা সীমানা এবং তীব্রতার বিপরীতে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ার ওপর বিশ্ব অর্থনীতিতে সৃষ্ট চাপের প্রভাব নির্ভর করবে। রাশিয়াই ইউরোপের দেশসমূহে তেল ও গ্যাসের মূল জোগানদাতা। সুতরাং ইউরোপ তথা বিশ্ব অর্থনীতির অনেকটাই এখন রাশিয়া থেকে ইউরোপে তেল ও গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়ার সদিচ্ছা এবং ইউক্রেনের ওপর দিয়ে রাশিয়া থেকে ইউরোপে তেল ও গ্যাস সঞ্চালন লাইনের নিরাপত্তার ওপর নির্ভরশীল।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-যুক্তরাষ্ট্র : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস দুজন গবেষকের লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এ প্রবন্ধে উঠে এসেছে বিশ্বের সার্বিক অর্থনীতিতে ইউক্রেন সংকটের সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা। এ প্রতিবেদনের শুরুতেই মূল যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ার ওপর মার্কিনিদের সম্ভাব্য অবরোধের কারণে শেয়ারবাজারের নিম্নগতি ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সংকটের কথা তুলে ধরা হয়। জ্বালানি, খাদ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগ ও বিশ্ব অর্থনীতির অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে বলেই ধারণা গবেষকদের। তাদের দৃষ্টিতে রাশিয়া ১৪৬ মিলিয়ন মানুষের বহুমাত্রিক এবং বহু দেশের স্বার্থনির্ভর একটি দেশ। রাশিয়ার রয়েছে পারমাণবিক সক্ষমতা। এ ছাড়া পারমাণবিক সরঞ্জাম, তেল, গ্যাস ও অন্যান্য কাঁচামালের জন্য বিশ্বের বহু দেশ সরাসরি রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা রাশিয়াকে দেখেন একটি বড় গ্যাসভাণ্ডার হিসেবে। ইউরোপের দেশগুলোর ২৫% জ্বালানি তেল এবং ৪০% প্রাকৃতিক গ্যাস জোগান দেয় রাশিয়া। তীব্র শীতে বাড়িঘর ও অফিসে কাক্সিক্ষত তাপমাত্রা বা উষ্ণতা ধরে রাখতে গ্যাসের প্রয়োজন, যা রাশিয়া থেকে আসে। ফলে গ্যাসের সরবরাহ-মূল্য বৃদ্ধির চিন্তায় ভাঁজ ফেলেছে ইউরোপীয় নেতাদের কপালে। রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গম রপ্তানিকারক দেশ। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বিশ্বের প্রায় ২৫% গম রপ্তানি হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইয়ান গোলডিনের আশঙ্কা, এ সংকটের কারণে খাদ্য কেনা ও ঘরের উষ্ণতার খরচ মেটাতে হিমশিম খাবে নিম্ন আয়ের মানুষ। দীর্ঘদিন আগে থেকেই ইউক্রেন ইউরোপের ‘ব্রেড বাস্কেট’ নামে পরিচিত। ইউক্রেনে উৎপাদিত গম ও ভুট্টার ৪০% মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় রপ্তানি হয়। ভবিষ্যতে যুদ্ধের তীব্রতায় উৎপাদন ব্যাহত হলে এবং খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে সামাজিক অস্থিরতাও বেড়ে যাবে। ইউক্রেন বিশ্বে সর্বাধিক তেলবীজ যেমন সূর্যমুখী ও র‌্যাপ রপ্তানি করে। আনুগত্যের কারণে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক প্রদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া। পাল্টা জবাব দিতে আমেরিকা এ দুটি অঞ্চলে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ (মুদ্রাব্যবস্থা) সাড়ে ৭ শতাংশ স্ফীতির সম্মুখীন ছিল গেল জানুয়ারিতে, যা গত ৪০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়ার ফলে সাধারণ মানুষের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানো সহজ হবে না। ফলে মুদ্রাস্ফীতির বিস্ফোরণের আশঙ্কা করছেন টাফস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্রিস্টোফার মিলার। যুদ্ধের ফলে রাশিয়া ও ইউক্রেন-কেন্দ্রিক ধাতব পদার্থ বা মেটালের মূল্যবৃদ্ধি বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে। মোটরগাড়ি, বিমান, জাহাজ, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, মোবাইল ফোন এমনকি দাঁতের চিকিৎসা উপকরণের দামও বেড়ে গেছে সংশ্লিষ্ট ধাতব পদার্থের মূল্যবৃদ্ধির কারণে।

বিবিসি-ব্রিটেন : ২৬ ফেব্রুয়ারি বিবিসির বিজনেস রিপোর্টার লোরা জোনস লিখেছেন, পাঁচটি কারণে ইউক্রেন সংঘাত মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। তাঁর প্রথম শঙ্কা- বাড়িঘর, অফিস-আদালত বরফের মধ্যে গরম রাখতেই প্রচুর ব্যয় হয়ে যাবে তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। দ্বিতীয়ত তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বহু দেশে খাদ্যসামগ্রীর দাম কয়েক গুণ বাড়তে পারে। এসব দেশের গম ও ভুট্টার জোগান দেয় রাশিয়া। ব্রিটেনসহ বহু ইউরোপীয় দেশের কৃষক নির্ভর করে রাশিয়ার সারের ওপর। তৃতীয়ত ব্যাংকের সুদ বেড়ে যেতে পারে ইউরোপ-জুড়ে। ফলে পণ্যের বিক্রিতে এবং বাড়ি কেনায় নেওয়া ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ভাটা পড়বে। চতুর্থত শেয়ারবাজারে ধস নামার কারণে যেসব পেনশনভোগী ব্যাংকে টাকা রেখেছেন এবং ব্যাংক কর্তৃক শেয়ারবাজার বিনিয়োগের সুফল পাচ্ছিলেন, তারা আগের মতো উচ্চ মুনাফা থেকে বঞ্চিত হবেন। বিবিসির সর্বশেষ শঙ্কা- এ যুদ্ধের কারণে ইউরোপজুড়ে গাড়ির দাম বেড়ে যাবে। কারণ গাড়ি ও বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরির মূল ধাতব পদার্থ রাশিয়া সরবরাহ করে।

ফিন্যানশিয়াল টাইমস-ব্রিটেন : লন্ডনভিত্তিক ফিন্যানশিয়াল টাইমস পত্রিকার তিন গবেষক ২৫ ফেব্রুয়ারি লিখেছেন- শুধু জ্বালানির (তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি) মূল্যবৃদ্ধির কারণে তিন বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা (রিসেশন) দেখা দিতে পারে। পত্রিকাটি বলছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন শেষ বিচারে কী প্রত্যাশা করছেন তা স্পষ্ট নয়। শুধু ইউক্রেনের সরকার পরিবর্তন না ইউক্রেন ছাড়িয়ে অন্য কোনো ভূখণ্ডে তাঁর নজর সেটাই চিন্তার বিষয়। ইউক্রেন দখল তাইওয়ানে চীনের আধিপত্য আরও শক্তিশালী করবে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। এ সংকট মানুষকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যয় না করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য সাবধানতা অবলম্বন বা হাতে সঞ্চয় রাখার প্রবণতা সৃষ্টি করবে। এর ফলে সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি পিছিয়ে পড়বে। বছরজুড়ে জ্বালানি তেলের মূল্য যদি ব্যারেলপ্রতি ১২০ থেকে ১৪০ ডলারের মধ্যে থাকে এবং গ্যাসের মূল্যও যদি আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়, তাহলে ইউরোপজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ২ শতাংশ বাড়বে। ফলে মানুষের প্রকৃত উপার্জন, সঞ্চয়, বিনিয়োগ সবই হ্রাস পাবে।

রয়টার্স-ব্রিটেন : সমগ্র পৃথিবীকে তালুবন্দি করেছে নানা ধরনের স্মার্টফোন। আর ড্রইংরুমে বসে বিশ্বকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে স্মার্ট টেলিভিশন, জীবনকে সহজ করেছে কম্পিউটার। এসব কিছুর চালিকাশক্তি নানা ধরনের চিপস ও সেমি কন্ডাক্টর। ২৪ ফেব্রুয়ারি রয়টার্সের দুই প্রতিবেদকের তথ্যমতে আমেরিকার বিভিন্ন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত সেমি কন্ডাক্টর গ্রেড নিয়নের ৯০ ভাগ জোগান দেয় ইউক্রেন। সেমি কন্ডাক্টর চিপস তৈরির মূল সরঞ্জাম, উচ্চ প্রযুক্তির সব যানবাহন, নির্মাণযন্ত্র, কলকারখানার মেশিনারিজ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, লিফটসহ গৃহস্থালি সরঞ্জামেও সেন্সর ও মেমোরি চিপস ব্যবহৃত হয়, যা উৎপন্ন হয় পেলাডিয়াম নামের এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থেকে। আমেরিকায় ব্যবহৃত ৩৫ ভাগ পেলাডিয়াম আসে রাশিয়া থেকে। হোয়াইট হাউস ইতোমধ্যে উৎপাদক ও বিনিয়োগকারীদের চিপসের বিকল্প উৎস খুঁজতে বলেছে। বিষয়টি চিপসের আরেক বড় ক্রেতা জাপানকেও ভাবিয়ে তুলেছে। স্যামসাং ইলেকট্র্রনিক্স কিংবা ইনটেলের মতো প্রযুক্তিগত পণ্য উৎপাদনকারীরাও এখন নিয়নের বিকল্প বাজার খুঁজছে।

ইনডিপেনডেন্ট-ব্রিটেন : বিশ্ব অর্থনীতিতে এক জাদুকরী শব্দ হলো সুইফট। ইংরেজিতে যার পূর্ণরূপ হলো ‘সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশন’। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তব্যাংক আর্থিক লেনদেনের বার্তা প্রেরণের একটি সুরক্ষিত নেটওয়ার্ক। নিরাপদ ও দ্রুত অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে সুইফট একটি বার্তা বা সংকেত (কোড) প্রদান পদ্ধতি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এ গোপন কোড প্রদান সাপেক্ষে বার্তা, অর্থ ছাড়ের নির্দেশনা তথা লেনদেন নিয়ন্ত্রিত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিপরীতে রাশিয়ার বেশ কিছু ব্যাংককে সুইফট কোড ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। বিশ্বের প্রায় ১১ হাজার ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান দ্রুততম সময়ে দেশ-বিদেশে আর্থিক লেনদেন করে। সুইফট কোড ব্যবহার করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রাশিয়ার সঙ্গে ৮০ বিলিয়ন ইউরো লেনদেন করে। এ বাধা তাই রাশিয়ার ওপর বড় আকারের চাপ সৃষ্টি করবে।

প্রসঙ্গ : বাংলাদেশ : ভৌগোলিক দূরত্ব যা-ই হোক, বর্তমান বিশ্বে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সখ্য কিংবা প্রতিযোগিতা নানাভাবেই গড়ে ওঠে। ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত চলছে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। তবে রাশিয়ার আরটি ২ ইউটিটি এইচ আর এস ২৪ ইয়ার্স, আরএস ২৬ ব্যারেজ, আরএস ৩৬-সহ বিভিন্ন ধরনের আন্তমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) বর্তমানে সক্রিয় অবস্থায় আছে, যা ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিলোমিটার দূরেও পারমাণবিক বোমা বহন, নিক্ষেপ ও বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম। পুতিন ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর পারমাণবিক যোদ্ধাদের প্রস্তুত ও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলেও তিনি তা করবেন না বলেই বিশ্ববাসীর ধারণা। সে অর্থে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর মতো অবশ্যই নিরাপদ। তবে একটি দেশের নিরাপত্তা বলতে আজ আর কেবল অস্ত্রের জোরে জবরদখল কিংবা শারীরিক সুরক্ষা বলয় বোঝায় না। নিরাপত্তা এখন নানা ধরনের সমীকরণ ও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিনিয়ত সামনে আসছে। আবার নানা পরিস্থিতিতে এ নিরাপত্তার গুরুত্ব ওঠানামা করছে। এই তো করোনাভাইরাস গত দুই বছর জৈব নিরাপত্তার বিষয়টি নতুনভাবে ভাবিয়েছে সবাইকে। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটের বদলে সুরক্ষা গাউন (পিপিই), অস্ত্রের বদলে সিরিঞ্জ, গ্রেনেডের বদলে ভ্যাকসিন, ট্যাংকের বদলে অ্যাম্বুলেন্সের গুরুত্ব তুলে ধরছে। ১৯৭৪ সালে আমেরিকার প্রতিশ্রুত গমের জাহাজ না আসায় সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ তথা বঙ্গবন্ধুবিরোধী প্রচারণা নতুন মাত্রা লাভ করে। তবে আজ রাশিয়া কিংবা ইউক্রেনের গম ও ভুট্টা না এলে বাংলাদেশ হয়তো ততটা সমস্যার সম্মুখীন হবে না। তবে সে সুযোগ নিতে ছাড়বেন না দেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ী। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হতে পারে যদি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ইউরোপবাসীর ক্রয়ক্ষমতা তথা তৈরি পোশাকের চাহিদা হ্রাস কিংবা রাশিয়া থেকে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র অথবা ভোলা গ্যাসফিল্ডে রাশিয়ার কাঁচামাল, মানবসম্পদ কিংবা প্রতিশ্রুত ঋণের টাকা সরবরাহে জটিলতা সৃষ্টি হয়।

লেখক : গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর